সাইফুল ইসলাম : মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ছনকা উচ্চ বিদ্যালয় স্থানান্তরের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বার্থে বিদ্যালয়টি চরাঞ্চল থেকে নদীর পশ্চিম পাড়ে সরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা চলছে, যা শত শত শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

সাটুরিয়া উপজেলার বরাইদ ইউনিয়ন ধলেশ্বরী নদী দ্বারা পূর্ব ও পশ্চিম—দুই অংশে বিভক্ত। নদীর পূর্ব পাড়ের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে ছনকা, বরাইদচর, কাকরাইদ চক, কাকরাইদ, খলিশা ডহুরা, চারিকিত্তা, আগসাভার, হামজা, কৌড়ি ও শালুয়াকান্দিসহ অন্তত ১৫টি গ্রামে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। পাশাপাশি টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার কয়েকটি এলাকার শিক্ষার্থীরাও দীর্ঘদিন ধরে এই চরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে নদীর পূর্ব পাড়ে কোনো মাধ্যমিক বা উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না।
এই বাস্তবতায় ২০১৫ সালের ২ মার্চ উত্তর ছনকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত এক সভার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় ছনকা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের জন্য জমি দান করেন ছনকা গ্রামের সন্তান ও ধুল্যা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শাহজাহান। পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত হয় এবং ২০২২ সালে এমপিওভুক্ত হলে ১০ জন শিক্ষক সরকারি বেতনভাতা পেতে শুরু করেন।
তবে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যালয়টি চরাঞ্চল থেকে সরিয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ের ছনকা বাজার এলাকায় নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। স্থানীয়দের দাবি, এ লক্ষ্যে বাজার এলাকায় ৮২ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর নির্মাণ করে শ্রেণিকক্ষ চালু করা হয়। এতে বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম কার্যত দুই স্থানে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। আন্দোলনের মুখে বিদ্যালয়ের সভাপতি ও সাটুরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রধান শিক্ষক আব্দুল সালামকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেন। বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নদীর পশ্চিম পাড়ে ইতোমধ্যে তিনটি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। বিপরীতে পূর্ব পাড়ের ১৫টি গ্রামের মধ্যে একটিও উচ্চ বিদ্যালয় নেই। বর্তমানে ছনকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ২৪৩ জন। এর মধ্যে ৩০ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী, যাদের ২৪ জনই নদীর পূর্ব পাড়ের। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা নিয়মিত পাঠদান করছেন পশ্চিম পাড়ে, ফলে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা মারাত্মকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় শিক্ষিত যুবসমাজ স্বেচ্ছায় চরাঞ্চলে থেকে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে অন্তত এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি না হয়।
ছনকা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল মজিদ বলেন, “এই বিদ্যালয় চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তিস্বার্থে এটি বাজার এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হলে চরাঞ্চলের শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাবে।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিদ্যালয়টি বাজার এলাকায় স্থানান্তর করা হলে দোকানঘর নির্মাণ ও ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিগত লাভবান হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
এ বিষয়ে সাটুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, “বিদ্যালয়টি চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটি যদি পশ্চিম পাড়ে সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে পূর্ব পাড়ের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার মো. আমীর হোসেন বলেন, “চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেই বিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয়েছিল। আমাদের কথা হচ্ছে- চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে আগে। আমাদের পরিদর্শন রিপোর্টেও এটাই উল্লেখ করা হয়েছে।”
এলাকাবাসী দ্রুত শিক্ষা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তাঁদের দাবি, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্দেশ্য অনুযায়ী নদীর পূর্ব পাড়েই বহাল রেখে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হোক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



