জাকির আবু জাফর : শুনতে বেখাপ্পা লাগলেও বিষয়টি সত্যি! সাজিয়ে দিলেই বাগান হয়ে ওঠে না। বাগানকে বাগান করে তুলতে বহু চেষ্টা-প্রচেষ্টা করতে হয়। অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। অনেক বিষয় দরকার পড়ে। বেশ কিছু নিয়ম-পদ্ধতি ব্যবহার করা জরুরি হয়। বাগান তখনই বাগান হয়, যখন তাকে তার বৈশিষ্ট্যে সাজানো হয়। যখন বাগানকে দেয়া হয় বাগানের চরিত্র। ফুলের বাগান বানাতে হলে ঠিক করতে হবে কেমন বাগান চাই! বাগানটি কি শুধুই গোলাপের! রজনীগন্ধার! নাকি শুধু হাসনাহেনার! নাকি অনেক জাতের ফুল মিলিয়ে হবে বাগান!
যদি এক জাতীয় ফুল হয়, হতে পারে। সব মিলিয়েও হতে পারে। গোলাপ বাগান হলে নানা রঙের গোলাপ তো আছেই। বিচিত্র রঙের গোলাপ দিয়ে সাজানো যায়। কিংবা যেকোনো একটি রঙের অথবা নানা রঙের দিয়েও সাজানো যেতে পারে। কিন্তু কথা হলো- গোলাপ গোলাপই হতে হবে। গোলাপের নাম করে মান্দা, গাঁদা, পলাশ কিংবা শিমুল হওয়া চলবে না।
আবার নানা জাতের ফুল যদি হয়, সেও হতে হবে সত্যি ফুল। কাগজের ফুল, প্লাস্টিক কিংবা নকল ফুল দিয়ে সত্যিকার ফুল বাগান হওয়ার সুযোগ নেই। বাগান করতে হয় বাগানের নিয়মে। ধান কিংবা মুলা চাষের মতো করে বাগান চাষ হয় না। হবেও না।
কেউ যদি বাগানবাড়ি বানাতে চান তাকে ফুলের পাশাপাশি ফলের গাছ এবং নানাবিধ বৃক্ষও লাগাতে হবে। সেই লাগানোরও একটি নিয়ম আছে। নিয়ম মেনে সাজাতে হয় বাগান কিংবা বাগানবাড়ি। আবার ঠিকঠাক পরিচর্যা ও যত্ন নিতে হবে।
শুধু বাগানের কথা নয়, যাবতীয় চাষবাসে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে করতে হয়। কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলারও নিয়ম আছে। প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিধি আছে। বৈধ-অবৈধতারও নীতি ও কৌশল আছে।
ধরুন কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা। যেকোনো প্রতিষ্ঠান নিজস্ব নিয়ম মেনে চলতে হয়। চালাতে হয়। সে নিয়ম যথার্থ নিয়ম হতে হবে। হতে হবে সত্যি নিয়ম। অনিয়ম নিয়ম হয়ে উঠলে তাকে গ্রহণ করা যায় না। তা যতই সাজানো গোছানো হোক না কেন! যত প্রচার প্রপাগান্ডা হোক মিথ্যা মিথ্যাই। অনিয়ম অনিয়মই। অসুন্দর অসুন্দরই।
আকর্ষণীয় লেভেল কিংবা রঙ সত্যিকার জিনিসের প্রতিনিধিত্ব করে না। রঙ কিংবা প্রলেপ কখনো ভালো-মন্দের মানদণ্ড হয় না। হতে পারে না। প্রচারণা কখনো সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড নয়। অধিক প্রচারণায় কখনো মিথ্যা সত্য হয়ে ওঠে না। সত্যও মিথ্যা হয়ে যায় না। সাময়িক অসুবিধা হতে পারে। হয়ও। কিছু দিন কিংবা দীর্ঘদিনের জন্য পেশির জোরে সত্য দাবিয়ে রাখা যায়। কিন্তু চিরদিনের জন্য সত্য দাবানো যায় না।
সত্যের একটি শক্তি আছে। সেটি তার আপন শক্তি। কোনো না কোনো দিন সে তার নিজস্ব শক্তিতে জ্বলে ওঠে। তখন চুরচুর করে ভেঙে যায় মিথ্যার মসনদ। অকস্মাৎ ধসে পড়ে গায়ের জোর ও পেশিশক্তি। মুহূর্তে ভেঙে খানখান হয় ক্ষমতার দাঁত!
জগতে আসল-নকলের পার্থক্য চিরকাল আছে। থাকবে। নকল দিয়ে আসল ঢাকা যায় না। ঢাকলেও আসল বেরিয়ে আসে সহসা। সত্য নিজে একটি আগুন। ছাই দিয়ে আগুন চাপা দেয়া যায় না। সত্যের আগুন মানে সত্যের শক্তি। যারা সত্য ধারণ করেন পৃথিবীতে তারা বিজয়ী হন। অসত্য সাময়িক সুবিধা পেলেও পেতে পারে। কিন্তু চিরকাল নয়।
একটি গল্পটি বলে নিই। গল্পটি একটি স্কুলের। প্রাইমারি স্কুল। একদিন স্কুল পরিদর্শনে যান স্কুল পরিদর্শক বা ইন্সপেক্টর। এ ধরনের পরিদর্শক সাধারণত আকস্মিকভাবে যান। গিয়ে কোনো একটি শ্রেণিকক্ষে ঢোকেন। তারা দেখতে চান কী ধরনের পড়ালেখা হচ্ছে স্কুলে।
এমনই হঠাৎ একদিন একটি স্কুলে ইন্সপেক্টর এলেন। এসে তিনি সরাসরি ঢুকলেন একটি শ্রেণিকক্ষে। সেটি ছিল পঞ্চম শ্রেণী। ছাত্রসংখ্যা সাকুল্যে তিনজন। তিনজনের একজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বলো তো, পাঁচ বারো কত?
ছাত্রটি প্রায় কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিলো, আমি জানি না স্যার!
জানো না! কেন? পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র তুমি। পাঁচ বারো কত জানো না! কি পড়াশোনা করো!
মাথা চুলকাতে চুলকাতে ছেলেটি বলল, স্যার আমি তো ছাত্র নই।
কি! তুমি ছাত্র নও! এ আবার কি কথা! কি তুমি?
ছেলেটি আরেকবার মাথা চুলকিয়ে বলল, আমি স্কুলের ঝাড়ুদার স্যার! ক্লাসের শিক্ষকের দিকে দেখিয়ে বলল, এই স্যার আমাকে এখানে বসতে বলেছেন। বলেছেন, আজ কে জানি আসবে। ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা বেশি দেখানোর জন্য আমাকেও থাকতে কইছে। তাই আমি আইছি স্যার।
এবার ইন্সপেক্টর প্রায় রেগে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলেন, কি বলছে ছেলেটি! এটি কি সত্যি?
কাচুমাচু করে শিক্ষক জবাব দিলেন, জি স্যার, সত্যি! আমিই কইছি ওরে থাকতে।
ইন্সপেক্টর স্বর উঁচু করে বললেন, এটি কী করে সম্ভব! আপনি শিক্ষক হয়ে এ কাজ কী করে করতে পারলেন!
জবাবে লোকটি বলল, স্যার আমি তো শিক্ষক নই! আমি একজন টাইপিস্ট। স্কুলের সামনে আমার কম্পিউটার দোকান আছে। আমি কম্পোজ করি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাকে বললেন, আজ স্কুলে ইন্সপেক্টর আসবে। তুমি একটু শিক্ষক সেজে ক্লাসে থেকো। তাই আইছি স্যার!
ইন্সপেক্টর ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, কোথায় প্রধান শিক্ষক! চলো তার কাছে। বলেই হনহন করে ছুটলেন অফিস কক্ষের দিকে।
স্কুলের অফিসে বসে আছেন প্রধান শিক্ষক। ইন্সপেক্টর পৌঁছালেন প্রধান শিক্ষকের অফিসে। ইন্সপেক্টরকে দেখে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন প্রধান শিক্ষক। সসম্মানে তাজিম করে বললেন, বসুন স্যার! বসলেন ইন্সপেক্টর। বসে বললেন, এটি কী দেখছি- আপনার স্কুলে! ক্লাসে ছাত্র, ছাত্র নয়। শিক্ষকও শিক্ষক নয়! এটি কেমন কথা! কি পেয়েছেন আপনি। এভাবে স্কুল চলে! এভাবে শিক্ষা হয়! আপনি প্রধান শিক্ষক হলেন কেমন করে!
প্রধান শিক্ষক দরবিগলিত হয়ে বললেন, স্যার ক্ষমা করবেন। আমি প্রধান শিক্ষক নই। এবার ইন্সপেক্টরের চোখ কপালে ওঠার দশা!
একরকম ভাষাহীন চেয়ে আছেন প্রধান শিক্ষকরূপী লোকটির দিকে। লোকটির কণ্ঠে ভয় ফুটে উঠল। বলল, প্রধান শিক্ষক আমার চাচা। আমি একজন ঠিকাদার। আমার চাচার কী জানি জরুরি কাজ আছে আজ। কাজটি সারতে গেছেন তিনি। আমাকে বললেন, আজ ইন্সপেক্টর আসবেন। তুমি একটু আমার পরিবর্তে থেকো। তাই আমি এখানে!
শুনে অবাক দশা ইন্সপেক্টরের! ততক্ষণে তার সামনে হরেক পদের খাবার পরিবেশন করা হলো। মুখরোচক খাবার দেখে শান্ত হয়ে বসলেন ইন্সপেক্টর। প্রধান শিক্ষকরূপী ঠিকাদারের অনুরোধে মুখে তুললেন খাবার। বেশ মজা করে খাচ্ছেন। খেতে খেতে ডানে-বাঁয়ে তাকালেন। তারপর কিছুটা চাপা কণ্ঠে বললেন, আজ আপনার কপাল ভালো। আসলে আমিও ইন্সপেক্টর নই। আমি ইন্সপেক্টরের শ্যালক। দুলাভাইয়ের কী জানি জরুরি কাজ পড়ে গেছে আজ। তাই তিনি আমাকে ইন্সপেক্টরের প্রক্সি দিতে পাঠিয়েছেন।
একটু নড়েচড়ে বসলেন ইন্সপেক্টর। বললেন, দেখুন আমরা সবাই নকল। ছাত্র নকল! শিক্ষক নকল! প্রধান শিক্ষক নকল! ইন্সপেক্টরও নকল। আমরা কেউ আসল নই। কেউ সত্যি নই। আমরা আসলে সবাই ডামি! একটি স্কুল দিলে স্কুল হয় না। মনে পড়ছে একজন কবির কথা। কবি বলেছেন, সাজিয়ে দিলেই বাগান হয়ে ওঠে না!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।