মধ্যরাত। ঢাকার মিরপুরের এক ফ্ল্যাটে তাসনিমা আক্তারের চোখে ঘুমের বিন্দুমাত্র ছায়া নেই। ফ্যানের একঘেয়ে আওয়াজ, দূরের রাস্তায় ট্রাকের হর্ন, আর মাথায় কাজের চাপের ঘূর্ণিপাক – সব মিলিয়ে বিছানা যেন কাঁটার চাদরে পরিণত হয়েছে। গত তিন মাস ধরে তার এই অবস্থা। ক্লান্তি জমেছে চোখের নিচে গাঢ় কালো দাগে, কাজে মনোযোগ হারিয়েছে, মেজাজও হয়ে উঠেছে খিটখিটে। তাসনিমার মতো অসংখ্য বাংলাদেশি আজ এই ‘নিদ্রাহীনতার যন্ত্রণা’তে ভুগছেন। শহুরে জীবনের দ্রুত গতি, চাকরির চাপ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, পরিবেশ দূষণ – সব মিলিয়ে ঘুম না হওয়ার সমস্যা এক মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কিন্তু আশার কথা হলো, এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিছু সচেতনতা, কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন আর কিছু জরুরি টিপস মেনে চললেই আপনি ফিরে পেতে পারেন সেই হারানো শান্তির রাত, সেই সুস্থ-সবল ভোরের অনুভূতি।
Table of Contents
ঘুম না হওয়ার সমাধান: কেন জরুরি টিপস জানা দরকার?
ঘুম কেবল বিশ্রাম নয়; এটি আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার মূল ভিত্তি। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা থেকে শুরু করে অবসাদ, উদ্বেগ, এমনকি স্মৃতিশক্তি হ্রাসের মতো মারাত্মক সমস্যার পেছনে দীর্ঘমেয়াদী অনিদ্রার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো ব্যস্ত মহানগরীতে, এই সমস্যা আরও প্রকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সুপারিশ অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৭-৯ ঘণ্টা গভীর ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক চিত্র – শহুরে জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০%-৪০% কোনো না কোনো ধরনের ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন, যার মধ্যে ঘুম না হওয়া বা ইনসমনিয়া অন্যতম প্রধান।
চিন্তার বিষয় হলো, অনেকে এই সমস্যাকে তেমন গুরুত্ব দেন না। ‘কাজের চাপ’, ‘ব্যস্ততা’ – এই অজুহাতে চাপা দেন নিজের ক্লান্তি আর বিরক্তি। কিন্তু ঘুম না হওয়ার সমাধান খোঁজা যে কতটা জরুরি, তা বোঝা যায় যখন দেখি এর প্রভাব কত বিস্তৃত:
- শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর আঘাত: ঘুমের অভাব শরীরের হরমোনাল ব্যালেন্স নষ্ট করে। কর্টিসলের (স্ট্রেস হরমোন) মাত্রা বাড়ায়, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমায় (ডায়াবেটিসের ঝুঁকি), রক্তচাপ বাড়ায়, ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে। হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। ওজন নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন লেপটিন ও গ্রেলিনের মাত্রা বিগড়ে যায়, ফলে খাওয়ার ইচ্ছা বাড়ে, ওজন বাড়ে।
- মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি: ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঘুম না হওয়ার সমস্যা উদ্বেগ, হতাশা, মেজাজের ওঠানামা, মনোযোগের অভাব এবং এমনকি গুরুতর মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশগুলো ঠিকমত কাজ করতে পারে না।
- কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস: ঘুমের অভাবে স্মৃতিশক্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও মনোযোগ ব্যাপকভাবে কমে যায়। কাজে ভুল বাড়ে, দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে (বিশেষ করে গাড়ি চালানোর সময়), সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা নেমে আসে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
- জীবনের গুণগত মানের অবনতি: সারাক্ষণ ক্লান্তি, বিরক্তি, কাজে অনীহা – এই অনুভূতিগুলো ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক মেলামেশা সবকিছুকেই প্রভাবিত করে। জীবনের আনন্দ, উৎসাহ কমে যায়। জীবনের গুণগত মান (Quality of Life) মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে, সমস্যা আরও জটিল। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, যানজট, শব্দদূষণ (বিশেষ করে রমজানে সেহরির ঢাক-ঢোল বা বিবাহের মাইকের আওয়াজ), বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে গরম, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (ভাজাপোড়া, অতিরিক্ত চা-কফি), মোবাইল ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার – এই সবকিছুই ঘুম না হওয়ার কারণ হিসেবে ক্রিয়াশীল। তাই, এই সমস্যার জরুরি টিপস জানা এবং প্রয়োগ করা শুধু কাঙ্ক্ষিত নয়, অত্যাবশ্যক।
ঘুম না হওয়ার সমাধান: ১০টি জরুরি টিপস যা আজ থেকেই শুরু করতে পারেন
এখন আসুন সেই জরুরি টিপস গুলোর কথায়, যা আপনার ঘুম না হওয়ার সমস্যা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। মনে রাখতে হবে, এই টিপসগুলো রাতারাতি জাদুর মতো কাজ নাও করতে পারে, তবে ধৈর্য ধরে নিয়মিত চর্চা করলে অবশ্যই ফল পাবেন। এগুলো মূলত ‘স্লিপ হাইজিন’ বা ঘুমের স্বাস্থ্যবিধির অংশ, যা ঘুমের গুণগত মান উন্নত করে।
- নিয়মিত ঘুমের সময়সূচি তৈরি করুন (এবং মেনে চলুন): এটিই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘুম না হওয়ার সমাধান। প্রতিদিন একই সময়ে বিছানায় যান এবং একই সময়ে ঘুম থেকে উঠুন – সপ্তাহান্তেও! এটি আপনার শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি (সার্কাডিয়ান রিদম) নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম পাবে এবং ঘুম ভাঙবে। ঢাকার কর্পোরেট প্রফেশনাল রিয়াদ হাসান শেয়ার করেন, “অফিসের চাপে রাত জেগে কাজ করতাম, সকালে দেরিতে উঠতাম। শুক্র-শনিবার রাত জেগে আড্ডা। ঘুমের সময় একদম এলোমেলো। কয়েক সপ্তাহ ধরে রাত ১১টায় বিছানায় যাওয়া এবং সকাল ৭টায় ওঠার চেষ্টা করছি। প্রথমে কষ্ট হলেও এখন শরীর নিজেই মানিয়ে নিচ্ছে।”
- বিছানাকে শুধু ঘুম (ও যৌনতা) এর জন্যই ব্যবহার করুন: বিছানায় শুয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা, ল্যাপটপে কাজ করা, টিভি দেখা বা গভীর চিন্তা করা একেবারেই বাদ দিন। আপনার মস্তিষ্ককে শেখান যে বিছানার সংযোগ শুধুমাত্র ঘুম এবং বিশ্রামের সাথে। ঘুম না হওয়ার সমস্যা দেখা দিলে ১৫-২০ মিনিটের বেশি বিছানায় শুয়ে থাকবেন না। উঠে পড়ুন, অন্য রুমে গিয়ে হালকা আলোয় কিছু শান্ত কার্যকলাপ করুন (যেমন: হালকা গান শোনা, নীরব বই পড়া) এবং ঘুম পেলে আবার বিছানায় ফিরে যান। এটি বিছানাকে ‘জেগে থাকা’ বা ‘উদ্বেগের’ জায়গা হিসেবে শেখানো থেকে রক্ষা করে।
- ঘুমের আগে রিলাক্সেশন রুটিন তৈরি করুন: ঘুমানোর কমপক্ষে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা আগে থেকে ‘উইন্ড ডাউন’ শুরু করুন। এটি আপনার শরীর ও মনকে ঘুমের জন্য প্রস্তুত করবে। এই রুটিনে কী থাকতে পারে?
- গরম পানিতে গোসল: শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বাড়িয়ে আবার নামিয়ে আনতে সাহায্য করে, যা ঘুমের সংকেত দেয়।
- হালকা স্ট্রেচিং বা যোগব্যায়াম: যেমন বালাসন (শিশুর ভঙ্গি) বা শবাসন (মৃত ভঙ্গি)। কঠিন আসন নয়, শুধু মাংসপেশি শিথিল করার দিকে মনোযোগ দিন।
- ধ্যান বা মাইন্ডফুলনেস: শান্ত জায়গায় বসে বা শুয়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর মনোযোগ দিন। চিন্তাগুলো আসতে দেয়া, কিন্তু তাতে আটকে না থাকা। গাইডেড মেডিটেশনের অডিওও সাহায্য করতে পারে।
- হালকা সঙ্গীত বা প্রাকৃতিক শব্দ: শান্ত, মৃদু সুর বা বৃষ্টির শব্দ, সমুদ্রের শব্দ মনকে শান্ত করতে পারে।
- নীরব বই পড়া (কাগজের বই): ই-বুক বা মোবাইলের স্ক্রিন নয়। পছন্দের কোনো উপন্যাস বা কবিতার বই পড়ুন।
- ঘুমের পরিবেশ তৈরি করুন: আপনার শোবার ঘর যেন ঘুমের জন্য আদর্শ হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- অন্ধকার: পর্দা টানুন, যাতে রাস্তার আলো বা ভোরের আলো ঘরে প্রবেশ না করে। আই মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। মেলাটোনিন নামক ঘুমের হরমোন অন্ধকারে নিঃসৃত হয়।
- শব্দহীনতা: যতটা সম্ভব শব্দ কমান। ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করতে পারেন। সাদা শব্দ (White Noise) মেশিন বা ফ্যানের শব্দও বাইরের বিরক্তিকর শব্দ ঢাকতে সাহায্য করে (ঢাকার মতো শহরে এটি খুবই কার্যকর)।
- শীতল তাপমাত্রা: গবেষণা বলে ঘুমানোর জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ১৮-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এয়ার কন্ডিশনার বা ফ্যান ব্যবহার করুন। বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন।
- আরামদায়ক বিছানা: ভালো মানের গদি, বালিশ এবং চাদর-তোশক ব্যবহার করুন। বালিশ যেন ঘাড়ের কার্ভকে সঠিকভাবে সাপোর্ট দেয়। কাপড় নরম এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়ক হোক।
- দিনের বেলা সূর্যের আলো নিন এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন: সকালের সূর্যের আলো আপনার সার্কাডিয়ান রিদমকে সেট করতে সাহায্য করে। দিনে কমপক্ষে ৩০ মিনিট প্রাকৃতিক আলোয় থাকার চেষ্টা করুন। নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম (যেমন: হাঁটা, জগিং, সাইক্লিং, সাঁতার, যোগব্যায়াম) ঘুমের গুণগত মান উন্নত করে। তবে, ঘুমানোর কমপক্ষে ৩-৪ ঘণ্টা আগে ভারী ব্যায়াম শেষ করুন। সন্ধ্যার পর হালকা স্ট্রেচিং বা যোগব্যায়াম করতে পারেন। চট্টগ্রামের শিক্ষিকা ফারহানা আক্তার বলেন, “সন্ধ্যায় পার্কে ৪০ মিনিট হাঁটা শুরু করেছি। আগে রাতে টিভি দেখতাম, এখন হাঁটার পর শরীরে এক ধরনের স্বাস্থ্যকর ক্লান্তি আসে, ঘুমও ভালো হয়।”
- ক্যাফেইন, নিকোটিন ও অ্যালকোহল সীমিত করুন: ক্যাফেইন (চা, কফি, কোলা, এনার্জি ড্রিংক) একটি উত্তেজক। দুপুর ২-৩টার পর ক্যাফেইন গ্রহণ একেবারে বন্ধ করুন। এটি ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত শরীরে সক্রিয় থাকতে পারে! নিকোটিনও উত্তেজক এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। অ্যালকোহল যদিও প্রথমে ঘুম পাড়াতে পারে, কিন্তু এটি ঘুমের গভীর স্তর (REM sleep) ব্যাহত করে, ফলে ঘুম ভাঙা ভাঙা লাগে এবং রাতে বারবার জেগে উঠতে পারেন। এগুলো ঘুম না হওয়ার কারণ হতে পারে।
- দুপুরের ঘুম সীমিত করুন: দুপুরে হালকা ঝিমুনি (পাওয়ার ন্যাপ) ২০-৩০ মিনিটের বেশি হওয়া উচিত নয় এবং বিকেল ৩টার পর একেবারেই নয়। দীর্ঘ বা দেরিতে দুপুরের ঘুম রাতের ঘুমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
- রাতের খাবার ও পানীয় নিয়ন্ত্রণ করুন: ভারী, মশলাদার বা চর্বিযুক্ত খাবার, বিশেষ করে ঘুমানোর ২-৩ ঘণ্টা আগে খাবেন না। হজমের সমস্যা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। অতিরিক্ত তরল গ্রহণও রাতে টয়লেটে যাওয়ার জন্য বারবার জাগতে হতে পারে। তবে, হালকা ক্ষুধা মেটাতে ঘুমানোর আগে একটু ওয়ালম মিল্ক বা এক মুঠো বাদাম (যেমন: কাঠবাদাম) খেতে পারেন, এতে ট্রিপটোফান নামক অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে যা ঘুমে সাহায্য করে। মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
- ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিন টাইম কমানো (ব্লু লাইট এড়ানো): স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ বা টিভির স্ক্রিন থেকে নিঃসৃত নীল আলো মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়, যা ঘুম আসতে বাধা দেয়। ঘুমানোর কমপক্ষে ১ ঘণ্টা আগে এই সব ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করুন। যদি একান্তই প্রয়োজন হয়, ডিভাইসে ‘নাইট মোড’ বা ‘ব্লু লাইট ফিল্টার’ চালু করুন এবং ব্রাইটনেস কমিয়ে দিন। বই পড়তে কাগজের বই বেছে নিন।
- উদ্বেগ ও চিন্তা ব্যবস্থাপনা: অনেক সময়ই ঘুম না হওয়ার কারণ হলো মাথায় ঘুরতে থাকা চিন্তা, দুশ্চিন্তা বা আগামী দিনের পরিকল্পনা। ঘুমানোর আগে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
- ‘উদ্বেগের ডায়েরি’: বিছানায় যাওয়ার আগে ১০-১৫ মিনিট সময় নিন। কাগজে-কলমে বা ফোনের নোটে আপনার সব চিন্তা, টু-ডু লিস্ট, উদ্বেগের বিষয়গুলো লিখে ফেলুন। এটা করলে মস্তিষ্ক থেকে সেগুলো ‘আউটসোর্স’ হয়ে যায় এবং ঘুমানোর সময় তা কম ভাবে।
- দিবাস্বপ্ন বা ইমাজিনেশন: শুয়ে শুয়ে নিজেকে কোনো শান্ত, আরামদায়ক জায়গায় ভাবুন (যেমন: সমুদ্র সৈকত, পাহাড়ি ঝর্ণা)। এর বিস্তারিত কল্পনা করুন – শব্দ, গন্ধ, অনুভূতি। এটি মনকে উদ্বেগ থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
- ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ: শুয়ে ৪ সেকেন্ড নাক দিয়ে শ্বাস নিন, ৭ সেকেন্ড ধরে রাখুন, ৮ সেকেন্ড মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। কয়েকবার করুন। এটি স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে।
> > মনে রাখুন: এই টিপসগুলো একসাথে প্রয়োগ করতে হবে। সবগুলোতে পারফেক্ট হওয়া জরুরি নয়, তবে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি এক সপ্তাহ চেষ্টা করেও বিশেষ উন্নতি না দেখেন, পরের সপ্তাহে আরও মনোযোগ দিন। ঘুম না হওয়ার সমাধান প্রক্রিয়া ধৈর্যের।
ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য বিশেষ টিপস: শহুরে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য ঘুম না হওয়ার সমস্যা একটু ভিন্ন মাত্রার। শহরের অনন্য চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে কিছু অতিরিক্ত কৌশল জানা দরকার:
- শব্দদূষণের বিরুদ্ধে লড়াই: ঢাকা বিশ্বের অন্যতম শব্দদূষণপূর্ণ শহর। জরুরি টিপস:
- ডবল গ্লেজিং: সম্ভব হলে জানালায় ডবল গ্লেজিং লাগান, যা শব্দ কমাতে সাহায্য করে।
- শক্ত পর্দা: ভারী, ঘন কাপড়ের পর্দা শব্দ কিছুটা আটকাতে পারে।
- হোয়াইট নয়েজ/সাউন্ড মেশিন: ফ্যানের আওয়াজ, বা ডেডিকেটেড হোয়াইট নয়েজ মেশিন বাইরের বিরক্তিকর শব্দ (যেমন: ট্রাফিক, নির্মাণ কাজ) ঢাকতে সাহায্য করে। মোবাইল অ্যাপও ব্যবহার করতে পারেন (হেডফোন ছাড়াই স্পিকারে)।
- ইয়ারপ্লাগ: ভালো মানের ফোম বা সিলিকন ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করুন। ঘুমের জন্য ডিজাইন করা আরামদায়ক ইয়ারপ্লাগ বাজারে পাওয়া যায়।
- কক্ষের অবস্থান: সম্ভব হলে শোবার ঘরটি রাস্তা থেকে দূরের দিকে বা ভবনের পেছনের দিকে রাখার চেষ্টা করুন।
- বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও গরম: গ্রীষ্মে ঘুমানোর অন্যতম বড় শত্রু।
- ইনভার্টার/জেনারেটর: নিয়মিত লোডশেডিং এলাকায় ভালো মানের ইনভার্টার বা সাইলেন্ট জেনারেটর রাখুন যাতে ফ্যান বা এসি চালু রাখা যায়।
- ব্যাটারি চালিত ফ্যান: জরুরি অবস্থার জন্য হ্যান্ডি।
- হালকা সুতি কাপড়: শোবার সময় শুধুমাত্র হালকা সুতির পাজামা-পাঞ্জাবি বা নাইট ড্রেস পরুন। সিনথেটিক কাপড় এড়িয়ে চলুন।
- ঠান্ডা পানিতে পা ভিজানো: ঘুমানোর আগে ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে রাখলে শরীরের তাপমাত্রা কমে, ঘুম আসতে সাহায্য করে।
- ব্যস্ততা ও কাজের চাপ: শহুরে জীবনের অনিবার্য অংশ।
- কাজ ও জীবনের সীমানা নির্ধারণ: অফিসের কাজ বা স্ট্রেস ঘরে, বিশেষ করে বিছানায় আনবেন না। নির্দিষ্ট সময়ের পর কাজের ইমেল/মেসেজ চেক করা বন্ধ করুন।
- ‘আমি সময়’ (Me Time): দিনের বেলা নিজের জন্য অন্তত ২০-৩০ মিনিট সময় বের করুন যা শুধু আপনার – হাঁটা, গান শোনা, প্রার্থনা, বা শুধু চুপ করে বসে থাকা। এটি স্ট্রেস কমায়।
- সাপোর্ট সিস্টেম: পরিবার ও বন্ধুদের সাথে খোলামেলা কথা বলুন। মানসিক চাপ ভাগ করে নিলে তা কমে।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন? ঘুমের ওষুধ নয়, সমাধান খুঁজুন
উপরের জরুরি টিপস নিয়মিত ৩-৪ সপ্তাহ প্রয়োগ করার পরও যদি আপনার ঘুম না হওয়ার সমস্যা তীব্র থাকে, ঘুমের মানে কোনো উন্নতি না হয়, এবং তা আপনার দৈনন্দিন কাজকর্ম, মেজাজ ও স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, তাহলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে নিচের লক্ষণগুলো থাকলে:
- রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করেও ৩০ মিনিটের বেশি সময় ধরে ঘুম না আসা, সপ্তাহে বেশিরভাগ রাতেই।
- রাতে বারবার জেগে ওঠা এবং আবার ঘুমাতে অসুবিধা হওয়া।
- খুব সকালে ঘুম ভেঙে যাওয়া এবং আর ঘুম না আসা।
- দিনের বেলা অতিরিক্ত ক্লান্তি, ঘুম ঘুম ভাব, মনোযোগের অভাব, বিরক্তি বা মেজাজ খিটখিটে হওয়া।
- কাজে বা গাড়ি চালানোর সময় ভুল বা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া।
গুরুত্বপূর্ণ: চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার মানে এই নয় যে আপনাকে ঘুমের ওষুধ (স্লিপিং পিল) দেয়া হবে। একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক (জেনারেল ফিজিশিয়ান, নিউরোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্ট) প্রথমে আপনার ঘুম না হওয়ার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। এটি হতে পারে:
- অন্তর্নিহিত শারীরিক সমস্যা: যেমন থাইরয়েডের সমস্যা, ব্যথা (আর্থ্রাইটিস, মাইগ্রেন), অ্যাসিড রিফ্লাক্স, নাক ডাকা বা স্লিপ অ্যাপনিয়া (ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হওয়া), প্রস্রাবের সমস্যা, পার্কিনসন্স, অ্যালার্জি ইত্যাদি।
- মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: যেমন অবসাদ (ডিপ্রেশন), উদ্বেগজনিত সমস্যা (অ্যাংজাইটি), পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD), বাইপোলার ডিসঅর্ডার ইত্যাদি।
- কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: যেমন কিছু উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ, অ্যাজমার ওষুধ, অ্যালার্জির ওষুধ (অ্যান্টিহিস্টামিন – কিছু প্রজন্মের), কিছু বিষন্নতা রোধী ওষুধ ইত্যাদি।
চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিতে পারেন এবং অন্তর্নিহিত কারণের চিকিৎসা করবেন। অনেক সময়ই, শারীরিক বা মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করলে ঘুম না হওয়ার সমাধান নিজ থেকেই হয়ে যায়। ঘুমের ওষুধ সাধারণত শেষ বিকল্প হিসেবে, স্বল্প সময়ের জন্য এবং চিকিৎসকের কঠোর তত্ত্বাবধানে দেয়া হয়, কারণ এর আসক্তি ও অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে। কখনো নিজে থেকে ঘুমের ওষুধ কিনে খাওয়া উচিত নয়।
কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি ফর ইনসমনিয়া (CBT-I): এটি ঘুমের ওষুধ ছাড়াই অনিদ্রার চিকিৎসার জন্য স্বর্ণমান (Gold Standard) হিসেবে বিবেচিত। একজন প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট আপনার ঘুমের ধরণ, চিন্তাভাবনা ও আচরণ বিশ্লেষণ করে নেতিবাচক ধারণাগুলো পরিবর্তন করতে এবং ঘুমের স্বাস্থ্যবিধি শক্তিশালী করতে সাহায্য করেন। বাংলাদেশেও এখন কিছু ক্লিনিক এবং মনোবিদ এই থেরাপি দিয়ে থাকেন। এটি দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই ঘুম না হওয়ার সমাধান দিতে পারে। বাংলাদেশ সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এর ওয়েবসাইটে রেজিস্টার্ড ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের তালিকা পাওয়া যেতে পারে।
জেনে রাখুন
- প্রশ্ন: “রাতে ঘুম না এলে কি করণীয়?” – কোন টিপসগুলো সবচেয়ে দ্রুত কাজ করতে পারে?
উত্তর: যদি হঠাৎ কোনো রাতে ঘুম না আসে, তবে ১৫-২০ মিনিটের বেশি বিছানায় শুয়ে না থেকে উঠে পড়ুন। অন্য রুমে হালকা আলোয় গিয়ে কোনো নীরব বই পড়ুন বা ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ করুন। ফোন বা টিভি চালু করবেন না। ঘুম পেলে আবার বিছানায় ফিরে যান। ঘুমানোর আগে গরম পানিতে গোসল বা হালকা স্ট্রেচিংও দ্রুত শিথিল করতে সাহায্য করতে পারে। তবে দীর্ঘস্থায়ী ঘুম না হওয়ার সমাধান এর জন্য নিয়মিত অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। - প্রশ্ন: “ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুম না হওয়ার সমাধান কি সত্যিই সম্ভব?”
উত্তর: হ্যাঁ, একদম সম্ভব এবং এটি কাম্যও। উপরে উল্লিখিত জরুরি টিপস (স্লিপ হাইজিন), চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে অন্তর্নিহিত শারীরিক বা মানসিক কারণের চিকিৎসা, এবং CBT-I থেরাপির মাধ্যমে বেশিরভাগ মানুষই ওষুধ ছাড়াই তাদের অনিদ্রার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন। ঘুমের ওষুধ দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয় এবং এর ঝুঁকি রয়েছে। - প্রশ্ন: “মোবাইল ফোন ঘুমের ক্ষতি করে কেন? বিকল্প কি?”
উত্তর: স্মার্টফোন/ট্যাবলেটের স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো মেলাটোনিন নামক ঘুমের হরমোনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়, ফলে ঘুম আসতে দেরি হয়। এছাড়া, সোশ্যাল মিডিয়া, খবর বা ইমেল চেক করলে মস্তিষ্ক উত্তেজিত ও চিন্তিত হয়। জরুরি টিপস: ঘুমানোর অন্তত ১ ঘণ্টা আগে সব ডিভাইস বন্ধ করুন। বিকল্প হিসেবে কাগজের বই পড়ুন, হালকা গান শুনুন (ব্লুটুথ স্পিকারে, স্ক্রিন নয়), ধ্যান করুন বা পরিবারের সাথে শান্ত আলাপ করুন। - প্রশ্ন: “বাংলাদেশে ঘুমের ডাক্তার (Sleep Specialist) কোথায় পাব?”
উত্তর: বাংলাদেশে এখন কিছু হাসপাতালে এবং প্রাইভেট ক্লিনিকে স্লিপ মেডিসিন বা নিউরোলজির বিশেষজ্ঞ আছেন যারা অনিদ্রা, নাক ডাকা, স্লিপ অ্যাপনিয়া ইত্যাদি সমস্যার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দেন। ঢাকার বড় হাসপাতাল যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (BSMMU), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, অ্যাপোলো হসপিটালস, ইউনাইটেড হসপিটাল, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ইত্যাদিতে স্লিপ স্পেশালিস্ট বা নিউরোলজিস্ট পাওয়া যায়। প্রথমে একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান বা নিউরোলজিস্টের সাথে পরামর্শ করে রেফারেল নেওয়া যেতে পারে। - প্রশ্ন: “দুধ বা মধু খেলে কি ঘুম ভালো হয়? ঘুমের জন্য কি খাবার আছে?”
উত্তর: গরম দুধে ট্রিপটোফান নামক অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে যা সেরোটোনিন ও মেলাটোনিন তৈরিতে সাহায্য করে, তাই এটি কিছু মানুষের ঘুমে সহায়ক হতে পারে। মধুও হালকা প্রভাব রাখতে পারে। তবে এটি সবার জন্য সমান কার্যকর নয়। ঘুমানোর আগে হালকা নাস্তা হিসেবে কলা (ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম সমৃদ্ধ), এক মুঠো বাদাম (কাঠবাদাম, আখরোট – ট্রিপটোফান ও ম্যাগনেসিয়াম), ওটমিল বা চেরি (প্রাকৃতিক মেলাটোনিনের উৎস) খাওয়া যেতে পারে। ভারী খাবার, চিনি বা মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন। - প্রশ্ন: “শব্দদূষণে ঘুম না এলে ঘুম না হওয়ার সমাধান কি?” (বিশেষ করে ঢাকায়)
উত্তর: ঢাকার মতো শহরে শব্দদূষণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জরুরি টিপস হিসেবে ভালো মানের ইয়ারপ্লাগ (ফোম বা সিলিকন), হোয়াইট নয়েজ মেশিন বা ফ্যানের শব্দ ব্যবহার করুন। জানালায় ডবল গ্লেজিং বা ভারী পর্দা লাগান। ঘুমানোর সময় এয়ার কন্ডিশনার চালু রাখলে এর আওয়াজও কিছুটা সাহায্য করে। সম্ভব হলে শোবার ঘরটি রাস্তা থেকে দূরে বা ভবনের পেছনের দিকে রাখার চেষ্টা করুন। কিছু লোক সাদা শব্দের অ্যাপও ব্যবহার করেন।
ঘুম না হওয়ার সমাধান শুধু ক্লান্তি দূর করার উপায় নয়; এটি আপনার সামগ্রিক সুস্থতা, উৎপাদনশীলতা, মানসিক ভারসাম্য এবং জীবনের আনন্দ ফিরে পাওয়ার চাবিকাঠি। উপরে আলোচিত জরুরি টিপস – নিয়মিত ঘুমের রুটিন, ঘুমের পরিবেশ উন্নয়ন, রিলাক্সেশন কৌশল, জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন এবং প্রয়োজনে পেশাদার সাহায্য নেওয়া – এই সমস্তই আপনার রাতের শান্তি এবং দিনের সজীবতা পুনরুদ্ধারের হাতিয়ার। তাসনিমার মতো আপনিও আজ থেকেই একটি টিপস বেছে নিয়ে শুরু করুন। এক সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করে দেখুন, তারপর আরেকটি যোগ করুন। আপনার শরীর এবং মন কৃতজ্ঞতা জানাবে। মনে রাখবেন, ধৈর্য্য ও নিয়মিত চর্চাই সাফল্যের মূলমন্ত্র। আজ রাত থেকেই আপনার ঘুম না হওয়ার সমস্যা কাটিয়ে ওঠার পথে যাত্রা শুরু করুন – একটি গভীর, পুনরুজ্জীবিত ঘুমের প্রত্যাশায়। আপনার সুস্থ রাত আর প্রাণবন্ত ভোরের জন্য শুভকামনা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।