বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : জলবায়ু সংকট বিবেচনায় বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহিত করতে বিশ্বজুড়ে নানা উদ্যোগ ও কর্মসূচি দেখা যায়। এই প্রচেষ্টায় সিলিকন ভ্যালির প্রয়াস অনেক বেশি।
সিলিকন ভ্যালি বিশ্ববাসীকে বিশ্বাস করাতে চায় যে, প্রযুক্তি আমাদের শহরগুলোতে এবং আমাদের চলার পথে বিপ্লব ঘটাবে। ‘অটোপাইলট মোড’ সম্বলিত যানবাহন আমাদের নিরাপদ, সবুজ এবং আরও দক্ষ করে তুলবে। উবার এবং লিফটের মতো অন-ডিমান্ড পরিষেবাগুলো গাড়ির ব্যবসা বাদ দেবে। বৈদ্যুতিক স্কুটারের মতো স্বল্পপাল্লার যানগুলো প্রতিটি বাসাবাড়ির কোণায় পড়ে থাকবে। কেননা পণ্য এবং পরিষেবা সরবরাহ করবে ড্রোন।
একই সঙ্গে ইলন মাস্কের মতো স্বপ্নদর্শীরা প্রতিশ্রুতি দেন দুনিয়া থেকে যানজট উধাও করে দেবেন। আর সেই লক্ষ্যে উবারের মতো প্রতিষ্ঠান উড়ন্ত গাড়ি আনার উদ্যোগ নেয়।
তবে তাদের এই প্রচেষ্টায় বর্তমান সমাজের জন্য ততটা ফলপ্রসু নয় বলে জানিয়েছেন কানাডার প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিক ও লেখক প্যারিস মার্কস। তিনি তার ‘রোড টু নোহোয়ার’ বইতে ভবিষ্যতের প্রযুক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ও এ সংক্রান্ত সমস্যাগুলোকে তুলে ধরেছেন।
বইটিতে তিনি বলেছেন, আমরা নিজেদেরকে প্রযুক্তিগত কল্পনার দ্বারা ক্রমাগত বিভ্রান্ত হতে দিতে পারি না। আমরা যদি জনকল্যাণমূলক শহর ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, তাহলে যারা সামাজিক সমস্যাগুলোর শুধু প্রযুক্তিগত সমাধানের প্রস্তাব দেয়, তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করা উচিত।
প্যারিস মার্কসের মতে, পরিবহন ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটাতে হলে দরিদ্র, প্রান্তিক, এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের চাহিদাও বিবেচনা করতে হবে। শুধু অভিজাত শ্রেণিকে নিয়ে ভাবলে চলবে না। কেননা, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলো জনসাধারণের সেবার জন্য হয়ে থাকে, শুধু একটি বিশেষ শ্রেণির জন্য নয়।
প্যারিস মার্কস তার এক নিবন্ধে বলেছেন, বৈদ্যুতিক গাড়ি ভবিষ্যত পরিবহন ব্যবস্থায় বিপ্লব আনতে বাজিমাত করবে বলে মনে হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছিল- এটি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলবে। কিন্তু এই বৈদ্যুতিক-যানের প্রচলন কিছু গুরুতর প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।
এটা সত্য যে, এখনও বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারে মোটামুটি বিক্রি হচ্ছে। তবে সেই বাজার ইতোমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হারে পড়তে শুরু করেছে। বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা আর আগের অবস্থায় নেই। শো-রুমগুলোতে পড়ে আছে অবিক্রিত অনেক বৈদ্যুতিক গাড়ি। ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করতে দাম কমানো হয়েছে। বিনিয়োগকারীরাও পিছু হটতে শুরু করেছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ড তাদের পরিকল্পিত বিনিয়োগের ৫০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১২ বিলিয়ন বিলম্বিত করেছে।
ওদিকে জেনারেল মোটরস প্রধান মডেলগুলোর উৎপাদনে বিলম্বিত করছে। আর হোন্ডা সস্তা বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির প্রতিশ্রুত ৫ বিলিয়ন ডলারের অংশীদারিত্ব বাতিল করেছে। এমনকি ইলন মাস্কের টেসলা- যা বৈদ্যুতিক গাড়ির জগতে সুপারস্টার হিসেবে পরিচিত- ঘোষণা করেছে যে, কোম্পানিটি মেক্সিকোতে পরিকল্পিত কারখানা নির্মাণে বিলম্বিত করবে। অটো এক্সিক্স, যারা একসময় বৈদ্যুতিক গাড়ির সম্ভাব্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছিল, তারাও প্রকাশ্যে স্বীকার করছে যে, বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রকল্প আর কাজ করছে না।
বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে ধসের পিছনে কিছু কারণ তুলে ধরেছেন শিল্প বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অপর্যাপ্ত চার্জিং পরিকাঠামো এবং সাশ্রয়ী মূল্যের বৈদ্যুতিক গাড়ির অভাব।
তাদের মতে, আমেরিকার বৈদ্যুতিক গাড়ির পরিকল্পনা শুরু থেকেই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। আমেরিকা বৈদ্যুতিক গাড়িকে আরও টেকসই পরিবহন পরিকল্পনা হিসেবে দেখার পরিবর্তে, দেশটি এটিকে জ্বালানি-চালিত যানের প্রতিস্থাপন হিসেবে বিবেচনা করেছে। কিন্তু এই সামান্য পরিসরের প্রচেষ্টা আমাদের বৃহত্তর পরিবহন সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্য তো বর্থ হয়েছেই, সেই সঙ্গে পরিবহন জগতের অন্য বড় বড় সমস্যাগুলো আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
প্যারিস মার্কস বলেন, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণাটি (মিথ) হল- পরিবেশ রক্ষায় ব্যাটারি চালিত গাড়ি জ্বালানি চালিত গাড়ির একটি বিকল্প ও সঠিক পদক্ষেপ। এ বিষয়ে ‘লুডিক্রাস: দ্য আনভার্নিশড স্টোরি অব টেসলা মোটরস’ এর লেখক এডওয়ার্ড নিডারমেয়ার আমাকে বলেছিলেন, “এটা কখনও নয়। এবং এটাই হল সবচেয়ে বড় সমস্যা।”
যখন গ্রাহকরা বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনে, তখন তারা এমন গাড়ির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যেগুলো ইতোমধ্যেই জনপ্রিয় হয়েছে— এর অর্থ হল বড় বৈদ্যুতিক গাড়ি যেমন- SUV এবং ট্রাকের জোয়ার। কিন্তু এই বড় আকারের বৈদ্যুতিক গাড়িগুলোর তেমন কোনও সুফল পাওয়া যায় না। কেননা, এগুলোর জন্য বড় বড় অনেক ব্যাটারির প্রয়োজন হয়, যেগুলি তৈরি করতে প্রয়োজন হয় অনেক কাঁচামালের। এ জন্য উৎপাদকদের পরিবেশগতভাবে ধ্বংসাত্মক খনির কার্যক্রম বাড়াতে হয়। যদিও বড় ব্যাটারিগুলো চালকদের কিছুটা দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার সুযোগ দেয়, কিন্তু এটি গাড়ির ওজন বাড়ায়, যা এটিকে আরও বিপজ্জনক, ব্যয়বহুল এবং এই গ্রহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল যে, ব্যাটারি অনেক বেশি হলেও জ্বালানির গাড়ির প্রতিস্থাপন হিসেবে এটি কাজ করে না। নিডারমেয়ার বলেন, বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হল এটি রিচার্জ করার প্রয়োজন হয়। ফলে দূরপাল্লার ট্রিপের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় সমস্যা। জ্বালানির গাড়িগুলো যেকোনও জায়গায় প্রয়োজনীয় জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারে, কিন্তু ইভি তথা বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। ফলে আমেরিকানরা এই গাড়ির ব্যবহার দিন দিন কমিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইভি ব্যবহারকারী ৭৩ শতাংশ মার্কিনি এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।
ফলে নানা কারণে এখন এই বৈদ্যুতিক গাড়ির খাত উৎপাদক ও সরবরাহকারীদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেড়ে গেছে দেউলিয়াত্বের ঝুঁকি। কারণ ইভি তৈরির সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিনিয়োগ ইভির চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে উৎপাদন হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এর সঙ্গে প্রাথমিক পাবলিক প্রস্তাব বাতিল ও বৈশ্বিক মন্দা সেই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সূত্র: রয়টার্স, বিজনেস ইনসাইডার, ভারসোবুকস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।