বিজ্ঞানীরা ইরোসিটা এক্সরে টেলিস্কোপের সাহায্যে তৈরি করেছেন দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সবচেয়ে বিস্তারিত চিত্র। এই ছবিতে ধরা পড়েছে ৯ লাখের বেশি মহাজাগতিক বস্তু। পাওয়া গেছে রহস্যময় গ্যাসসেতু। মহাকাশের সবচেয়ে বিস্তারিত এক্সরে মানচিত্র প্রকাশ করেছেন জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটির জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। সে জন্য বিপুল ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছে ইরোসিটা (eROSITA) এক্সরে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে। এ মানচিত্রে স্থান পেয়েছে ৭ লাখের বেশি অতি ভারী কৃষ্ণগহ্বর এবং গভীর মহাকাশের লাখো ‘এক্সোটিক’ বা দুর্দান্ত বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু। সঙ্গে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে দেখা গেছে অদ্ভুত রহস্যময় গ্যাসসেতু।
‘ইরোসিটা অল স্কাই সার্ভে’ নামের এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ সময় গবেষকেরা আকাশে ১৭০ মিলিয়ন বা ১৭ কোটির বেশি উচ্চশক্তির ফোটন কণা—যেগুলো আসলে এক্স-রশ্মির ফোটন—শনাক্ত করেন। পরে এ থেকে থেকে দূর মহাকাশের প্রায় ৯ লাখ বস্তু চিহ্নিত করেন তাঁরা। এমনটাই জানানো হয় গবেষকদের দেওয়া এক বিবৃতিতে।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক এবং এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক আন্দ্রেয়া মার্লোনি বলেন, ‘এক্সরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য সংখ্যাটা অনেক বড়। (ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখলে দেখবেন) ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ইসার এক্সএমএম-নিউটন বা যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসার চন্দ্র-এর মতো বড় প্রকল্পে এ পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে প্রায় ২৫ বছর সময় লেগে গিয়েছিল। (অর্থাৎ) আমরা ৬ মাসে এত বেশি এক্স রশ্মির উৎস শনাক্ত করেছি যে একে অবিশ্বাস্য বলা চলে।’
এক্সরে একধরনের উচ্চশক্তির বিকিরণ। এটি আর কিছুই নয়, তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গেরই ভিন্নরূপ। তবে আলোর চেয়ে এর কম্পাংক ও শক্তি অনেক বেশি। তাই খালি চোখে আমরা দেখতে পাই না। মহাকাশের বেশির ভাগ এক্সরে বিকিরণ তৈরি হয় অতি উত্তপ্ত গ্যাস থেকে। এ ছাড়া, অতি ভারী গ্যালাক্সিপুঞ্জ থেকেও এগুলো তৈরি হতে পারে।
পাশাপাশি সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর তৈরি অবশেষ-কাঠামো (যেমন বিখ্যাত ক্র্যাব নেবুলা) কিংবা সক্রিয় ব্ল্যাকহোলের উজ্জ্বল ইভেন্ট হরাইজন থেকে বিকিরিত হতে পারে মহাজাগতিক এক্স-রশ্মি। মহাকাশের এক্সরে বিকিরণ যে কেবল উচ্চশক্তির বস্তুগুলোর সন্ধান দেয়, তা নয়। পাশাপাশি মহাকাশের কাঠামোও ফুটে ওঠে এগুলোর কল্যাণে।
এ প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো, কয়েকটি গ্যালাক্সির মধ্যে ৪২ মিলিয়ন বা ৪ কোটি ২০ লাখ আলোকবর্ষেরও বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাসসেতু। ইংরেজিতে বলা হচ্ছে ‘ব্রিজ অব গ্যাসেস’। তুলনাটা ভালোভাবে হয়তো বোঝা যাচ্ছে না এটুকু শুনে। তাহলে বলি, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির এ মাথা ও মাথার দৈর্ঘ্য (ব্যাস) প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ। সে তুলনায় এই গ্যাসসেতু বা সংযোগ সেতু মিল্কিওয়ের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ বড়।
গ্যাসের এই সংযোগ সেতুকে মহাজাগতিক জালের অংশ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। মহাকাশের এই মহাসড়ক তার আশপাশের সব গ্যালাক্সিকেই কিছু না কিছু দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অর্থাৎ গ্যালাক্সিগুলোর গ্রহ-নক্ষত্র ব্যবস্থা তৈরিতে কাজে লাগছে এই গ্যাস। পাশাপাশি মহাকাশের সত্যিকারের শূন্যতা বা ভয়েড অঞ্চলের অবস্থানও জানান দিচ্ছে এটি স্পষ্টভাবে। এই মহা-শূন্যস্থানগুলো মূলত ডার্ক ম্যাটারের আস্তানা বলে ধারণা করা হয়। যদিও বিষয়টি এখনও প্রমাণিত নয়। ডার্ক ম্যাটার আজও আমাদের কাছে অজানা, অধরা।
সবশেষ তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে ফলাফল প্রকাশের পাশাপাশি এ প্রকল্পের গবেষকেরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে ৫০টিরও বেশি গবেষণাপত্র জমা দিয়েছেন। এসব গবেষণাপত্র অবশ্য টেলিস্কোপটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সামান্য অংশ নিয়েই আলোচনা করে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, নতুন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আরও নতুন গবেষণাপত্র যোগ হচ্ছে নিয়মিতই। সামনে এরকম আরও অনেক গবেষণাপত্র পাওয়া যাবে। পাশাপাশি থাকছে নতুন আরও গবেষণার সুযোগ। আর সবশেষের তথ্যগুলো না বলে, সম্পূর্ণ প্রকল্পটির কথা যদি বলি, তবে ইতিমধ্যেই এ প্রকল্পের তথ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে দুইশর বেশি গবেষণাপত্র।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।