লিটন মাহমুদ : ‘আসসালামু আলাইকুম, জাল টাকার ব্যবসা করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেন। টাকা ছাড়া মানুষের কোনো মূল্য নেই, যখন আপনার পকেটে টাকা থাকবে তখন সবাই আপনাকে সম্মান করবে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘জাল নোট সেল করি’ নামে একটি গ্রুপে এমনই একটি পোস্ট করা হয়েছে মো. উজ্জল হাওলাদার নামে আইডি থেকে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাধিক প্ল্যাটফর্মে জাল টাকা কেনাবেচার অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রুপ রয়েছে। ঈদ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাইবার নজরদারি বাড়ানোর কথা বললেও তাদের নজরের বাইরে রয়ে গেছে এসব অপরাধীচক্র।
চক্রগুলোর সঙ্গে ক্রেতা সেজে যোগাযোগ করে জানা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাল টাকা কেনাবেচার নানা কৌশল।
উজ্জল হাওলাদার নামে ফেসবুক আইডি থেকে দেওয়া পোস্টে বলা হয়, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২০২৪ সালের উন্নতমানের প্রিন্ট দ্বারা তৈরি করা এ গ্রেডের ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নতুন নোট তার স্টকে রয়েছে। সরাসরি দেখা করে বা কুরিয়ারের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে চাহিদামতো টাকা সংগ্রহ করা যাবে তার কাছ থেকে। তবে কুরিয়ারে নিতে চাইলে শর্ত মেনে এডভান্স পেমেন্ট করতে হবে।
শুধু উজ্জল হাওলাদারই নন, আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজ খুলে জাল টাকা বিক্রির অনলাইন বাজার চালু করেছেন এমন অনেকেই। এ-গ্রেড জাল নোট, টাকা চাই, জাল টাকার ডিলার, জাল টাকা বিক্রয়কেন্দ্র, রিয়েল সেলার, টাকা বিজনেস, জাল টাকা চাই স্যার, জাল টাকার প্রজেক্টসহ এমন অন্তত অর্ধশত ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ পাওয়া গেছে; যেগুলো থেকে পাইকারি ও খুচরা জাল টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে ১০০, ২০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার জাল নোটে দেওয়া হচ্ছে নানা ছাড়ও।
আরেক ফেসবুক গ্রুপে মো. আব্দুল খালেক রাহমান নামে আরেকটি আইডি থেকে পোস্ট দিয়ে বলা হয়েছে, শতভাগ ভালো মাল পাবেন আমার কাছে। আমার কাছে পাবেন ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট। সব জায়গায় হোম ডেলিভারি বা কুরিয়ারে টাকা পাঠিয়ে থাকি। যাদের লাগবে তারা ইনবক্সে যোগাযোগ করুন।
জাল টাকার ডিলার নামে আরেকটি আইডি থেকে একটি জাল নোটের ভিডিও পোস্ট করা হয়। এতে বলা হয়, ঈদের নতুন ১০ টাকা, ২০ টাকার জাল নোট লাগলে আমার সাথে যোগাযোগ করুন। আমার টাকায় জল ছাপ ও খসখসে দাগ আছে। কেউ ধরতে পারবে না টাকাটি আসল নাকি নকল। ভিডিওর ক্যাপশনে যোগ করা হয়েছে একটি ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপ মোবাইল ফোন নম্বর। তার কাছ থেকে টাকা সরবরাহ করতে হলে এই নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে।
জাল টাকা বানানোর বিস্তারিত এবং জানার জন্য ক্রেতা সেজে এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করে তার দেওয়া নম্বরে। এই ব্যবসা নতুন জানিয়ে ব্যবসার জন্য সাহায্য চাইলে তিনি জানান, প্রতি লাখ জাল টাকা কিনতে তাকে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। তার সঙ্গে গঞ্চগড় জেলায় দেখা করে মাল নিতে হবে। অন্যদিকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জাল টাকা নিতে চাইলে কুরিয়ারের খরচ বাবদ বিকাশে অগ্রিম পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে হবে।
কুরিয়ারে ধরা খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে জাল টাকার কারবারি বলেন, ‘পুরাতন ম্যাজিক চুলার মধ্যে টাকা পাঠাব, এতে করে কোনোভাবেই কেউ বুঝতে পারবে না ভেতরে কী আছে।’
গ্রুপ থেকে সাজিদুর নামে আরেক জাল টাকা বানানোর কারিগরকে কল দিয়ে জানতে চাওয়া হয় এই টাকা বানানোর প্রক্রিয়া। এ কথা শুনে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, তিনি এই কৌশল শেখাতে পারবেন না। পরে শেখানোর বিনিময়ে তাকে টাকা অফার করলে তিনি মুন্সীগঞ্জ জেলায় ডাকেন।’
সাজিদুর জানান, এই কারবারে এসে কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি। এজন্য বিশ্বস্ত লোক ছাড়া কারবার করতে ভয় পান।
এদিকে ফেসবুকে জাল টাকা কিনতে চেয়ে পোস্ট দেওয়া শাহিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পেশায় রাজমিস্ত্রি তিনি। অল্প দিন যাবত তিনি এই ব্যবসায় নেমেছেন। এই কারবার শুরু কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফেসবুকে পোস্ট দেখেই লোভে পড়ে এই ব্যবসা শুরু করেন তিনি। প্রথম দিকে অনলাইনে টাকা কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পরে নতুন আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘ভালো মাল’ (জাল টাকা) পেয়েছেন।
এদিকে ঈদের আগে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জাল টাকার একাধিক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সবশেষ গত বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার চরমোহন এলাকা থেকে জাল টাকা বানানো ও বিক্রির অভিযোগে তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঈদে জাল নোটের কারবার যারা করে তাদের ওপর বিশেষ নজরদারি রাখছে র্যাব। এ বিষয়ে সাইবার মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক অনলাইনে নজরদারি করছে।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) লিটন কুমার সাহা বলেন, ‘এটা নিয়ে ডিবির সাইবার ইউনিট কাজ করছে। গোল্ড বেচাকেনায় এই টাকা বেশি লেনদেন হয়। এর জন্য সবাইকে আমরা নানাভাবে সচেতন করার কাজ করছি, মানুষ সচেতন হলে এসব অপকর্ম কমে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘অনলাইনে এমন অনেক কিছু হচ্ছে। এ ধরনের পোস্ট দিয়ে মানুষকে ডেকে এনে নানাভাবে হেনস্তা করে এই চক্র। তবে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।’
জাল নোট চেনার উপায়
* ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকাসহ প্রত্যেক নোটের সামনে ও পেছনে দুদিকের ডিজাইন, মধ্যভাগের লেখা, নোটের মূল্যমান এবং সাতটি সমান্তরাল সরল রেখা উঁচু-নিচুভাবে মুদ্রিত থাকে। ফলে হাত দিলে একটু খসখসে মনে হয়।
* নোটের ডান দিকে ১০০ টাকার ক্ষেত্রে তিনটি, ৫০০ টাকার ক্ষেত্রে চারটি ও ১০০০ টাকার নোটে পাঁচটি ছোট বৃত্তাকার ছাপ আছে, যা হাতের স্পর্শে উঁচু-নিচু লাগে। এ বৈশিষ্ট্য জাল নোটে সংযোজন করা সম্ভব নয়।
* জাল নোটের জলছাপ অস্পষ্ট ও নিম্নমানের হয়। আসল নোটে ‘বাঘের মাথা’ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রামের স্পষ্ট জলছাপ আছে, যা ভালো করে খেয়াল করলে আলোর বিপরীতে দেখা যায়।
* প্রত্যেক মূল্যমানের নোটেই বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো সম্বলিত নিরাপত্তা সুতা থাকে। নোটের মূল্যমান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো নিরাপত্তা সুতার চারটি স্থানে মুদ্রিত থাকে।
* এ নিরাপত্তা সুতা অনেক মজবুত, যা নোটের কাগজের সঙ্গে এমনভাবে সেঁটে দেওয়া থাকে যে নখের আঁচড়ে বা মুচড়িয়ে সুতা কোনোভাবেই তোলা সম্ভব নয়। নকল নোটে এত নিখুঁতভাবে সুতাটি দিতে পারে না।
* ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের প্রত্যেক প্রকার নোটের ওপরের ডান দিকে কোণায় ইংরেজি সংখ্যায় লেখা নোটের মূল্যমান রং পরিবর্তনশীল কালিতে মুদ্রিত থাকে। ফলে ১০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট ধীরে ধীরে নড়াচড়া করলে মূল্যমান লেখাটি সোনালি থেকে সবুজ রং ধারণ করে। একইভাবে ৫০০ লেখা লালচে থেকে সবুজাভ হয়। অন্যদিকে জাল নোটে ব্যবহৃত রং চকচক করলেও তা পরিবর্তন হয় না।
* প্রত্যেক প্রকার টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম ও নোটের মূল্যমান জলছাপ হিসেবে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম ও নোটের মূল্যমান প্রতিকৃতির তুলনায় উজ্জ্বল দেখায়। জাল নোটে এসব বৈশিষ্ট্য থাকে না।
এছাড়া স্বল্পমূল্যেও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন আছে। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে জাল নোট সহজেই পরীক্ষা করা যায়। জাল নোট ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখলে শুধু একটা রেখা দেখা যাবে। সূত্র : ঢাকা টাইমস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।