বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : আগামী দিনে পৃথিবী নামক গ্রহের পরিচালন ক্ষমতা চলে যাচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির হাতে। চমকে ওঠার কিছুর কিছু নেই। সেই ডিজিটাল প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ থাকবে মানুষেরই হাতে। বরং আশঙ্কা হলো, প্রযুক্তির এই আসন্ন অভাবনীয় বিপ্লবের ফলে গোটা পৃথিবীজুড়ে চাকরি হারানো মানুষের মিছিল নামতে পারে। কারণ মানুষের চেয়ে আরও নিখুঁত ও অক্লান্তভাবে কাজ করে দেবে রোবট। ফলে বাড়বে উৎপাদন, বাড়বে শিল্পপতিদের সম্পদ। কর্মী ছাঁটাইয়ের হিড়িক চলবে সর্বত্র।
আচ্ছা, কৃষি থেকে শিল্প-কারখানা- সবখানে, সব কাজই যদি রোবট করে দেয়, তাহলে চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়ে যাওয়া পৃথিবীর বিপুলসংখ্যক মানুষের খাওয়া-পরার কী বন্দোবস্ত হবে! অল্প সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের দুনিয়া কি দুর্ভিক্ষে পড়ে যাবে! না খেতে পেরে কি অনেক মানুষ মারা যাবে, যেমনটা হয়েছিলো পঞ্চাশের মন্বন্তরে, ভারতীয় উপমহাদেশে! নাকি যেসকল শিল্পপতিরা প্রযুক্তির কল্যাণে আরও বড় শিল্পপতি হয়েছেন, প্রযুক্তির তথা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন নিজেদের হাতে তাদেরই দয়া-দাক্ষিণ্যে বাঁচতে হবে কর্মহীন মানুষদের?
এতক্ষণ যা যা বললাম তা হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে যা যা হতে পারে তারই সামান্য ইঙ্গিত। ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ কথাটির উৎপত্তি ২০১১ সালে, জার্মান সরকারের একটি হাই টেক প্রকল্প থেকে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান ক্লস শোয়াব এটিকে সর্বপ্রথম বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরেন। সংক্ষেপে, সোজা কথায় বললে-চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান বিশ্বের বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
এবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। তার আগে, সংবাদ সংস্থা সিএনএনের সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠা বিল গেটস-এর একটি কথা স্মরণ করতে পারি। তিনি বলেছেন, প্রযুক্তি প্রথমে ভয় দেখায়, পরে সম্ভাবনার দ্বরসমূহ উন্মোচন করে। উদাহরণ হিসেবে তিনি কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের শুরুর দিককার কথা বলেছেন। সেসময় অনেকেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এটা ভেবে যে, তাহলে খেটে খাওয়া কৃষিজীবী মানুষের কী হবে, তাদের কাজ তো প্রযুক্তিবানদের হাতে চলে যাবে! কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। কৃষকরাই ব্যবহার করছেন প্রযুক্তি, উৎপাদন যেমন বেড়েছে- তেমনি তাদের কাজও বেড়েছে। প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন প্রত্যেকেই। ফলে এটা প্রমাণিত যে, নতুন নতুন প্রযুক্তি আসলে মানুষের জীবনযাত্রা যেমন সহজ হয়ে ওঠে, তেমনি মানুষের কাজও বাড়ে। সময় ও অর্থ বেঁচে যায় মানুষের। সেই সময়, সেই অর্থে করা যায় নতুন নতুন কাজ। আর সেই কাজে লাগানো যায় আরও আরও মানুষকে।
কথা হলো, মানুষকে দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। আগামীর পৃথিবী মূলত দক্ষতারই পৃথিবী। অদক্ষ চালকের পক্ষে পাহাড়ি চড়াই-উতরাই দিয়ে গাড়ি চালানো যেমন কঠিন, তেমনি কঠিন হতে পারে অদক্ষদের পক্ষে শ্রমবাজারে টিকে থাকা। ডিজিটাল বিপ্লবের ছোয়ায় অকল্পনীয় পরিবর্তন ঘটবে উৎপাদন ব্যবস্থায়। যেখানে মানুষের কাজটি স্বযংক্রিয়ভাবেই করে দেবে যন্ত্র বা রোবট। যান্ত্রিক ত্রুটি না থাকলে যন্ত্রের কাজে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নাই, বরং নিখুঁত ও নির্ভুল হবে তার কাজ। ফলে স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, যোগাযোগব্যবস্থা, পোশাক শিল্পখাত কিংবা প্রকাশনা শিল্প সবখানেই প্রযুক্তির প্রভাব হবে অত্যন্ত জোরালো।
বাঁধ ভেঙে হঠাৎ যদি পানির প্রবল স্রোত একটি শহরে ঢুকে পড়ে, আর তার প্রবল ধাক্কায় শহরে যদি একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন এসে যায়, তবে ব্যাপারটা যেমন দাঁড়াবে এখানেও অনেকটা তেমনই। প্রযুক্তির এই অত্যন্ত জোরালো প্রভাবের ফলে অভাবনীয় যে পরিবর্তন আসবে- এককথায় বললে তা-ই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই বিপ্লবের সুযোগ গ্রহন করতে হলে ব্যাপক আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে বাংলাদেশকেও। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আইওটি, ব্লকচেইন ও রোবটিক্স ইত্যাদির ব্যবহার করতে দ্রুত কৌশলগত পরিকল্পনা করতে হবে। এজন্য এখন থেকেই লক্ষ্য নিধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে; তৈরি করতে হবে সুদক্ষ মানবসম্পদ, পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষাব্যবস্থায়। এক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থাকে মুখস্থমুখী না রেখে এবং চাকরির পরীক্ষার জন্য বাজার সয়লাব হওয়া এমসিকিউ গাইড পড়াকে নিরুৎসাহিত করে চিন্তা ও উদ্ভাবনে মনোযোগী জনসম্পদ তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের বিশেষ বিশেষ কাজে পারদর্শী হিসেবে গড়ে ওঠাকে উৎসাহিত করতে হবে। এটা হলে ধীরে ধীরে শিক্ষাব্যবস্থায় আসবে আমূল পরিবর্তন, সেইসঙ্গে তৈরি হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে জীবন-জীবিকা ও দেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণে উপযোগী লোকবল।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই তরুণ। বিরাটসংখ্যক এই তরুণদলই মূলত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি। প্রথমে যে কথাটি বলে শুরু করেছিলাম, পৃথিবীর পরিচালনক্ষমতা প্রযুক্তির হাতে চলে গেলেও সেই প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ কিন্তু থাকবে মানুষের হাতেই। ফলে জ্ঞানভিত্তিক এই শিল্প বিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ মানবসম্পদই হবে বেশি মূল্যবান।
দেশে বর্তমানে সাড়ে ছয় লাখের বেশি তরুণ-তরুণী অনলাইনে কাজ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে। দেশিয় হার্ডওয়ার, সফটওয়্যার রপ্তানির হার দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং এর বাজার সামনে আরো বিস্তৃত হবে। অনলাইন প্লাটফর্মকে পুঁজি করে কর্মসংস্থানকারীদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গী করতে দেশের সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতাকে আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দেশের নির্মিত ও নির্মাণাধীন হাইটেক পার্কগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। তবে আগেই যেটি বলেছি, এই বিপ্লবের ফলে গোটা দুনিয়ার একটি বিশাল অঙ্কের মানুষের কাজ হারানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। এর প্রভাব আমাদের দেশেও অতি মাত্রায় লক্ষণীয় হতে পারে। মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয়গুলোও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তির মধ্যে অব্যাহত যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি যন্ত্রগুলো আপডেট করার পাশাপাশি প্রযুক্তির নিরাপত্তা ঝুঁকি আপডেটের মাঝে সমন্বয় সাধনের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পুরো জীবনব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষ, প্রকৃতি এবং সমাজের সর্ম্পক বৃহত্তর রূপান্তর হতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।