বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : ইন্টারনেটে হ্যাকিং করে কোটিপতি বনে গেছেন ফরিদপুরের শাওন। তিন বছরে আয় করেছেন তিন কোটি টাকার মতো। হ্যাকিংয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখে পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারও। এখন হ্যাকিং-ই পেশা এই ফ্রি ল্যান্সারের। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে দেখছেন নানা সম্ভাবনাও।
তবে গতানুগতিক হ্যাকিং বলতে যা বোঝায় এর সাথে তার মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সাধারণত হ্যাকারেরা যেভাবে অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা পেজ হ্যাক করে ক্ষতি করে থাকে শাওন বরং তার উল্টো।
তার কাজ হলো বড় বড় কোম্পানির সাথে কাজ করে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তাদের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করা। মূলত: সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করাই কাজ এই হোয়াইট হ্যাকারের। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তথ্য প্রযুক্তি খাতে তার হাতেখড়ি থেকে প্রতিষ্ঠা লাভের আদ্যোপান্ত তিনি জানিয়েছেন।
শাওন মীরের বাড়ি ফরিদপুর জেলা সদরের জ্ঞানদিয়া এলাকায়। এসএসসি পাস করে ভর্তি হন রাজবাড়ী টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখান থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে গ্রিন ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসিতে করছেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে শাওন বড়। বাবা প্রবাসে থাকেন।
প্রথমেই জেনে নেয়া দরকার এথিক্যাল হ্যাকার কী?
হ্যাকার মানেই যে খারাপ কিছু নয়, সেটিই বলছে এই ইথিক্যাল হ্যাকার। এরা মূলত সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিতে করতে কাজ করেন। কোনো ওয়েবসাইট হ্যাক হলে উদ্ধারে সহায়তা করেন। হ্যাক হয়ে যাওয়া ওয়েব সার্ভারকে ম্যালওয়ার ফ্রি করার কাজ করেন পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য। একইসাথে ডিজিটিল ফরেনসিক, ডাটা রিকভারি, সোশ্যাল মিডিয়া রিকভারি, নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি বা ডিভাইস সিকিউরিটির কাজও করেন তারা।
শাওনের মতে, সারাবিশ্ব এখন প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তাই ফ্রি ল্যান্সিংয়ের খাতে বড় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে কেউ যদি শুধু টাকা উপার্জনের জন্য এই সেক্টরে আসতে চান তাহলে টিকে থাকা কষ্ট হবে। আগে নিজের স্কিল বাড়াতে হবে। আর ফ্রিল্যান্সিংমার্কেটে ইথিক্যাল হ্যাকারের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।
তিনি বলেন, এথিক্যাল হ্যাকার হলে স্বল্পসময়ে অধিক আয় করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতা নেই। প্রোগ্রামিং লাঙ্গুয়েজ যেমন, পাইথন, ব্যাশ (স্ক্রিপিং ল্যাঙ্গুয়েজ), গো, জাভাস্ক্রিপ্ট ইত্যাদি শেখা থাকলে কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই লাখপতি হয়ে যাব, এমন চিন্তা করা যাবে না। সাইবার সিকিউরিটির আওতায় বাগ হান্টিং করেও আয় করার সুযোগ আছে।
যেভাবে শুরু
২০১৭ সালের এক বন্ধু শাওনের ফেসবুক আইডি হ্যাক করেন। এরপর ইইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে তিনি হ্যাকিং সম্পর্কে জানতে পারেন। হ্যাকিং মানেই যে খারাপ কিছু নয়, সেটিও জানেন। তখন’ই-শিখন ডটকম’-এ এথিক্যাল হ্যাকিং বিষয়ে কোর্স সম্পন্ন করেন। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর ডিপ্লোমা থাকায় ওয়েব ডিজাইন, ডেভেলপমেন্ট, ভাটাবেজ, এলগরিদম এমন আরো বেশ কিছু জানা ছিল তার।
তবে যেকাজ করে তার অভাবনীয় উপার্জন সেই এথিক্যাল হ্যাকিং শিখতে তাকে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে শুরুর দিকে। শুরুর দিকে কয়েকবার মার্কেট প্লেসে অ্যাকাউন্ট রেস্ট্রিকটেড হয়েছে। টেম্পোরারি সাসপেনশনও হয়েছে অনেকবার।
তবু তিনি হাল ছেড়ে দেননি। লেগে থেকে নিজেকে তৈরি করেছেন।
শাওন বলেন,‘ আমি সবসময় শেখার চেষ্টা করেছি। কখনো ভাবিনি আমি সব জানি। সময় দিয়েছি প্রচুর, যখন সেটা করেছি মন দিয়ে করেছি। অনেক কিছু শিখলেও হ্যাকিংটা নিয়েই বেশি সময় গড়ে থাকতাম।’
জীবনে প্রথম ফ্রিল্যান্সিং করে শাওনের প্রথম কাজ ছিল ডাটা রিকভার করা। সেই কাজ করে প্রথম আয় করেন ৩০ ডলার। এরপর একটি বড় কোম্পানির ওয়েবসাইটের দুর্বলতা ধরিয়ে দিয়ে পান ৫০ হাজার ডলার। এটিই তার সবচেয়ে বড় আয় একটি কাজ করে। আবার ইউএসএর এক চিকিৎসকের ব্যক্তিগত কিছু নুড ছবি পাবলিক করে দেয়ার পরে তার দ্বায়িত্ব দেয়া হয় ওই পাবলিশারকে খুঁজে বের করে সেসব ছবি রিমুভ করা। এই কাজ করে তার চুক্তির এক হাজার ডলার দেয়ার পরেও তাকে ৬০০ ডলার বোনাস দিয়েছিল। এটি তার বড় একটি স্যাটিসফেকশনের কাজ ছিল। আবার একজন ক্লায়েন্ট কাজ করার পরে টাকা রিফান্ড করতে বলেছিল। সেই টাকা ফেরতও দিয়েছিলেন। এটি তার একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা।
সাধারণত কাজের ধরণের ওপর নির্ভর করে কতো টাকা দিতে হবে তাকে। ফাইবারে তিনি ‘এ লেভেল সেলার’। ২০২০ সালে শাওন মার্কেট প্লেসে অ্যাকাউন্ট খোলেন। গত তিনবছরে ফ্রিল্যান্সিং করে তিনি উপার্জন করেছেন প্রায় তিন লাখ ডলার। যা বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় তিন কোটি টাকা।
কীভারে কাজ পান জানতে চাইলে শাওন বলেন, ‘আমি মূলত দু’ভাবে কাজ পেয়ে থাকি। প্রথমত, ক্লায়েন্টের করা জব পোস্টে প্রপোজাল সাবমিট করে এবং দ্বিতীয়ত ক্লায়েন্ট নিজেই তার জবে ইনভাইইট করে থাকে। ইউরোপ, আমেরিকাতেই তার ক্লায়েন্ট সবচেয়ে বেশি বলে জানান। শাওন কোর্সও করান নিজের কাজের পাশাপাশি শাওন এখন অনলাইন কোর্সও করাচ্ছেন। ফেসবুকে Shawon Mir পেজে গেলে কোর্সের বৃত্তান্ত জানা যাবে।
শাওন বলেন, ফ্রিলান্সিংয়ে যোগাযোগ দক্ষতা অতি মূল্যবান। অথচ শাওন নিজেই ভালো ইংরেজি জানতেন না। ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য ইংরেজি ভোকাবুলারি মুখস্ত করার পাশাপাশি ইংলিশ সাব টাইটেল মুভি দেখেছেন। অনেক সময় গুগল ট্রান্সলেশনের শরণাপন্ন হন।
প্রতিদিন নতুন নতুন হুমকি এবং চ্যালেঞ্জের সাথে বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হয়ে উঠেছে সাইবার নিরাপত্তা। এথিক্যাল হ্যাকার বা সাইবার সিকিউরিটিদের ভবিষ্যৎ অনেক সম্ভাবনাময়। তবে এই খাতে জনবলের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। ইউএস ব্যুরো অফ লেবার স্ট্যাটিস্টিক্সের মতে, তথ্য সুরক্ষা বিশ্লেষকদের চাকরির বাজার ২০২৮ সালের মধ্যে ৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এটি দ্রুত বর্ধনশীল চাকরির ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি। সাইবার সিকিউরিটি ভেঞ্চারস অনুসন্ধানে পেয়েছে যে ২০৩১ সালে এই খাতে ৩৫ লাখ চাকরি থাকবে। এর মানে হল যে সাইবার নিরাপত্তায় পেশাদারীরা চাকরির বাজারে বিশ্বজুড়ে চাহিদার শীর্ষে রয়েছে। আগামী বছরগুলোতেও তা বজায় থাকবে।
বাংলাদেশে এথিক্যাল হ্যাকার তৈরি হলে একদিকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে, অন্যদিকে সাইবার যুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে মনে করেন শাওন। ভবিষ্যতে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে আরো দক্ষতা অর্জন করতে চান। একইসাথে এই খাতেপ্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।