মারওয়ান বিশারা : মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব উদ্ধার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এ সপ্তাহে সৌদি আরবে তিন দিনের সফর করছেন। কিন্তু সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ‘কৌশলগত সহযোগিতা’ সম্প্রসারণ তাঁর জন্য কঠিন যুদ্ধ হতে পারে। গত বছরের জুলাই মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) সম্মেলনে অংশ নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন– ‘চীন, রাশিয়া বা ইরান পূরণ করতে পারে এমন কোনো শূন্যতা তৈরি করবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।’ কিন্তু এর পরই তেমনটা ঘটেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও গত বছর তাদের আঞ্চলিক মিত্ররা চীন ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ঘটিয়েছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান চুক্তির গুরুত্বকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করেছে। বস্তুত যুক্তরাষ্ট্র তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চল এবং বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে।
জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র তেল ও গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়েছে। দেশটির হয়তো উপসাগরীয় দেশগুলোর তেল খুব বেশি প্রয়োজন হবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার প্রভাব বজায় রাখার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়; যাতে সংঘাত বাধলে চীনে অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করতে পারে এবং তাদের মিত্রদের সুরক্ষিত করতে সক্ষম হয়। গত মাসে অ্যান্টনি ব্লিংকেন যেমনটা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন– ‘আজ আমরা যে দেশ থেকে সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছি, সেটি চীন। আমাদের অবাধ, উন্মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ আন্তর্জাতিক সীমানা প্রতিষ্ঠার যে ভিশন রয়েছে, সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে সংকট তৈরি করছে চীন।’
বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বিপরীতে চীনে যে ধরনের একনায়কতন্ত্র রয়েছে, তার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর একনায়তন্ত্র সহজে মিলে যায়। যে কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও এর বাইরে রাশিয়ার প্রভাবও যুক্তরাষ্ট্রকে ভীত করছে। বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের ওপর যেভাবে চাপ বাড়িয়েছে, এতে স্পষ্ট– এ ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের দেশগুলোকে হুমকি দিচ্ছে, যাতে তারা রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সহায়তা না করে। এমনকি সতর্ক করে বলেছে, তারা রাশিয়ার পক্ষ বেছে নিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জি৭-এর দেশগুলোর ক্রোধের মুখে পড়বে। কিন্তু এতে তারা সফল হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র তেল উৎপাদন বাড়িয়ে বাজারমূল্য কমানোর ব্যাপারে সৌদি আরবকে অনুরোধ করেছে, যাতে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা প্রভাবিত করে। কিন্তু সৌদি আরব তা প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটি বরং মস্কোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখছে এবং ইউক্রেনকে সমর্থনের ব্যাপারে অযথা দেরি করছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেভাবে অসহযোগিতা করছেন, তা তাঁকে এ অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলছে।
গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরবের আচরণের কারণে যে শাস্তির হুমকি দিয়েছিলেন, তার বিপরীতে রিয়াদ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। শি এমনকি চীন-জিসিসি এবং চীন-আরব সম্মেলনেও যোগ দেয়। এর পর সৌদি আরব চীনের অভিপ্রায় অনুসারে ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করে। পশ্চিমারা ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরও জোরালো করার কারণে সৌদি আরব যেভাবে ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায় এবং সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করে, সেটি বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চপেটাঘাত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন এই আচরণ কেবল সৌদি আরবের একার বিষয় নয়; গোটা অঞ্চলের অবস্থা তথৈবচ। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির দিকে এগোচ্ছে। দেশটি ফ্রান্সের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে। ইরান, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে কাজ করার পথে হাঁটছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক হালকা করছে।
এভাবে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই তাদের বৈশ্বিক সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনছে। বলা চলে, এটা তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ১৫ দশমিক ২ বিলিয়ন থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিক একই সময়ে এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্য ৬৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন থেকে মাত্র ৯৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ সম্প্রতি চীনের নেতৃত্বাধীন ব্রিকসে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। ব্রিকসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চীন ছাড়াও রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার পরও এমনটি দেখা যাচ্ছে।
হ্যাঁ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত প্রভাবশালী শক্তি। গত তিন দশকে যেমন এ অঞ্চলে দেশটির প্রভাব ছিল, এখনও তেমনটি আছে। কিন্তু আগামী তিন দশকে কী এ প্রভাব থাকবে? বিশেষ করে যেখানে এ অঞ্চলের মানুষ মনে করে, আমেরিকা একটি কপট ঔপনিবেশিক শক্তির অধিকারী এবং তাদের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা কেবল মুখের বলি। এটি হচ্ছে বিশেষ করে ফিলিস্তিন বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির কারণে। তারা দৃঢ়ভাবে এবং কোনো শর্ত ছাড়াই ফিলিস্তিন দখলকারী ইসরায়েলকে সমর্থন করছে।
সৌদি আরব সফরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সৌদি আরবের ওপর চাপ দেওয়ার কথা। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান ইতোমধ্যে আমেরিকা থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে; যেমন মার্কিন তৈরি এফ-৩৫ কিনেছে আবুধাবি; পশ্চিম সাহারার ওপর মরক্কোর দাবির স্বীকৃতি দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং খার্তুমের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। এ সবকিছু হচ্ছে যাতে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন বিষয়ে কোনো ‘ছাড়’ দিতে না হয় এবং ফিলিস্তিনে কয়েক দশক ধরে চলা দখলদারিত্বের অবসান না ঘটে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ফিলিস্তিন রয়েছে সাধারণ আরবদের হৃদয়ের মণিকোঠায়। তবে এটিই একমাত্র সমস্যা নয়, যে কারণে আরবরা আমেরিকাকে পছন্দ করে না। এ অঞ্চলের মানুষ দেখেছে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র কী অপরাধ করেছে। তারা দেখেছে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র কী করেছে। ৯/১১-এর হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের আচরণের কারণে ২০ বছরের অধিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ দেশটির পক্ষে নয়। ২০২২ সালে দোহাভিত্তিক আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ ১৪টি আরব দেশের ওপর একটি জরিপ করে। সেখানে ৭৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এমনকি এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীরা (এবং আমেরিকানরা) একমত– যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হওয়া কাম্য। এ ধরনের মত উভয় পক্ষের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
মারওয়ান বিশারা: জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক; আলজাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।