জুমবাংলা ডেস্ক : বেগুনের নাম কেন বেগুন হয়েছে, সে রহস্য উৎঘাটন খুব সহজ নয়। বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় অতি চেনা এই সবজিটির নামকরণ করা হয়েছে বড় হেলাফেলা করে। নামে তার যত নির্গুণের বহি প্রকাশ থাকুক না কেন বাস্তবে কিন্তু ঠিক তার উল্টা। বেগুনের বেগুনি বা সবুজ বর্ণের যে চামড়া তার যে উচ্চ মাত্রার এন্টিঅক্সিডেন্ট গুনাগুন রয়েছে, তা এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছে। রয়েছে বহু রকমের ছোট বড় ডিমবাকার বেগুনের জাতও।
তেমনি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গফরগাঁওয়ের লাফা বেগুন (গোল বেগুন) একটা সময় ছিল যখন, গফরগাঁও রেলষ্টেশনে হকার ডাক ছেড়ে বলছে, লাগবনি ভাই লাগবনি গোল বাইগুন লাগবনি। ভাই আইলে নারে/দেখলে নারে/খাইলে নারে গফরগাঁওয়ের গোল বেগুন। এমন গানের সুর শুনা যেত ব্রক্ষপুত্র নদের পাল তোলা নৌকার মাঝিমাল্লার, মাঠেঘাটে কৃষক শ্রমিকের মুখে মুখে এ বেগুন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে নানা গান, কবিতা। এর এখনো এসব গান কবিতা মানুষের মুখে মুখে।
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের লাফা বেগুনের স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। বেগুনের আকৃতি গোল কিন্তু দেহ মসৃণ নয়। ডেউ খেলানো খাঁজ কাটা। দেশের ঐতিহ্যবাহী এ বেগুনের নাম লাফা বেগুন। অনেকেই একে গোল বেগুন বলে ডাকে। বড়া ও ভাজির জন্য প্রসিদ্ধ ও সুস্বাদু এ লাফা বেগুন।
কথিত আছে আগে কোন বিয়ের উৎসবে ঐতিহ্যবাহী লাফা বেগুন খাদ্যের তালিকায় না থাকলে বরপক্ষের খাবারে অপূর্নতা থেকে যেত। এমন ঘটনা ঘটেছে বরকে বড় থালায় খাবার দেওয়া হলে সেই থালা লাফা বেগুনের ভাজা না থাকলে বর বিয়েতে অস্বীকৃতি জানাতো।
অতীতে এক হালি (প্রায় ১০ কেজি) বেগুন নিয়ে বড় কোন কর্মকর্তার দরজায় হাজির হলে মিলে যেত সরকারি চাকরি। এখন নানা সমস্যার কারণে বিলুপ্তি হয়ে গেছে লাফা বেগুন আাবারো চাষ করছে গফরগাঁওয়ের চরআলগী নয়াপাড়া গ্রামের কৃষক হাফিজ উদ্দিন ও ছামিদ মিয়া।
এক সময়ে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার চরআলগী ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় লাফা বেগুনের চাষ হতো। একটি বেগুনের ওজন হতো ২/৩ কেজি পর্যন্ত কোন প্রকার সার প্রয়োগ ছাড়াই এ বেগুন উৎপাদন হতো।
কোন রকম অপবিত্র শরীর নিয়ে লাফা বেগুন ক্ষেতে গেলে কয়েকদিন পরেই বেগুনের গাছ মরে যায়। ব্রক্ষপুত্র নদের ভাঙ্গনে লাফা বেগুন চাষাবাদের জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। লাফা বেগুনের উন্নত বীজ কোথাও না পেয়ে কৃষকরা নিরূপায় হয়ে লাফা বেগুনের পরিবর্তে বিভিন্ন জাতের বেগুন চাষ করছে এদের মধ্যে হলো: তাল বেগুন, ভোলানাথ, সিংনাথ, ইসলামপুরী, বারী বেগুন, খটখটিয়া, তারা ও ঝুড়ি বেগুনের চাষ।
কৃষক হাফিজ উদ্দিন জানান, বিলুপ্ত হওয়া এই লাফা বেগুনের বীজ অনেক কষ্ট করে ইসলামপুর থেকে এনে এক একর পঞ্চাশ শতাংশ জমিতে আমরা চাষ করেছি। প্রায় ৯০ থেকে ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। গত সোমবার পর্যন্ত বিক্রি করেছি প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকার মত। চলতি মৌসমে বাজারে ৪ হাজার ৮শ’ ৫ হাজার পর্যন্ত ১ মণ বেগুন বিক্রি করছি। দর ভাল থাকায় আশা করছি ,সর্ব মোট প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকার উপরে বেগুন বিক্রি করতে পারব বলে জানান ছামিদ ও হাফিজ উদ্দিন।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে ৭শ’ ৫০ একর জমিতে বিভিন্ন জাতের বেগুনের চাষ হচ্ছে। উপজেলার চরআলগী, টাঙ্গাব, দত্তের বাজার ও সালটিয়া ইউনিয়নে বেগুনের চাষ হয়ে থাকে। এই ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ১৬শ’ পরিবার বেগুন চাষে সুফল ভোগ করবে। চরআলগী ইউনিয়নের লাফা বেগুন বাংলাদেশের ঐতিহ্য এটাকে আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি বলে জানান উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম তুহিন।
কৃষক রিপন, গোলাম হোসেন বলেন, লাফা বেগুন চাষের জন্য উন্নত বীজ না থাকায় এর বিকল্প হিসেবে আমরা ভোলানাথ ও ইসলামপুরী বেগুনের চাষাবাদ করছি। ইসলামপুরী ও ভোলানাথ বেগুন দেখতে অনেকটা লাফা বেগুনের মত দামও ভাল। তবে খাওয়ায় স্বাদ কম। এবার চরআলগী ইউনিয়নের হাফিজ উদ্দিন ও ছামিদ মিয়া ২৪ বছর পর লাফা বেগুনের চাষ করে গফরগাঁও তথা ময়মনসিংহের ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
লাফা বেগুন এর অপর চাষী জীবন মিয়া জানান, বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে দু-একজন চাষী লাফা বেগুনের চাষ করেন। আগের মত আর এখন লাফা বেগুনের চাষ হয়না। ভরা শীত মৌসুমে চলে লাফা বেগুনের চাষ। রাতের শেষ প্রহরে মাটির অলট-পালট করে দিতে হয়। প্রতি সপ্তাহে অল্প সেচ দিতে হয়।
এ জাতের বেগুন গাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণ রস টেনে নেয়। কৃষক জীবন মিয়ার দাবী জরুরী ভিত্তিতে লাফা বেগুনের ভাল বীজ সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রকিব-আল-রানা বলেন, চলতি রবি মৌসুমে আমরা কৃষকদেরকে আগাম সবজিসহ লাফা বেগুনের চাষে সব রকম সহযোগিতা করে আসছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছে এক ইঞ্চি জমিও অনবাদি রাখা যাবে না, বর্তমানে কৃষি বিভাগ চরাঞ্চলে অনাবাদী জমিসহ সব জমিতেই ফসল চাষ করার জন্য বিনামূল্যে বীজ, সারসহ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
ময়মনসিংহ জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মতিউজ্জামান বলেন, গফরগাঁওয়ের আবহাওয়া ও মাটি বেগুন চাষের জন্য উপযোগী। আশা করছি, চলতি রবি মৌসুমে বেগুন চাষ আমাদের লক্ষ্য মাত্রা এবং উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে চলতি রবি মৌসুমে প্রায় ২০ কোটি টাকার বেগুন উৎপাদন হবে গফরগাঁওয়ে।
তিনি আরও বলেন, হারিয়ে যাওয়া লাফা বেগুনের বীজ সংগ্রহ করে কৃষক ছামিদ ও হাফিজ উদ্দিন যে ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে তাকে সহায়তার জন্য কৃষি বিভাগ সব সময় তৎপর। সূত্র : জনকণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।