জুমবাংলা ডেস্ক : ঠিক এক মাস আগে একটি ডিমের দাম ছিল ১০ টাকা। যা বাড়তে বাড়তে এখন ১৪ টাকায় ঠেকেছে। গত কয়েকদিন ধরে এ দামেই বিক্রি হচ্ছে ফার্মের মুরগির ডিম। যা গত সপ্তাহের চেয়ে প্রতি পিসে ১ টাকা বেশি। হিসাবে দেখা গেছে, চলতি মাসের প্রতি সপ্তাহে একেকটি ডিমে বেড়েছে ১ টাকা করে। ফলে মাসের চার সপ্তাহে এক ডিমে বেড়েছে ৪ টাকা!
গত দুই বছর ধরেই জুলাই-আগস্টে ডিমের দাম অস্বাভাবিক বাড়ছে। দুই বছর আগে (২০২২ সাল) ঠিক এ সময়েই ডিমের ডজন প্রথমবারের মতো ১৫০ টাকা উঠেছিল। গত বছর ছিল ১৫৫ টাকা। এবারও অবশ্য একটু আগেভাগেই ডিমের দামে নতুন রেকর্ড হলো। বাজারে এখন প্রতি ডজন ডিমের দাম ছুঁয়েছে ১৬০ টাকা।
প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, ডিমের করপোরেট ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের পুরনো চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠায় বাজারে এ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে গত শনিবার (২৫ মে) বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) সংবাদ সম্মেলনও করেছে। সংগঠনটি দাবি করেছে, সারাদেশে হঠাৎ করেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিমের বাজার অস্থির হয়ে যায়। এর নেপথ্যে রয়েছে রাজধানীর তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির কারসাজি। কারণ, তারাই সারাদেশের ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন।
বিপিএ সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ডিম ব্যবসায়ী সমিতি এবং করপোরেট কোম্পানিগুলোর কারসাজিতে হুটহাট বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র খামারিরা যখন ডিম উৎপাদন করেন, তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক চক্র দাম কমিয়ে রাখে। এ অবস্থায় প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদনে টিকে থাকতে পারেন না। তখন ক্ষুদ্র খামারিরা উৎপাদন কমিয়ে দিলে এ অসাধু চক্র ইচ্ছেমতো দাম বাড়ায়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে নিঃস্ব হচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা।
ক্ষুদ্র খামারিরা যখন ডিম উৎপাদন করেন, তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক চক্র দাম কমিয়ে রাখে। এ অবস্থায় প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদনে টিকে থাকতে পারেন না। তখন ক্ষুদ্র খামারিরা উৎপাদন কমিয়ে দিলে এ অসাধু চক্র ইচ্ছেমতো দাম বাড়ায়।- বিপিএ সভাপতি
তার ভাষ্য- করপোরেট কোম্পানি থেকে আড়তে এবং সেখান থেকে খামারি ও ব্যবসায়ীদের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে ও ফেসবুকে পোস্ট করে ডিমের বাড়তি বা কম দাম বাস্তবায়ন করে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি। আর সারাদেশেই এ দামে তখন বেচাকেনা চলে। তারা ইচ্ছেমতো ডিমের দাম কমিয়ে কোল্ড স্টোরেজে জমা করে এবং পরবর্তীসময়ে সেই ডিমই আবার বাড়তি দামে বাজারে ছাড়া হয়।
বুধবার রাজধানীর রামপুরা ও মালিবাগ বাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে ডিমের বাজারের বর্তমান চিত্র পাওয়া গেছে। বড় বাজারগুলোতে এখন প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৫৬ টাকায়। যা পাড়া-মহল্লার দোকানে ১৬০ টাকা।
মালিবাগ বাজারের ডিম বিক্রেতা মাসুদ মিয়া বলেন, ফার্মের মুরগির একটি ডিম পাইকারিতে কিনতে হচ্ছে ১৩ টাকারও বেশি দামে। সামান্য লাভে বিক্রি করলেও প্রতি ডজনের দাম ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে অনেক ডিম ভেঙে যায়। ফলে খুচরায় প্রতি ডজন ১৬০ টাকার কমে বিক্রি করলে লোকসান হয়।
‘এখন ডিমের দাম সবোর্চ্চ। দাম বাড়ায় ক্রেতা কমেছে। আপাতত দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই’- যোগ করেন এ বিক্রেতা।
বাজারে বাদামি ডিমের চেয়ে সাদা রঙের ডিমের দাম তুলনামূলকভাবে একটু কমই থাকে। তবে এ দফায় দুই পদের ডিমের দামই সমান হয়ে গেছে। বড় বাজারগুলোতে বাদামি ডিম প্রতি পিস কিনতে হচ্ছে ১৩ টাকা বা তারও বেশি দামে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক মাসে রাজধানী ঢাকার বাজারগুলোতে ডিমের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ। এক মাস আগেও রাজধানীতে প্রতি হালি ডিম মিলতো ৪০-৪২ টাকায়। যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকায়।
পাইকারি ডিম বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে ডিমের সরবরাহ কিছুটা কমেছে। এছাড়া গত মাসের প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারিরা। অতি গরমে অনেকের খামারে মুরগি মারাও গেছে।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ বলেন, অতিরিক্ত গরমে খামারিদের লাখ লাখ মুরগি মারা গেছে। যে কারণে ডিমের প্রায় ৩০ শতাংশ উৎপাদন কম হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। সরবরাহ কমায় দাম বেড়েছে।
গত ১০ অর্থবছরে ডিম ও দুধ উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। মাংস উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি, যা এখন বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ কোটি। তবে বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে উৎপাদন বাড়ার সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ভোক্তারা।-প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর
আবার কেউ বলছেন, সরবরাহ কমার সুযোগে অনেকে কমিশন বাড়িয়ে নিচ্ছেন। কোম্পানিগুলোও চড়া দামে ডিম বিক্রি করছে। বাংলাদেশ এগ প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, সরবরাহ কমার পাশাপাশি চাহিদাও একটু বেড়েছে। আর পাইকারেরা কমিশন বাড়িয়ে রাখায় ডিমের দাম বেশি পড়ছে।
দেশের মানুষ অনেক দিন ধরেই প্রতি পিস ডিম ১০ টাকায় কিনে অভ্যস্ত ছিল। তবে গত তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে ডিমের দাম। এ ভোগ্যপণ্যটির বাজার হয়ে উঠেছে অস্থির। বর্তমানেও বিক্রি হচ্ছে সবোর্চ্চ দামে। দেশে এর আগে কখনো এত দামে মানুষকে ডিম কিনতে হয়নি বলে জানিয়েছেন খামারি ও ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, ২০০৯ ও ২০১০ সালে ডিমের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল। কারণ ছিল বার্ড ফ্লু। তখন এ রোগের কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যায়। তাতে বড় ধরনের সরবরাহ সংকট তৈরি হয়। কিন্তু তখনো দাম এতোটা বাড়েনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে মুরগির ডিমের হালির গড় দাম ছিল ২৭ টাকার আশপাশে।
গত দুই বছর ডিমের দাম যখন রেকর্ড স্পর্শ করে, তখন অবশ্য বাজারে পোলট্রি খাদ্যের দামও বেশি ছিল। এখন খাদ্যের দাম কিছুটা কমলেও ডিমের দাম কমেনি। বরং ব্যবসায়ীদের একটি অংশ পোলট্রি খাদ্যের চড়া দামকেই বাজারে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। তবে ডিম কিংবা মুরগির দাম বারবার ওঠানামার কারণ হিসেবে অনেকে বাজার সিন্ডিকেট ও করপোরেট ব্যবসায়ীদের দায়ী করে থাকেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ১০ অর্থবছরে ডিম ও দুধ উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এসময়ে মাংস উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি, যা এখন বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ কোটি। তবে বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে উৎপাদন বাড়ার সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ভোক্তারা।
হুটহাট দাম বাড়ার জন্য বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকির অভাব, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট এবং সরবরাহে অব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ বারবারই ঘুরেফিরে সামনে আসছে। এ নিয়ে ভোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও খামারিরা সরকারের যথাযথ হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে করেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।