আন্তর্জাতিক ডেস্ক : হামাস তো আর হুটহাট হামলা করেনি; ৫৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা যে শ^াসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের শিকার, সেই সত্যকেও তো স্বীকার করতে হবে। স্বয়ং জাতিসংঘ মহাসচিবও গতকাল এমন মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাপন্থি এই গোষ্ঠীকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করে এবং জঙ্গিসংগঠন ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে তুলনা করে এদের ‘নির্মূল করতে পাল্টা আক্রমণ’ চালাচ্ছে ইসরায়েল। তাদের নির্বিচার আক্রমণে মরছে মানুষ; ইসরায়েলি আগ্রাসনের বলি হচ্ছে বেসামরিক ফিলিস্তিনিরা। বিরামহীন বোমাবর্ষণ ও স্থল আক্রমণে গাজায় প্রাণহানির পাহাড় তৈরি হচ্ছে। এমন অমানবিক বিপর্যয় যে, নিহতদের জন্য কান্নার লোকও যেন আর নেই।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আক্রমণ করে গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস। এরপর থেকেই পাল্টা আক্রমণ করছে ইসরায়েল। হামাসের হাতে জিম্মি ২২২ জনের কথা মাথায় রেখে ‘সীমিত আকারে’ স্থল আক্রমণ চালাচ্ছে ইসরায়েল। কিন্তু তারা বিমান হামলা দিন দিন জোরদার করেছে। গতকাল গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় গাজার চার শতাধিক জায়গায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭০৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি হামলায় ১৮ দিনে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০। অন্যদিকে হামাসের হামলায় এ পর্যন্ত এক হাজার চারশ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন।
আল জাজিরা ও বিবিসির প্রতিবেদনগুলো থেকে পাওয়া তথ্য মতে, গাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল- সব ধরনের স্থাপনাতেই আক্রমণ করছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা ইসরায়েলকে আক্রমণ চালাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে হামাসের অভিযোগ। এদিকে পশ্চিমাদের অভিযোগ, ইরান এই যুদ্ধে হামাসকে সমর্থন জোগাচ্ছে। হামাস-সম্পৃক্ততার অভিযোগে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গেও সংঘাতে জড়িয়েছে ইসরায়েল। কাতার গতকাল বলেছে, ইসরায়েলকে এভাবে ‘বাধাহীন হত্যাযজ্ঞ’ চালাতে দেওয়া যায় না।
গাজার প্রতি তিনটি হাসপাতালের একটি বিধ্বস্ত হয়ে অচল রয়েছে। জ্বালানি ফুরিয়ে এসেছে। পৌঁছায়নি পর্যাপ্ত ত্রাণও। চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে মিশরের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল হিসেবে কাজ করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ইসরায়েলের তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওফির উইন্টার ইমেইল আলাপচারিতায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘ইসরায়েল ছাড়া মিশরই একমাত্র দেশ যার গাজার সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। মিশর গাজায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। গত দশকেও আমরা দেখেছি, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতায় মিশরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এবারও দেশটি অনুরূপ ভূমিকা পালন করবে, এটাই সবার প্রত্যাশা।’
আরবি ও ইসলামিক অধ্যয়ন বিভাগের এই প্রভাষক আরও বলেন, ‘যুদ্ধের পর গাজার পুনর্গঠনে, বিশেষ করে গাজার অধিবাসীদের কল্যাণ ও উন্নয়নে মিশর উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।’
তবে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অর্থবহ ভূমিকা রাখতে হবে। এ বিষয়ে ড. ওফির উইন্টার বলেন, ‘এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের আলোচনার টেবিলে ফিরে আসতে এবং শান্তি প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করতে উৎসাহিত করবে বলে আশা করি। যেসব বিষয় এখনো বিতর্কিত, সংলাপের মাধ্যমে সেগুলোর ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত সমঝোতায় পৌঁছানোর রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে।’
সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থাকতে আগ্রহী। তবে, ফিলিস্তিনিরা তাদের ওপর আস্থা রাখে না।
উত্তর গাজায় বেশি হামলা হওয়ার কারণে দক্ষিণ গাজায় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় নিয়েছেন। ইসরায়েলও তাদের সরে যেতে বলেছিল। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে আগে যেখানে চার লাখ মানুষ থাকত, এখন সেখানে ১২ লাখ মানুষ রয়েছে। কিন্তু দক্ষিণেও, এমনকি হাসপাতালসহ বেসামরিক স্থাপনাগুলোয় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল।
স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার পক্ষে থাকা দেশগুলো এবং নিরপেক্ষ অনেক বিশ্লেষক ইসারয়েলি এই হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছে। এমনকি ইউরোপীয় ইহুদিরা গতকাল বিক্ষোভ করে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তাদের নামে ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর এই হত্যাযজ্ঞ ইসরায়েল চালাতে পারে না। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইহুদিরা বিক্ষোভ করে ইসরায়েলকে সতর্ক বার্তা দিয়েছে যেন তাদের নাম ভাঙিয়ে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো না হয়। অথচ হামাস-বধের নাম করে জাতিগত নিধন চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। কিন্তু তদন্ত ও ইসরায়েলের বিচার করা সম্ভব কি না তা স্পষ্ট নয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গতকাল বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তি যেমন হামাসের হামলাকে ন্যায্যতা দিতে পারে না, তেমনি হামাসকে জবাব দেওয়ার নামে ইসরায়েল যে ‘ফিলিস্তিনি জনগণকে সম্মিলিত শাস্তি’ দিচ্ছে, এরও বৈধতা নেই।
গুতেরেস অনুরোধ করেছেন, ‘এ রকম সংকটকালে বেসামরিক নাগরিকদের সম্মান ও তাদের সুরক্ষার জন্য মৌলিক নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া অত্যাবশ্যক।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।