জুমবাংলা ডেস্ক : ‘আমাকে নিরাপদে ফিরিয়ে বাবা উৎসর্গ করলেন নিজেকে। আমার চোখের সামনে বাবাকে গুলি করে মারল পুলিশ। আমি শুধু আর্তচিৎকার করলাম। বাবাকে বাঁচাতে পারিনি। বাবার প্রাণের সঙ্গে উড়ে গেছে আমাদের পরিবারের মাথার ওপরের ছাদ।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ আবদুল হান্নান খানের ছেলে সাইফ আহমেদ খান সিফাত এ কথা বলেন। রাজধানীর মিরপুরের কাফরুল থানার ৪ নং ওয়ার্ডের ডি ব্লকের ১ নং সেকশনে তাদের বাসা।
তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যেতে আমার বাবা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। মিছিলে গেলে অফিস থেকে ফেরার সময় প্রতিদিন বাবা আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরতেন।
কিন্তু ৫ আগস্ট তিনি আমাকে নিরাপদে ফিরিয়ে উৎসর্গ করলেন নিজেকে। চোখের সামনে তাঁকে গুলি করে মারল পুলিশ। আমি শুধু আর্তচিৎকার করলাম। বাবাকে বাঁচাতে পারিনি। বাবার প্রাণের সঙ্গে উড়ে গেছে আমাদের মাথার উপরের ছাদ। এখন আমাদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই দায়।’
তিনি বলেন, গত ৫ আগস্ট দুপুরে আমি ছাত্র জনতার লংমার্চে অংশ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান এ খবর পেয়ে গণভবনে গিয়েছিলাম। বিকেল পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। সন্ধ্যার দিকে বাবা অফিস থেকে বের হয়ে আমাকে ফোন করে জানতে চান, আমি কোথায় আছি? জানালাম গণভবনে আছি। তখন বাবা সেখান থেকে আমাকে মোটরসাইকেলে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে মিরপুর ১৩ নম্বরের বাসায় ফিরছিলেন। পথে কাফরুল থানার কাছাকাছি যেতেই আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে পুলিশ।
সিফাত বলেন, পুলিশকে গুলি করা দেখে আমি হুড়মুড়িয়ে নেমে একটি পিলারের আড়ালে দাঁড়াই। বাবা বাইক ঘোরানোর চেষ্টা করেন। এ সময়ে একটি গুলি এসে লাগে তাঁর পেটে। তিনি শুধু একবার বললেন, সিফাত আমার গুলি লাগছে রে …। এরপর অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, বাবা পুলিশের গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁর তলপেটে বাম পাশে গুলি লেগে পিছন সাইড দিয়ে বের হয়ে যায়। তখন তিনি গুলি খেয়ে ছটফট ছটফট করতে থাকেন। আমি চিৎকার করায় স্টাফ কোয়ার্টারের লোকজন বেরিয়ে আসে। একটি গামছা দিয়ে গুলি লাগা স্থান বেঁধে দেয়। প্রায় ১৫ মিনিট পরে সিএনজিতে উঠিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়ার সময় বাবা আমার শরীরের ওপর নিস্তেজ হয়ে পড়েন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। হাসপাতালে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আবদুল হান্নান খানের (৫৭) গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার কাশিনাথপুর ইউনিয়নের ইদ্রাকপুর গ্রামে।
বাবা মৃত শহীদুর রহমান ও মা মৃত সাজেদা বেগম। হান্নানের স্ত্রীর নাম শিরিন আক্তার (৪০)। আবদুল হান্নান বিমান বাহিনীতে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের (এমইএস) চার্জহ্যান্ড পদে চাকুরি করতেন। অস্থায়ী চাকরি হওয়ায় বেতন তেমন ছিল না। বেতন ভাতা যা পেতেন, তা দিয়ে দুই সন্তানের পড়ালেখাসহ টেনেটুনে সংসার চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসে গেছেন অন্যরা।
সাইফ আহমেদ খান সিফাত রাজধানীর মগবাজারে বেসরকারি কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
তাঁর বোন সায়মা আক্তার সিনথিয়া (১০) বিএএফ শাহিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্র্থ শ্রেণির ছাত্রী।
শহীদ আবদুল হান্নানের স্ত্রী শিরিন আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী অস্থায়ী চাকুরি করায় কোনো পেনশন নেই। তাঁর মৃত্যুর পর কেউ এসে জিজ্ঞেস করল না, কীভাবে দুই সন্তান নিয়ে বেঁচে আছি। আমাদের এমন কোনো সম্পদ নেই, যা বিক্রি করে জীবন কাটাব।’
তিনি বলেন, আমার স্বামীর স্বপ্ন ছিল ছেলেকে ডাক্তার ও মেয়েকে বিমান বাহিনীর অফিসার বানানোর। ছেলে আমার ডাক্তারি পড়ছে। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণের আগেই তাকে চলে যেতে হলো অচেনা এক পৃথিবীতে। যেখান থেকে কেউ আর কোন দিন ফিরবে না। সন্তানদের শিক্ষিত করা, মানুষের মতো মানুষ করা কোনটাই আর দেখে যেতে পারলেন না। মুহূর্তেই পুলিশের বুলেট সব শেষ করে দিল। তছনছ হয়ে গেল আমার সাজানো সংসার।’
তিনি আরো বলেন, গত ৫ আগস্ট কর্মস্থল ঢাকা সেনানিবাস থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে ছেলের সাথে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। সন্ধ্যা ৭ টার আগে কাফরুল থানার সামনে স্টাফ কোয়ার্টারের পাশে পৌঁছালে ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ তাদেরকে দেখে বকাঝকা শুরু করে এবং জানতে চায় তারা কেন বের হলো। এক পর্যায়ে পুলিশ ৪০ থেকে ৪৫ ফিট দূর থেকে হান্নান ও তার ছেলেকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। ছেলে মোটরসাইকেল থেকে নেমে পড়ায় বেঁচে গেছে। হান্নান বন্দুকের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শিরিন আকতার বলেন, গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় আমি আমার স্বামীকে ফোন করলে আমার ছেলে ফোন ধরে জানায় যে বাবা গুলিতে আহত হয়েছে, হাসপাতালে নিচ্ছি। আমি হতভম্ভ হয়ে পড়ি। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার স্বামী আর নাই। আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ছিলেন। বাবা-মা ও এলাকাবাসীর ভক্ত ছিলেন। বাড়ী গেলে গরীব মানুষকে যতটুক পারুক সহযোগিতা করতেন। এলাকার মানুষ কোন কাজে ঢাকায় আসলে যতদুর সম্ভব তাদের নানা ভাবে সাহায্য করতেন। আমি আমার স্বামীর শহীদি মর্যাদা চাই। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। মেডিকেল পড়ুয়া ছেলে এবং স্কুল পড়ুয়া মেয়ের পড়ার খরচ, বাসা ভাড়া নিয়ে ভীষণ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়েছি। সহযোগিতা না পেলে ছেলে মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ঘটনার পরে ৫ আগস্ট আবদুল হান্নানের মরদেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে রাখা হয় এবং এরপর ৭ আগস্ট শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে পাবনায় গ্রামের বাড়িতে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ৮ আগস্ট সকাল ৯ টায় জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
শহীদ হান্নানের ছেলে সিফাত জানান, বাবাসহ আমাদের পরিবারের সবাই আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম। পরিবারের একমাত্র উপাজর্নক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আমার বাবা। তাকে হারিয়ে আমরা এখন অর্থনৈতিক সমস্যায় দিশেহারা।
আমাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ভীষণ প্রয়োজন।
পিতা হত্যার বিচারের বিষয়ে সিফাত বলেন, আমার বাবার শহীদি মর্যাদা, আন্দোলনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং খুনিদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই।
সহযোগীতার বিষয়ে তিনি বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে আমরা পাঁচ লাখ টাকার চেক পেয়েছি। এছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।