সাইফুল ইসলাম : জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপি’র প্রকল্পে ভূয়া প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি চক্র। চক্রটি ইতোমধ্যে চার কিস্তিতে টাকা তুলে নিয়েছে। এই চক্রের প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তিনি ‘কুলিং পয়েন্ট’ নামে একটি কোম্পানির মালিক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশে ওজোনস্তরের ক্ষতি ঠেকাতে মন্ট্রিল প্রোটোকলের আওতায় একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প পরিচালনা করে ইউএনডিপি। প্রকল্পের নাম ‘এইচপিএমপি প্রজেক্ট ২’। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চলে প্রকল্পের কার্যক্রম। এর আওতায় ওজোনস্তরের সুরক্ষা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও বিকল্প পদার্থ ব্যবহারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের পাঁটটি রেফ্রিজারেটর ও একটি চিলার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ৩ দফায় ৬টি অর্থ সহায়তা বা ভর্তুকি দেয়া হয়। প্রকল্পে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ফ্যাক্টরিতে ওজোনস্তরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ‘হাইড্রোক্লোরোফ্লুরোকার্বন’ (এইচসিএফসি) এর ব্যবহার নির্দিষ্ট ধাপে ধাপে শূন্যে নামিয়ে আনার শর্ত দেয়া হয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন ও ইউএনডিপি যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে।
জানা যায়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মোট ছয়টি কোম্পানিকে ইউএনডিপির ‘এইচপিএমপি প্রজেক্ট ২’র আওতাভুক্ত করা হয়। কোম্পানিগুলো লো-ইউনিটেক প্রোডাক্টস (বিডি) লিমিটেড, এলিট হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এসি বাজার ইন্ডাস্ট্রি, সুপ্রিম এয়ার কন্ডিশনার, ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও কুলিং পয়েন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস। এই ছয়টি কোম্পানির সঙ্গে ইউএনডিপির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। এক্ষেত্রে পাঁচটি এয়ার কন্ডিশনার উৎপাদনকারী ও একটি চিলার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে আলাদাভাবে শর্তারোপ করা হয়।
এর মধ্যে পাঁচটি এয়ার কন্ডিশনার উৎপাদনকারী কোম্পানী এসির গ্যাস আর-২২ এর পরিবর্তে আর-৪১০এ’র উৎপাদন এবং আর-২২ বন্ধ করে আর-৩২ এ রূপান্তর ও চিলার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে লো-জিডব্লিউপি এর বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব আর-৩২ এর রূপান্তর করার শর্ত দেয়া হয়।
জানা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় ভর্তুকির সুবিধা নেয় ‘কুলিং পয়েন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস’ নামের প্রতিষ্ঠানটি। এই কোম্পানিকে ২ লাখ ডলার অনুদান দেয় ইউএনডিপি। কোম্পানির তথ্যে নিজেদেরকে চিল উৎপানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, ১৯৯৪ সালে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটি ২০০২ সালে উৎপাদন শুরু করে। কোম্পানির জনবল দেখানো হয় ১১৫ জন। তবে এসব শুধু কাগুজে। বাস্তবে এই কোম্পানির কোন অস্তিত্ব নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকল্পের ভর্তুকি পেতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি ঠিকানাকে হেড অফিস হিসেবে উল্লেখ করে ‘কুলিং পয়েন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস’ নামে কোম্পানির মালিক আসাদুজ্জামান। তিনি সেখানে ফ্যাক্টরির কোনও ঠিকানা উল্লেখ করেননি। তবে মোহাম্মদপুরের ঠিকানায় এই কোম্পানির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার খাসেরচর এলাকায় ‘কুলিং পয়েন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস’ নামের সাইনবোর্ড দেখা যায়। সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মজনু মিয়া জানান, ৫-৬ বছর আগে ১৮ শতক জমি কিনে আসাদুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি। বলা হয়, বিদেশি অর্থে এখানে একটি কারখানা করা হবে। এরপর বছর দুই আগে একটি টিনশেড ঘর, দুটি আধাপাকা ঘর নির্মাণ করা হয়। মজনু মিয়ার ছেলে ইদ্রস মিয়া শুরু থেকেই নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। গত বছরের ৩ আগস্ট সে সৌদি আরব গেলে মজনু মিয়া নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। তাকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়।
মজনু মিয়া এই প্রতিবেদককে ভিতরে নিয়ে গেলে দেখা যায়, আধাপাকা ঘরের একটিতে ধান শোকানো হচ্ছে আর অন্য ঘরটিতে মুরগী পালন করা হচ্ছে। টিনশেডের ঘর পুরোটাই ফাঁকা। শুধু একটি ক্যাবল রোল আর ছোট একটি মেশিন রয়েছে। তবে এটি এখানো চালু হয়নি। মজনু মিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ছয় মাস অন্তর ফ্যাক্টরির মালিক আসাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী একবার এসে দেখে যান।
‘কুলিং পয়েন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস’ নামের কোম্পানির বিষয়ে জানতে চাইলে কল-কারখানা অধিদপ্তরের মানিকগঞ্জ কার্যালয়ের উপ-মহাপরিদর্শক মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, মানিকগঞ্জ জেলায় কোন ফ্যাক্টরি হলে বা ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন শুরু হলে আমাদের কাছে তথ্য থাকে। আমরা আইন অনুযায়ী পরিদর্শন করে কারখানার পরিবেশ ও শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় কাজ করি। তবে ‘কুলিং পয়েন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস’ নামে কোন কোম্পানি আমাদের কাছে আবেদন করেনি। মানিকগঞ্জে এরকম কোন কোম্পানির অস্তিত্ব আছে বলে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই।
টাকা উত্তোলনের কথা স্বীকার করে মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, কিছু টাকা উত্তোলন করেছি। তবে নানা জটিলতায় এখনো উৎপাদনে যেতে পারিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ইলিয়াস মাহমুদ বলেন, প্রজেক্টের জন্য ইউএনডিপির দেয়া অনুদান থেকে এখন পর্যন্ত ৪ কিস্তিতে টাকা নিয়েছেন আসাদুজ্জামান।
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, পুরো টাকাটাই ছিল অনুদানের। ইউএনডিপির মাধ্যমে কুলিং পয়েন্টের চিলার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের জন্য এই অনুদানের টাকা দেয়া হয়েছিল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।