লাইফস্টাইল ডেস্ক : হিটওয়েভের সঙ্গে মনেরও আছে গভীর সংযোগ। এই সংক্রান্ত কিছু জরুরি প্রশ্ন আর সেগুলোর উত্তর জেনে নিলে অতি তাপে আর মন পুড়বে না। লিখেছেন মনোবিজ্ঞানী জাহিদ হাসান।
মনোবিজ্ঞানী হওয়ার সুবাদে প্রতিদিন যে কাজটি নিয়ম করে করি, তা হলো নিজেকে বা অন্যকে ‘কেন’ দিয়ে প্রশ্ন করা। এমন কয়েকটি ‘কেন’র উত্তর হিটওয়েভ পরিস্থিতিতে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করা যাক। তাহলে নিজেকে দিয়ে শুরু করি।
দুই দিন আগে গেলাম চুল ছোট করতে। যাওয়ার সময় নিজেকে প্রশ্ন করলাম, ‘ঈদে চুল ছোট করেছি, তবু কেন ঈদ যেতে না যেতেই চুল ছোট করতে আসছি?’ তখন উত্তরটি ছিল, ‘গরম অনেক বেশি, চুল ছোট করলে আরাম পাওয়া যাবে।’ পরদিন অফিসে যাওয়ার সময় দেখলাম, একজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে পথচারীর বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে। তখন দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীকে প্রশ্ন করলাম, কেন এই বাগ্বিতণ্ডা? প্রত্যুত্তরে পথচারী বললেন, গরমে মেজাজ খারাপ তো তাই। আরেক দিন দেখলাম, স্কুল ছুটির পর সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থাকা একজন মা তাঁর গাড়িচালককে গাড়ির তাপানুকূলের অবস্থা ভালো নয় কেন, তাই বকুনি দিচ্ছেন। রান্নাঘরে রান্না করতে গিয়ে বাইরের গরম ও চুলার গরমে একাকার হয়ে একজন মা সন্তানদের সঙ্গে রাগারাগি করছেন।
এই বিষয়গুলোর যদি সারাংশ করি, তাহলে দাঁড়ায়, আমাদের মন ও আচরণ গরমের কাছে হার মেনে অস্বাভাবিক রূপ লাভ করেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গরমে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি থেকে শুরু করে পায়ে ফরমাল জুতার জায়গায় চটি জুতা পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা আমাদের বাজে আচরণ পরিবর্তনে কি মানসিকভাবে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি?
চলুন আগে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা যাক। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দাবদাহ, দাবানল ও আবহাওয়া-সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনাগুলোর পরিমাণ ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তীব্র গরম ও আর্দ্রতা মোটামুটি সবার কাছেই অস্বস্তিকর। তবে গবেষণা বলছে, এ ধরনের পরিস্থিতি শুধু শারীরিক নয় মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর হতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাবও দিন দিন বাড়ছে। অত্যধিক তাপমাত্রা মন ও মেজাজকে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি এর কারণে গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও হতে পারে।
তাপমাত্রার সঙ্গে শরীর ও মনের সম্পর্ক কী
ডালাসের ইউটি সাউথওয়েস্টার্ন মেডিকেল সেন্টারের ক্লিনিক্যাল নিউরোসাইকোলজিস্ট সি মুনরো কুলাম বলেন, তাপের কারণে সৃষ্ট অস্বস্তি এবং শরীর ঠান্ডা হতে যে শক্তি খরচ হয়, তা সামগ্রিক সহনশীলতা কমিয়ে দিতে পারে। তাই উত্তেজনা, জ্বালা ও ব্যথা কম সহনীয় হয়ে উঠতে শুরু করে তখন।
ড. নরি-সারমা বলেন, বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে তাপ ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে যোগসূত্রটি এতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ যে তা ইঙ্গিত দেয়, তাপ মস্তিষ্কে কিছু না কিছু করছে।
জসুয়া ওয়ার্টজেল বলেন, নিউরোট্রান্সমিটার মারফত সেরোটনিন নামের একটি হরমোন মানুষের মেজাজ-মর্জির নিয়ন্ত্রণ করে। তাপমাত্রার বৃদ্ধি প্রভাবিত করে এই হরমোনকে।
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ বিভাগের মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ শাবাব ওয়াহিদ বলেছেন, তাপ ও মানসিক অসুস্থতার মধ্যে সম্পর্কটি খুবই সূক্ষ্ম। ওয়াহিদ সম্প্রতি ‘দ্য ল্যানসেট প্ল্যানেটরি হেলথ’-এ একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন তাপমাত্রার এক ডিগ্রি বৃদ্ধিও বিষণ্নতা ও উদ্বেগের মতো অনুভূতি তৈরিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
কিছু গবেষক অনুমান করছেন, তাপ মস্তিষ্কের সংকেত আদান-প্রদানে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া তাপ মস্তিষ্কে প্রদাহের কারণও হতে পারে। কিন্তু আরেকটি বিশেষ তত্ত্ব হলো, তাপ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, ফলে মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো আরও প্রকট হয়।
অতি তাপমাত্রায় মানসিক যে সমস্যাগুলো তৈরি হতে পারে
ঘুমের ব্যাঘাত
গরমে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে যেমন অনিদ্রার সমস্যা। খারাপ ঘুম স্ট্রেস, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বাড়িয়ে তুলতে পারে, যাতে মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে যেতে পারে।
পানিশূন্যতা
উচ্চ তাপমাত্রা ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকি বাড়ায়, যা নেতিবাচকভাবে মেজাজ ও চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি হালকা ডিহাইড্রেশন মেজাজ ও সামগ্রিক চেতনাকে প্রভাবিত করে কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে।
তাপের চাপ
গরম তাপমাত্রার সংস্পর্শে শরীরে শারীরবৃত্তীয় চাপের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, যার মধ্যে হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি, ঘাম ও অস্বস্তি দেখা যায়। বেশি তাপের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে বিরক্তি, ক্লান্তি ও সামগ্রিক মেজাজ নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটে পারে।
আক্রমণাত্মক আচরণ
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গরম আবহাওয়া, বর্ধিত আগ্রাসন ও হিংসাত্মক আচরণের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। উচ্চ তাপমাত্রা হতাশার অনুভূতি বাড়িয়ে তুলতে পারে, ফলে সংঘর্ষ ও আগ্রাসনের উচ্চ আশঙ্কা থাকে।
সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার
সাধারণত দেখা যায়, কিছু মানুষ শীতকালের তুলনায় গরমকালে ঋতুগত সংবেদনশীল ব্যাধিতে বেশি আক্রান্ত হয়। অতিরিক্ত তাপে অস্বস্তি, শারীরবৃত্তীয় চাপ, হতাশা, অলসতা ও সামগ্রিকভাবে মনমেজাজে খিটখিটে ভাব বেশি অনুভূত হয়।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
আবহাওয়ায় তাপমাত্রা বেশি থাকলে মানুষের বাইরের কাজকর্ম ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া কমিয়ে দেয়। ফলে ব্যক্তি একাকিত্ব ও বিষণ্নতায় ভুগতে পারে। ভালো মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য সামাজিক যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গরম আবহাওয়ার কারণে সামাজিকীকরণের সুযোগ কমে যায়, ফলে মনে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়।
জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতা
দেখা গিয়েছে, গরম তাপমাত্রা সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্মৃতিশক্তি, মনোযোগসহ জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতা নষ্ট করে। এই ঘাটতিগুলো হতাশা ও চাপের অনুভূতিকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
দুর্বলতা
কিছু ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গরম তাপমাত্রার নেতিবাচক প্রভাবগুলো বেশি দেখা যায় এবং তা ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা, বয়স এবং কিছু নির্দিষ্ট চিকিৎসায় সংবেদনশীল প্রভাব দেখা দেয়। এ জন্য ব্যক্তি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
আত্মহত্যার প্রবণতা
তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য অপরাধ ও সহিংসতার পাশাপাশি আত্মহত্যার হারও বেড়ে যায় বলে অনেক গবেষক দাবি করছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোতে গড় তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে আত্মহত্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্পর্ক আছে। এই দুই দেশে অন্তত ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধির সঙ্গে আত্মহত্যা ১ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে।
এই অতি তাপে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে যা করণীয়
বর্তমানে থাকুন
মানসিকভাবে যেকোনো পরিস্থিতিতে বর্তমান মুহূর্তে উপস্থিত থাকার চর্চা করুন। আপনার ইন্দ্রিয়ের ওপর ফোকাস করুন এবং আপনার শরীর গরমে কেমন অনুভব করছে, তা পরিবর্তন করার চেষ্টা না করে পর্যবেক্ষণ করুন।
ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন
নিজেকে আশ্বস্ত করতে ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন ব্যবহার করুন যে আপনি নিজেকে পরিচালনা করতে পারেন এবং শান্ত থাকতে পারেন। নিজেকে অতীতের অভিজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দিন, যেখানে আপনি অনুরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করেছিলেন।
গ্রহণযোগ্যতা
সবার আগে বর্তমান পরিস্থিতিকে মেনে নিন। নিজেকে বলুন, আপনি আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, তবে এ পরিস্থিতিতে আপনার প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। অস্বস্তিকর এই পরিস্থিতিকে একটি অস্থায়ী চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করুন, সেটা মোকাবিলা করুন। মনে করুন এবং বিশ্বাস করুন যে এই পরিস্থিতি কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে।
কল্পনা করুন
আপনি চোখ বন্ধ করে নিজেকে কোনো সমুদ্রসৈকত বা ছায়াময় আরামদায়ক জায়গায় কল্পনা করুন। ভিজ্যুয়ালাইজেশন আপনার মনকে উত্তাপ থেকে বিভ্রান্ত করে প্রশান্তির অনুভূতি তৈরি করতে সহায়তা করতে পারে।
নমনীয় থাকুন
বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেকে নমনীয় রাখুন। আপনার দৈনন্দিন রুটিন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে দিনের যে সময়টা তুলনামূলক কম গরম থাকে, সেই সময় বাইরে বের হওয়া ও বাকি কাজ করার চেষ্টা করুন।
সাহায্য কামনা করুন
আপনি কেমন অনুভব করছেন, সে সম্পর্কে বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলুন। কখনো কখনো আপনার উদ্বেগগুলো ভাগ করে নেওয়ায় চাপ কমাতে পারে এবং আপনাকে আরও সমর্থিত বোধ করতে সহায়তা করতে পারে।
এই পৃথিবীর আজকের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। আমরা বহুবছর ধরে একটু একটু করে নিজেরাই প্রকৃতির ওপর যে অত্যাচার করেছি, গাছপালা, বন ধ্বংস করেছি, নদী-নালা ভরাট করেছি, আজকে প্রকৃতি তারই প্রতিদান দিচ্ছে। এখনো যদি সবাই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে না আসি, আরও বড় বিপর্যয় আমদের জন্য অপেক্ষা করছে।
লেখক: মনোবিজ্ঞানী ও আর্ট থেরাপিস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।