জুমবাংলা ডেস্ক : মো. ইমরান আলী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর বাসিন্দা। ২০১৯ সালে ভোটার হওয়ার জন্য তথ্য দেন তিনি। পরে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আনতে গিয়ে দেখেন, ছবি ও ছবির নিচের স্বাক্ষর তাঁরই; কিন্তু নাম-পরিচয় সবই মোসা. মিম আক্তার নামের এক নারীর। যদিও তাঁকে লৈঙ্গিক পরিচয়ে পুরুষ উল্লেখ করা হয়েছে। এই ভুল সংশোধনে ২০২২ সালের ৩১ মে আবেদন করেন ইমরান। আজও সেই আবেদন ঝুলে আছে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের মিষ্টু চন্দ্র দাস ইসির ভুলে হয়ে গেছেন মিঠু চন্দ্র দাস। আর এই ভুলে আটকে গেছে তাঁর বেতন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ইসি সূত্রে জানা গেছে, শুধু ইমরান কিংবা মিষ্টুই নয়, ইসির ভুলে এমন অনেকেই ভোগান্তিতে পড়েছেন। তাঁরাসহ সাড়ে তিন লাখের মতো নাগরিকের এনআইডি সংশোধনের আবেদন ইসিতে জমা পড়ে আছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
অথচ জাতীয় পরিচয়পত্র ও সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত (সংশোধন, যাচাই ও সরবরাহ) প্রবিধানমালা ২০১৪-এ উল্লেখিত জাতীয় পরিচয়পত্র বা সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্তে মুদ্রণজনিত ভুল সংশোধন অংশে বলা হয়েছে, এনআইডি সংশোধনের আবেদন করার পর জরুরি হলে সাত কার্যদিবস, আর সাধারণ ফি দিয়ে আবেদন করলে তা ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো আবেদন নামঞ্জুর করলে নাগরিক তা জানার ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে ইসিতে আপিল করতে পারবেন। আপিল পাওয়ার ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনের তা নিষ্পত্তি করার বিধান রয়েছে।
এ ব্যাপারে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, সংশোধনের আবেদন করলে কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা নিষ্পন্ন করতে হয়। তবে এটি এত সময় কেন লাগবে, সে প্রশ্ন তিনি নিজেও রাখেন।
ঝুলে আছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ আবেদন ইসি সূত্র বলেছে, গত রবিবার পর্যন্ত ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ ও ‘ঘ’ ক্যাটাগরিতে এনআইডি সংশোধনের প্রায় সাড়ে তিন লাখ আবেদন জমা পড়ে আছে। তদন্তের অপেক্ষায় আছে পৌনে ১ লাখের বেশি আবেদন। নাগরিক আবেদন করার পর সেভাবেই পড়ে আছে ২৫ হাজারের মতো।
কোন পর্যায়ের নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে আবেদন জমা আছে, তার ওপর ক্যাটাগরি নির্ধারিত হয়। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে আবেদন জমা থাকলে তা ‘ক’ ক্যাটাগরির। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ১০ আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এবং মহাপরিচালকের (ডিজি) কাছে আবেদন জমা থাকলে সেগুলো যথাক্রমে ‘খ’, ‘গ’ ও ‘ঘ’ ক্যাটাগরির।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর মো. ইমরান আলীর বাবার নাম মো. ছলিম উদ্দিন, মায়ের নাম মোছা. তফিনা বেগম এবং জন্মতারিখ ২০০১ সালের ৩ জানুয়ারি। কিন্তু তাঁর পরিচয়পত্রে নাম ছাপা হয়েছে মোসা. মিম আক্তার, বাবার নাম মো. সাইফুল ইসলাম, মায়ের নাম মোসা. নারগিস আক্তার এবং জন্মতারিখ ২০০০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। মিম আক্তারের স্বামীর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর।
ইমরানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি এসএসসি সার্টিফিকেট, অনলাইন জন্মসনদ ও মা-বাবার এনআইডি কপি জমা দিয়ে ২০২২ সালের ৩১ মে এনআইডি সংশোধনের আবেদন করেন। এর সাড়ে তিন মাস পর ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়। স্বয়ংক্রিয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্তকরণ সিস্টেম (অ্যাফিস) ম্যাচিং করে আবেদনটি সংশোধন করা যেতে পারে বলে উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। অ্যাফিস ম্যাচ করে তা সঠিক পাওয়া যায়। তদন্ত প্রতিবেদন ও অ্যাফিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী সংশোধন বিবেচনা করা যায় বলে ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর নথি উপস্থাপন করা হয়। এরপর ওই নথির ভিত্তিতে ইমরান আলীর নিবন্ধন ফরম চাওয়া হয়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর ২ নম্বর ফরম (ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় ভোটারের বাড়ি গিয়ে তথ্যসংগ্রহকারীর হাতে পূরণ করা ফরম) চাওয়া হয়। তার পর থেকে ওভাবেই পড়ে আছে আবেদনটি। অর্থাৎ আবেদনটি ঝুলে আছে ২১ মাস ধরে।
মো. ইমরান আলী বলেন, ‘আমি ২০১৯ সালে ভোটার হয়েছি। পরে যখন এনআইডি আনতে গিয়েছি, তখন দেখি সেখানে আমার ছবি আর স্বাক্ষর ছাড়া বাকি সব তথ্য অন্য এক নারীর নামে। সেখানে মা-বাবার নাম, জন্মতারিখ কিছুই ঠিক নেই। তারপর সংশোধনের আবেদন করে ঘুরতেছি। এখনো কোনো সমাধান পাইনি। এনআইডির জন্য কোনো কাজ করতে পারছি না।’ তিনি জানান, গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর কাছে ২ নম্বর ফরম চাওয়া হয়েছে। তিনি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে জানানো হয়, ফরমটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরের মিষ্টু চন্দ্র দাসের অবশ্য ২ নম্বর ফরমে নাম ঠিক আছে। তিনি বলেন, ‘আমি ফি জমা দিয়ে ২০২২ সালের ২০ মার্চ এনআইডি সংশোধনের জন্য আবেদন করেছি। সেটি সংশোধন না হওয়ায় খুব ঝামেলায় আছি। আমি মাস্টার্স পাস করেছি। সম্প্রতি একটি সরকারি চাকরিতেও যোগ দিয়েছি। কিন্তু সার্টিফিকেট এবং এনআইডিতে নাম মিল না থাকায় বেতন পাওয়ার জন্য ডকুমেন্ট সাবমিট করতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি ১০৫ নম্বরে ফোন দিলে জানানো হয়, আমার আবেদনটি গ ক্যাটাগরিতে আছে। তাই কুমিল্লা আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়। এনআইডিতে আমার যে ছবি রয়েছে, তার নিচে আমি যে স্বাক্ষর করেছি, সেখানেও নাম মিষ্টু চন্দ্র দাস লেখা রয়েছে। তারপরও আমার এনআইডিটা সংশোধন হচ্ছে না।’
ইসি সূত্র বলেছে, ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের মনোনীত তথ্য সংগ্রহকারীরা হাতে পূরণ করার ফরম নিয়ে বাড়ি বাড়ি যান। এই ফরমটিই ২ নম্বর ফরম। এরপর সংশ্লিষ্ট ভোটারকে ছবি ও আঙুলের ছাপ দিতে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে যেতে বলা হয়। সব তথ্য সংগ্রহের পর হয় যাচাই-বাছাই। তারপর নির্বাচন কমিশনের মূল সার্ভারে ভোটারের ছবি ও তথ্য আপলোড করেন উপজেলা বা থানা নির্বাচন কর্মকর্তা। সূত্র বলেছে, অনেকেই মাঠপর্যায়ে ভোটারের ছবি ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে পরে নিরিবিলি কাজ করতে চান। এটি করতে গিয়েই তাঁরা অনেক সময় ভুল করেন।
বিষয়টি নজরে আনলে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘২ নম্বর ফরমে তথ্য সঠিক থাকলে সেটি এমনিতেই হয়ে যাওয়ার কথা। যদি সেটি ক্যাটাগরি করে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়, সেটি হয়তো ভুলে হয়ে থাকতে পারে। এ বিষয়ে আমি খোঁজ নিচ্ছি—এমনটা কেন হলো।’
এনআইডি সংশোধনে নাগরিকদের ভোগান্তি কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, ‘আমরা চাই না, কোনো নাগরিক এনআইডি সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়ুক। আমরা গত মাসিক সমন্বয় সভায় কোন সালের কতগুলো এনআইডি সংশোধনের আবেদন পেন্ডিং আছে, সেগুলো আগামী মাসিক সমন্বয় সভায় উপস্থাপন করতে বলেছি। পাশাপাশি সংশোধনের আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশনা দিয়েছি।’ সূত্র : আজকের পত্রিকা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।