মিয়াজ নজরুল ইসলাম : বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের নাম শুনলেই আমাদের মনে ভেসে আসে তুষারে ঢাকা তীব্র হিমশীতল দেশ ফিনল্যান্ডের কথা, যেখানে বছরের প্রায় ছয় মাস টানা সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। নিজস্ব জীবন-ধারা, শিক্ষা, এবং সংস্কৃতির জন্য বিশ্ব দরবারে বারবার মিলছে স্বীকৃতি। সবচেয়ে সুখী দেশের তকমা পেলেও এর পূর্বের ইতিহাস অতটা সুখকর ছিল না। দেশটির পরাধীনতার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হওয়ার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ১৯১৭ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। এর আগে প্রায় প্রায় ৬০০ বছর ছিল সুইডিশ রাজতন্ত্রের অংশ। আমার এই লেখায় ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
সুইডিশ শাসন
১২শ শতাব্দী (নির্দিষ্ট সময়কাল অজানা) থেকে ১৮০৯ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় ৬০০ বছর ফিনল্যান্ড ছিল সুইডিশ রাজতন্ত্রের অংশ। যদিও ফিনিশ ভাষাভাষী অধিবাসীগণ তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা ধরে রেখেছিল। এই সুদীর্ঘকাল শাসিত হওয়ার কারণে ফিনল্যান্ডের ভাষা ও সংস্কৃতি গভীরভাবে সুইডিশ ভাষা ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর একটি প্রধান কারণ হলো সুইডেনের শাসনামলে এই অঞ্চলে সুইডিশকে প্রধান ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এবং এই সময়ে ফিনল্যান্ডে সুইডিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় অপেক্ষাকৃত ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব হয় যারা নিজেদের ফিনিশ ভাষাভাষী আদিবাসীদরে চেয়ে নিজেদের অপেক্ষাকৃত উন্নততর মনে করতো।
তবে ফিনল্যান্ডের সাথে সুইডেনের আজ অবধি বিদ্যমান সুসম্পর্কের কারণ হিসেবে আমি দুটি বিষয়কেই কার্যকারণ সম্পর্কীয় বলব; সুইডেন ফিনল্যান্ডকে শাসন করেছে, কিন্তু শোষন করেনি অথবা এই শাসনকালের অথবা শোষনকালের সেই অর্থে কোন ধারাবাহিক লিপিবদ্ধ ইতিহাস নাই! আমি দ্বিতীয় কারণটিকেই অপেক্ষাকৃত সত্যের কাছাকাছি বলব। কারণ পৃথিবীতে শোষনবিহীন কোন উপনিবেশিকতার ইতিহাস নাই। পরাধীন থাকলেও এ সময়ে ফিনল্যান্ড রাষ্ট্র হিসেবে কাঠামো পেতে শুরু করে। এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে-কথ্য ভাষা থেকে ফিনিশ লিখিত ভাষায় রুপ পেতে শুরু করে। মিকাইল আগরিকোলা নামক লুথারিয়ান চার্চের একজন বিশপ রোমান হরফে ফিনিশ ভাষা লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন। সঙ্গত কারণেই মিকাইল আগরিকোলাকে ফিনিশ লিখিত ভাষার জনক বলা। এটি পৃথিবীতে খুবই বিরল একটি উদাহরণ যে একজন মানুষের হাত ধরে একটি জাতির অথবা একটি দেশের ভাষা প্রবর্তিত অথবা পরিমার্জিত হয়েছিল।
রুশ শাসনকাল
১৮০৮ সাল থেকে ১৮০৯ সাল পর্যন্ত চলা ফিনিশ যুদ্ধে সুইডেন রাশিয়ার কাছে পরাজিত হয়। উল্লেখ্য, এই যুদ্ধ ছিল নেপোলিয়নের উত্তর গোলার্ধে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের সুদীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ, যেটি নেপোলিয়ন তার তখনকার মিত্র জার প্রথম আলেকজান্ডারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছিল। মুলতঃ তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একটি জোট গঠনে রাজি না হওয়ার নেপোলিয়ন ও আলেকজান্ডার সুইডেনের ওপর এই যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। এই দুই ক্ষমতাধর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সুইডেন একলা পেরে উঠেনি এবং পরাজিত পক্ষের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৮০৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফ্রেডরিকশাম চুক্তির মাধ্যমে ফিনল্যান্ড সুইডেন থেকে রাশিয়ার শাসনের অধীনে চলে যায়। এরপর ফিনল্যান্ড হয়ে যায় রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে ‘গ্র্যান্ড ডাচে’, যেখানে রুশ সম্রাট ‘গ্র্যান্ড ডিউক’ উপাধিতে শাসন করতেন।
রুশ শাসনকালে ফিনল্যান্ডে উল্লেখযোগ্য স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখে। এই সময়েই ‘ডায়েট’ নামে ফিনল্যান্ডের পার্লামেন্ট ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। এটিই ছিল ১৮০৯ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত ফিনল্যান্ডের গ্র্যান্ড ডাচির ঐতিহাসিক আইনসভা। সমাজের চারটি (অভিজাত সম্প্রদায়, পাদ্রী, মধ্যবিত্ত শ্রেনী, ও কৃষক সম্প্রদায়) শ্রেণির প্রতিনিধি নিয়ে এই আইনসভা প্রবর্তিত হয়।। ১৯০৯ সালে ডায়েট বিলুপ্ত হয়ে আইনসভা(Eduskunta) প্রবর্তিত হয়। আজকের ফিনিশ পার্লামেন্ট সেটিরই পরিমার্জিত রুপ। সঙ্গত কারণে সুইডিশ শাসনামলে ফিনল্যান্ডের দাপ্তরিক কেন্দ্র ছিল ‘তুর্কু’! কারণ ‘তুর্কু’ ভৌগোলিকভাবে সুইডিশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রের অনেক নিকটে অবস্থিত ছিল।
১৮৮২ সালে রাশিয়ান সম্রাট প্রথম আলেকজান্ডার অনুমিতভাবেই ফিনল্যান্ডের রাজধানী তুর্কু থেকে হেলসিংকিতে স্থানান্তর করেন এবং সেই থেকে আজ অবদি হেলসিংক ফিনল্যান্ডের রাজধানী। সুইডেন ফিনল্যান্ডকে শাসন করেছে কোনও বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সুবিধা বা মর্যাদা না দিয়েই। এদিক থেকে রাশিয়া একটু ব্যতিক্রমই ছিল বলা যায়।
রুশ শাসনের প্রথমার্ধে ফিনল্যান্ড মোটামুটিভাবে একটি রাষ্ট্রের সকল সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল; ছিল নিজস্ব আইনসভা ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। ভাষা ও সংস্কৃতিরও বিকাশ ঘটছিল সমানতালে। ১৮৩৫ সালে ফিনিশ সাহিত্যের কিংবদন্তি মহাকাব্য ‘কালেবালা’ সংকলিত হয় ইলিয়াস লনরটের হাতে। ১৮৬৩ সালে সম্রাট দ্বিতীয় আলেকজান্ডার এক আদেশ জারীর মাধ্যমে ফিনিশ ভাষাকে ফিনল্যান্ডের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন, যেটি ফিনিশ ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছিল ব্যাপকভাবে। যদিও এটি ছিল মূলত ফিনল্যান্ডকে সুইডিশ প্রভাব থেকে বের করে আনার চেষ্টা। এই সময়েই ফিনিশদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ধ্যান ধারনা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। ১৭৮৭ সালে ফিনল্যান্ড তার নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠনের অনুমতি পায়, যেটি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরও উস্কে দেয়!

রুশ শোষনকাল
ফিনল্যান্ডে রাশিয়ান শাসনকে মোটাদাগে দুই কালে ভাগ করা যায়; শাসনের কাল ও শোষনের কাল। ১৮০৯ থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত ফিনল্যান্ডের রাশিয়ান অধীন সময়টাকে বলা যায় শাসনের কাল। এবং ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় শোষনের কাল। ১৮৯৯ সালে শুরু হওয়া ‘রাশিফিকেশান’ নামক আয়োজনের মাধ্যমে ফিনল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা আস্তে আস্তে সীমিত করা হয়, ফিনল্যান্ডের গ্র্যান্ড ডাচে উপাধি বিলুপ্ত করা হয়। এই সময় ফিনল্যান্ডকে পুরোপুরিভাবে রাশিয়ান সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলা হয়। আর এই শোষনই ফিনল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে উসকে দেয়। ফিনল্যান্ড ও রাশিয়া রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক বৈরিতার কারণ জানতে ইতিহাসের এই সময়কালের পাঠ খুবই জরুরি।
ইতিহাসের অস্থির সময়কাল
বিশ্বের বাকী অংশের মতোই উত্তর মেরু অঞ্চলের এই দেশটিও এক অস্থির সময় পার করেছে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে, যেটি একাধারে ছিল ফিনল্যান্ড নামক রাষ্ট্রের জন্মের প্রসব বেদনার কাল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) এবং পরবর্তীতে প্রথম রুশ বিপ্লব (১৯১৭) ফিনল্যান্ডে এক নতুন রাজনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করে। মার্চ ১৯১৭-এ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের পদত্যাগের পর ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী জনগন অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে। পরে নভেম্বর ১৯১৭-এর বলশেভিক বিপ্লবের পর ফিনিশ সংসদ পূর্ণ স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়। ৬ ডিসেম্বর ১৯১৭ ফিনিশ সংসদ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর সোভিয়েত সরকার ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর সুইডেন (৪ জানুয়ারি ১৯১৮) ও জার্মানি (৬ জানুয়ারি ১৯১৮) ফিনল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পরও ফিনল্যান্ডে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি!
গৃহযুদ্ধ
স্বাধীনতার পরপরই ফিনল্যান্ডে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এই গৃহযুদ্ধ ছিল মূলতঃ শ্রেণিযুদ্ধ। এক পক্ষ ছিল ‘রেডস’। বামপন্থী শ্রমিক ও নিম্নবিত্ত কৃষক সম্প্রদায়ের এই পক্ষ সমর্থন পেয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সোভিয়েত রাশিয়ার। অন্যপক্ষ ছিল সমাজের ধনিক শ্রেণি ‘হোয়াইটস’, যাদের সহায়তায় ছিল জাতীয়তাবাদী জার্মানি।
পাঁচ মাস স্থায়ী এই গৃহযুদ্ধে ফিনল্যান্ডের প্রায় ৩৬ হাজার মানুষ মারা যায়। এই গৃহযুদ্ধে জেনারেল কার্ল গুস্তাফ এমিল ম্যানারহেইম-এর নেতৃত্বে হোয়াইট বাহিনী বিজয়ী হয়। গৃহযুদ্ধের পর ফিনল্যান্ডে রাজতন্ত্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ১৯১৯ সালে ফিনল্যান্ড প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান গ্রহণ করে, এবং কার্লো ইয়হো স্টাহলবার্গ দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এরপরও ফিনল্যান্ডকে আরও তিনটি বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়। সেগুলো নিয়ে কথা বলার জন্য আরেকটা দিন তোলা থাক।
লেখক : ডিপুটি কাউন্সিলর, এস্পো, ফিনল্যান্ড
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



