লাইফস্টাইল ডেস্ক : গোল মরিচ লতাজাতীয় উদ্ভিদ।পান গাছ, ওদাল, বেত ইত্যাদির মত গোলমরিচ এক পরাশ্রয়ীগাছ। এজন্য গোলমরিচের অন্য গাছের আশ্রয় প্রয়োজন।আম, সুপারী, কাঁঠাল, মান্দার, তেঁতুল, নারিকেল, তাল, সিলভার, অক, টিক, খেজুর ইত্যাদি গাছগোলমরিচের আশ্রয়ী হিসেবে ব্যবহার হয়।এছাড়া অমসৃণ ছাল থাকা গাছে গোলমরিচ গাছ ওঠারজন্য সুবিধা হয়।
গোলমরিচের চারা উৎপাদন পদ্ধতি
সাধারণত গোলমরিচের চারা ডালের কলম থেকে তৈরি করাহয়।গোলমরিচের গাছের গোড়ার অংশকে ‘রানার’বলা হয়। রানারের প্রতিটি গাঁটথেকে শিকড় বের হওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে। রানারের প্রতি তিনটি গাঁটের একটি অংশ কেটে নিয়ে আশ্রয়ী গাছের কাছে ‘সরা’লাগিয়ে দিতে হয়। মাটির সঙ্গে ৩ : ১ অনুপাতে দাগ দিয়ে একটি পালংতৈরি করে তাতে গোলমরিচের ডাল থেকে তিনটি গাঁটযুক্ত কলম কেটে লাগাতে হবে। এক থেকে দেড় মাস পর ওইকাটিং থেকে শিকড় বেরিয়ে আসবে। তখন পলিথিন ব্যাগে ৪ ইঞ্চি করে ৩ ভাগ দো- আঁশ মাটি ভর্তি করেওই শিকড়যুক্ত কাটিং থেকে সাবধানে উঠিয়ে পলিথিন ব্যাগে রোপণ করে দিতে হবে। রোপণেরপূর্বে বাঁশের কাঠি দিয়ে পলিথিন ব্যাগের মাটিতে গর্ত করে নিয়ে শিকড়যুক্ত কাটিং লাগাতে হবে।৪৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে একটি সুন্দর চারা গজাবে। সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসচারা উৎপাদনের পক্ষে উপযুক্ত সময়।
দ্রুত চারা উৎপাদনপদ্ধতি
ব্যবসায়িক ভিত্তিতে গোলমরিচের চারা উৎপাদনের জন্য দ্রুত চারা উৎপাদন পদ্ধতি কার্যকর।একটি গাছ থেকে বছরে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ টি চারা উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য একটি ছায়াঘর তৈরি করতে হবে। প্লাস্টিকের তৈরি বিশেষ ধরনের শেডনেট ব্যবহার করে ছাউনিও তৈরি করা যায়। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বৃষ্টির পানি আটকানোর ক্ষমতা বিশিষ্ট এ নেটের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ রোদ প্রবেশ করতে পারে। ঘরের বাঁশের খুঁটির সারির উচ্চতা হতে হবে প্রতি ৩ মিটার এবং এবং দুপাশের খুঁটির উচ্চতা হবে ২মিটার। ঘরের মধ্যে ১মিটার দূরত্ব বজায় রেখে ৭৫ সেন্টি মিটার গভীর এবং ৩০ সেন্টি মিটার প্রস্থের নালা তৈরি করতে হবে। নালাগুলো বালিমাটি, কম্পোস্ট, কাঁঠালের গুঁড়ো এবং সারমিশ্রিত মাটি সমানভাগে মিশিয়ে ভর্তি করতে হবে। এখন ওই নালার এক ফুট অন্তর অন্তর ভাল জাতের সুস্থচারা ‘মাতৃগাছ’হিসেবে রোপণ করতে হবে।দুই নালার মধ্যবর্র্তী জায়গার দুই মাথায় খুটিপুঁতে মাটির সঙ্গে আনুভূমিকভাবে একটি লম্বা বাঁশ বেঁধে দিন।
এবারে একটি বেথু বাঁশের১.২৫ মিটার লম্বা টুকরোকে দুভাগে ভাগ করে প্রতিটি মাতৃগাছের গোড়ায় বসিয়ে মাঝেরবাঁধা আনুভূমিক বাঁশ হেলান দিয়ে রাখুন যাতে আধখানা বাঁশের টুকরো মাটির মাটির সঙ্গে ৪৫ ডিগ্রি কোণ তৈরি করে। এবারে আধখানা বাঁশের টুকরোতে বালু কাঠের গুঁড়ো, কম্পোস্ট ১:১:১ অনুপাতে ভালভাবে মিশিয়ে ভর্তি করুণ। গোলমরিচের প্রতিটি গাঁট মাটির সংস্পর্শে বেঁধেদিন, এর ফলে প্রতি গাঁট থেকে শিকড় বেরিয়ে আসবে। ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে গোলমরিচের লতা আধখানা বাঁশের মাথা পেরিয়ে যাবে। এসময় লতার আগা কেটে নিন এবং গাছের গোড়ার তিনটি গাঁটের উপর লতা থেতলে দিন।তখন পাতার কোলে থাকা অঙ্কুর বাড়তে আরম্ভ করবে। ১০ দিন পর থেতলানো পাতার উপরের লতাটি কেটে ফেলুন। এরপর প্রতিটি শেকড় গাঁট থেকে আলাদা করে কেটে ফেলুন।৪ইঞ্চি পলিথিন ব্যাগে বালি-মাটি, কাঠের গুঁড়ো ও কম্পোস্ট সমানভাবে মিশিয়ে ওই একটি গাঁটযুক্ত কাটিং রোপণ করতে হবে। সব সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে শিকড় নষ্ট না হয়। পলিথিন ব্যাগকে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে এবং দুতিন দিন পর পর পানি সেচ দিতে হবে। ৩ সপ্তাহের মধ্যে কাটিংয়ে নতুন পাতা গাঁট থেকে ছাড়তে আরম্ভ করবে। এভাবে অতি কম সময়ের মধ্যে গোলমরিচের চারা উৎপাদন সম্ভব।
বংশ বিস্তার
গোলমরিচের বংশ বিস্তার পদ্ধতি খুবই সহজ। গোলমরিচের বীজ থেকে বংশ বৃদ্ধি করা যায়। এতে উৎপাদনে আসতে বেশি সময় লাগে। গোলমরিচের গুণাগুণ মাতৃগাছের মত না-ও হতে পারে। সেজন্য সাধারণত অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে গোলমরিচের বংশবৃদ্ধি করা হয়। সাধারণত এক মুকুল একপত্রীকাটিং -এ বংশবৃদ্ধি করা হয়। এ পদ্ধতি থেকে খুব সহজে গোলমরিচের চারা উৎপাদন করা যায়। শাখা রোপণে গাছ তৈরি হয় এবং গাছগুলো খুব সহজে বড় হয়।
আশ্রয় গাছ হিসেবে মান্দার গাছ গোলমরিচের জন্য ভাল। এ গাছটি সোজাভাবে বাড়ে এবং শাখা-প্রশাখার সংখ্যা কম থাকে। গাছের ছাল অমসৃণ এবং এ থেকে এক প্রকার আঁঠা জাতীয় পদার্থ বের হয়। মান্দার গাছের শাখাগুলো যখন গোলমরিচ গাছের উচ্চতা সীমিত রাখার জন্য কাটতে হয়, তখন কোন অনিষ্ট হয় না। মান্দার শুটি জাতীয় গাছ। ফলে বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন মাটিতে ধরে রাখতে পারে। এতে মাটি সমৃদ্ধ হয়।
চারা রোপণ পদ্ধতি
গোলমরিচের চারা দুই প্রকারে রোপণ করা যায়। যদি বাগানে সুপারি, নারকেল, আম, মান্দার, কাঁঠাল ইত্যাদি আশ্রয় গাছ হিসেবে ব্যবহারের গাছ থাকে, তখন ওই গাছ থেকে দেড় হাত দূরে, দেড় হাত দৈর্ঘ্য, দেড় হাত প্রস্থ এবং দেড় হাত গভীর গর্ত করতে হয়। গোবর, পচনসার, বালিযুক্ত মাটি দিয়ে গর্তটি পূরণ করে চারা রোপণ করতে হয়। গাছ উঠার সুবিধার জন্য বাঁশের অবলম্বন দেয়া প্রয়োজন।
নতুন জায়গায় গোলমরিচের চাষ করতে হলে প্রথমে আড়াই হাত থেকে চার হাত দূরত্বে এক হাত দৈর্ঘ্য এক হাত প্রস্থ এবং এক হাত গভীর গর্ত করে উপরে উল্লেখ করা মত গর্ত পূরণ করতে হয় এবং সেখানে আশ্রয় গাছের দক্ষিণ দিক ছেড়ে চারা লাগাতে পারেন ওই একই নিয়মে। প্রয়োজনে চারাগাছে ছায়া দেয়া উচিত।
সার প্রয়োগ: প্রতি গাছে নিম্ন অনুমোদিত হারে সার প্রয়োগ করা উচিত। সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় চৈত্র-বৈশাখ মাস।
যত্ন: গোলমরিচের লতাগুলো দ্রুত বৃদ্ধির জন্য আশ্রয় গাছের সাথে বেঁধে দিতে হয়। গাছের গোড়া থেকে ৩ হাত উপর পর্যন- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন। গোলমরিচ গাছ যাতে ৯ হাতের বেশি উঠতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
জলবায়ু: গোলমরিচ চাষের জন্য উষ্ণ আদ্রতাযুক্ত জলবায়ু এবং সমানুপাতিকভাবে সমস- বছর বৃষ্টি থাকা বিশেষ প্রয়োজন। উল্লেখযোগ্য যে, গোলমরিচের পরাগ সংযোগ বৃষ্টির উপর নির্ভর করে। গোলমরিচ চাষের জন্য বার্ষিক ২৫০০ মিঃ মিঃ বৃষ্টি এবং ১০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমান আবশ্যক। দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টি অথবা খরা পরিস্থিতি গোলমরিচ চাষের জন্য খারাপ।
মাটি: অব্যবহৃত বা পতিত জমিতে উচ্চ জৈব সার বিশিষ্ট পানি জমে না থাকা, পাহাড়ের লালমাটি গোলমরিচ চাষের জন্য বেশি উপযোগী। বন্যা কবলিত অঞ্চল ছাড়া বেলে দো-আঁশ মাটিতে গোল মরিচের চাষ করা যায়। আদ্রতাহীন মাটি গোলমরিচ চাষের জন্য অনুপযোগী।
জাত: ১ (হাইব্রিড), কারিমুণ্ডা, বালনকাট্টা, কল্লুভেল্লি, আরকুলপাম মুণ্ডা প্রভৃতি।
রোপণে সময়: গোলমরিচ সাধারণত ভাল জাতের গাছ বা বীজ বৈশাখের ১০ থেকে ১৫ দিন থেকে আষাঢ়ের ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন- চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
রোগবালাই: গোলমরিচে এক প্রকার ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায়। শ্রাবণ ও কার্তিক মাসে প্রতি ৫ লিটার পানিতে এক চা চামচ ‘এন্দোসালফার ৩৫ ইসি’ বা কুইনলফস বা ডাইমিথয়েট ৩০ ইসি প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া যায়। এছাড়া ঝরে পড়া রোগের জন্য বর্ষাকাল আরম্ভ হওয়ার আগে বরডঙ্ মিশ্রণ প্রয়োগ করতে হয়।
ফসল কাটা ও সংরক্ষণ
গোলমরিচের ছড়িতে যখন দুএকটি গোলমরিচ হলুদ রঙের হয় তখন মই দিয়ে উপরে উঠে ফসল কেটে নিয়ে ছড়িগুলো মেলে রাখতে হয়। গোলমরিচগুলো পৃথক করে ৪-৫ দিন রোদে শুকাতে হয়। গোলমরিচ ভালভাবে শুকিয়ে গেলে কালো ও আকারে ছোট হয় এবং তারপর বাজারজাত করতে হয়।
ব্যবসা-অর্থনীতি
গোলমরিচ রোপণের তিন বছর থেকে উৎপাদন শুরু হয়। যদিও ৭-৮ বছর থেকে পুরোপুরি উৎপাদন চলে আসে। প্রতি গাছ থেকে ৫-৬ কেজি কাঁচা গোলমরিচ উৎপাদন হয়। কাঁচা গোলমরিচ থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ শুকনো গোলমরিচ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, একটি গাছ থেকে গড়ে দেড় থেকে দুই কেজি শুকনো গোলমরিচ পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ৫০০ টাকা হলে একটি গোলমরিচের গাছ থেকে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা উপার্জন করা যায়। হিসেব অনুযায়ী একটি গাছের জন্য খরচ প্রায় ৩৫ টাকা। সুতরাং খরচের তুলনায় লাভ যথেষ্ট।
সম্ভাবনাময় গোলমরিচ চাষে কৃষকরা আরও উদ্যোগী হবেন। প্রতি জেলাতে কৃষি বিভাগ গোলমরিচ চারা জোগান ও কৃষি বিভাগের খামারে গোলমরিচ চারা উৎপাদন করা হয়। এ ব্যাপারে সচেতন কৃষকরা সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।-
লেখক: আফতাব চৌধুরী, সিলেট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।