বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : বিগত ১৫ বছর ধরে বিশ্বের প্রযুক্তি জগতে গুগল ছিল অদম্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশেষ করে সার্চ ইঞ্জিন এবং ডিজিটাল অ্যাডভারটাইজিং ব্যবসায়ের জন্য গুগল ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। তবে গুগলের একক আধিপত্যের দেয়ালে সম্প্রতি ফাটল ধরতে শুরু করেছে।
গুগলের মাতৃপ্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী এর মোট কর্মীর ৬ শতাংশ অর্থাৎ ১২ হাজার কর্মীকে ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির সিইও রাজস্ব হারানোর কথাও স্বীকার করে নিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে গুগলের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস। তাদের অভিযোগ গুগল ডিজিটাল অ্যাডভারটাইজিংয়ের ক্ষেত্রে অবৈধভাবে নিজেদের একক আধিপত্য গড়ে তুলেছে। এর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারও একই মামলা করেছিল।
তবে গুগল এ মামলাগুলোকে বলেছে, ত্রুটিপূর্ণ যুক্তির পুনরাবৃত্তি। যাই হোক, গুগল নিশ্চয়ই চাইবে এ দুই মামলায় জিততে। জিতে গেলে গুগলের চলমান বিজ্ঞাপন ব্যবসা আরও শাণিত হবে। বিপরীতে মার্কিন বিচার বিভাগ এবং সরকার জয়ী হলে গুগলের একক আধিপত্য খর্ব হবে। ২০ বছর আগে মার্কিন সরকার আরেক টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিল এমনই এক ‘অ্যান্টিট্রাস্ট’ মামলায়।
এ মামলাগুলো দীর্ঘ সময় চলার সম্ভাবনা রয়েছে এবং দীর্ঘ সময় পর যদি গুগল জিতেও যায় তাতেও আসলে বিপদের শেষ হচ্ছে না। কারণ আরও দুটো বিষয় গুগলের পথের কাঁটা হওয়ার জন্য হাজির হয়ে গেছে। এক. জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা সৃষ্টিশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং গুগলের অনলাইন মার্কেট শেয়ারের ত্বরিত পতন।
সার্চিংয়ে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী
দীর্ঘ সময় ধরে গুগল ছিল অনলাইন সার্চিংয়ের প্রধান টুল। গুগল এত বেশি জনপ্রিয় যে, প্রথম আধুনিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর নাম ক্রিয়াপদে পরিণত হয়েছে। তবে গুগলের সেই সুদিন ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে গত বছরের নভেম্বর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই চ্যাটজিপিটি চ্যাটবট টুলটি নামানোর ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের প্রতি মানুষের আগ্রহ কিঞ্চিৎ কমতে শুরু করেছে।
চ্যাটজিপিটি সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি কবিতা লেখা থেকে শুরু করে যেকোনো কঠিন তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেয়া সবই পারে। এটি যেকোনো প্রশ্নের দীর্ঘ উত্তর দিতে সক্ষম। তবে এখনো চ্যাটজিপিটি অনেক ছোট ছোট প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ২৫তম প্রেসিডেন্ট কে? এর জন্য এখনো গুগলেরই সহায়তা নিতে হবে।
তবে তাতেও গুগলের নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ থাকছে না। এ বিষয়ে জিমেইলের অন্যতম নির্মাতা পল বুসিট গত বছরই এক টুইটে বলেছিলেন, ‘গুগল সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার আগে সম্ভবত এক থেকে দুই বছর সময় পাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের প্রয়োজনীয়তাকে নাই করে দেবে। এমনকি গুগল যদি নিজেরাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করে তারপরও তাদের মূল ব্যবসা বিজ্ঞাপন থেকে লাভের একটা বড় অংশ হারাতে হবে।’
গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই তার কর্মীদের বলেছেন, গুগলেরও চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা রয়েছে। তারপরও গুগল ভুল তথ্য দিতে পারে এ ভয়ে এখনো এইআইভিত্তিক সার্চিং চালু করতে পারেনি। এমনটা বেশিদিন চলতে থাকলে তা গুগলের ভবিষ্যতের জন্যেই খারাপ হবে।
তবে গুগলের জন্য একটি ইতিবাচক দিক হতে পারে এর নির্ভুল উত্তর দেয়ার সক্ষমতা। কারণ, এআইর নকশার কারণেই অনেক সময় জানতে পারা যায় না যে, এআই সেই তথ্যটি কোথা থেকে হাজির করল। কিন্তু গুগল সেটি নিশ্চিত করতে পারে। ফলে গুগল এক্ষেত্রে এআইর চেয়ে কিছুটা এগিয়েই থাকবে।
চাপের মুখে বিজ্ঞাপন বিক্রয়
মার্কিন সরকারের মামলা, এআইর শক্তিশালী উত্থান – এসবই ঘটেছে যখন গুগলের বিজ্ঞাপন থেকে আয় ক্রমেই কমতে শুরু করেছে। ২০১৭ সালে গুগল বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল। সে বছর গুগল যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞাপন বাজারে ৩৪.৭ শতাংশ একা দখল করেছিল। কিন্তু ২০২২ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ২৮.৮ শতাংশে।
গুগলের মতো অন্যান্য টেক জায়ান্টও একই হারে বিজ্ঞাপন থেকে আয় হারাচ্ছে। মেটা, অ্যাপল ইত্যাদিও এ একই কাতারে রয়েছে। তবে আয় কমে যাওয়ার অর্থ হলো গুগল এখন আর এককভাবে তার আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে না। তাকে টিকটক, অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানকেও মোকাবিলা করতে হবে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বিক্রির জগতে।
তারপরও গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবসা এখনো অন্যদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। যার লভ্যাংশ থেকে গুগল এআই সংক্রান্ত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করাটা খুবই স্বাভাবিক হবে। তবে মার্কিন সরকারের মামলা গুগলকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। মার্কিন আদালত হয়তো সরকারের যুক্তি, গুগলের একচেটিয়াত্ব ভেঙ্গে দিলে তা ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজারে প্রতিযোগিতা ফিরিয়ে আনবে এবং গ্রহণ করবে। সেক্ষেত্রে গুগলকে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে। তবে এআইর উত্থান এবং বিজ্ঞাপনের বাজারে লাগাম টানার মামলায় গুগলকে ভালো মতোই বেকায়দায় ফেলেছে। এ দুই গেরো উতরাতে না পারলে বলা যায় না, গুগলের একক আধিপত্য হ্রাস পাওয়াও শুরু হতে পারে।
(সিএনএন থেকে সংক্ষেপে অনূদিত)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।