কাঠফাটা রোদের দুপুরে একটু হাঁটাহাঁটি, কিংবা সমুদ্রে একটু ভিজতে গিয়ে ফিরে এসে দেখলেন মুখ-গলা-হাত লাল হয়ে ফুলে উঠেছে? ত্বকে টানটান ভাব, জ্বালাপোড়া, এমনকি স্পর্শ করলেই যন্ত্রণা? এটাই সানট্যান বা সানবার্ন। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (UV রে) ত্বকের উপরের স্তরকে পুড়িয়ে দেয়, জলীয় অংশ শুষে নেয়, আর রেখে যায় অসহ্য যন্ত্রণা। কিন্তু চিন্তা করবেন না! আপনার রান্নাঘরেই লুকিয়ে আছে সানট্যান দূর করার ইনস্ট্যান্ট রেমেডি। প্রাকৃতিক, সহজলভ্য উপাদান ব্যবহার করে জ্বালাপোড়া কমিয়ে ফিরে পেতে পারেন ত্বকের সুস্থতা। আজ জানবো সানট্যান থেকে তাৎক্ষণিক আরাম পেতে কার্যকর কিছু সানট্যান দূর করার ঘরোয়া সমাধান।
সানট্যান কি এবং কেন হয়? জেনে নিন সুরক্ষার মূল কথা
সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি, বিশেষ করে ইউভি-এ (UVA) এবং ইউভি-বি (UVB), যখন ত্বকের মেলানিনের সুরক্ষা ক্ষমতাকে অতিক্রম করে, তখনই সানবার্ন হয়। এই রশ্মি ত্বকের এপিডার্মিস ও ডার্মিস স্তরের কোষগুলোর ডিএনএ-তে ক্ষতি করে, প্রদাহ সৃষ্টি করে। ফলে ত্বক লাল হয়ে ফুলে ওঠে, জ্বালা করে, গরম লাগে এবং পরবর্তীতে চামড়া উঠতে পারে। আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজি (AAD) এর মতে, মাত্র ১৫ মিনিট তীব্র সূর্যালোকে থাকলেই সানবার্ন হতে পারে, এমনকি মেঘলা দিনেও ইউভি রশ্মি ৮০% পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশের মতো ক্রান্তীয় দেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে সূর্যের তেজ সর্বোচ্চ থাকে, ফলে সানট্যানের ঝুঁকিও বাড়ে।
সানট্যানের লক্ষণগুলো চিনে নিন:
- ত্বক উজ্জ্বল লাল বা গোলাপি হয়ে যাওয়া
- ত্বক স্পর্শ করলে গরম অনুভূত হওয়া ও ব্যথা লাগা
- ফোলাভাব ও টানটান ভাব
- চুলকানি ও জ্বালাপোড়া
- কিছুক্ষণ পর ত্বক শুষ্ক হয়ে খসখসে হয়ে যাওয়া
- গুরুতর ক্ষেত্রে ফোসকা পড়া, জ্বর, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব
সানট্যান দূর করার ঘরোয়া সমাধান: প্রকৃতির শীতল স্পর্শে জ্বালাপোড়া কমান
ঔষধি গুণে ভরপুর প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে সানট্যানের যন্ত্রণা থেকে দ্রুত আরাম মিলতে পারে। এগুলো ত্বকের গভীরে পৌঁছে জ্বালা কমায়, আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
ঠাণ্ডা সেঁক: জ্বালাপোড়ার প্রথম সাহায্য
কীভাবে প্রয়োগ করবেন:
- একটি পরিষ্কার নরম কাপড় বা গামছা ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে নিন (বরফ ব্যবহার করলে সরাসরি ত্বকে দেবেন না, কাপড়ে পেঁচিয়ে নিন)।
- আক্রান্ত স্থানে ১৫-২০ মিনিট ধরে আলতো করে চেপে ধরুন বা রাখুন।
- কাপড় গরম হয়ে গেলে আবার ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে নিন।
- দিনে ৪-৫ বার বা যখনই জ্বালা বেশি লাগবে, এই সেঁক দিন।
কেন কাজ করে: ঠাণ্ডা তাপমাত্রা ত্বকের রক্তনালিগুলোকে সংকুচিত করে, প্রদাহ কমায় এবং স্নায়ুপ্রান্তকে অসাড় করে ব্যথা ও জ্বালাপোড়ার অনুভূতি দ্রুত প্রশমিত করে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH) এর গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে ঠাণ্ডা থেরাপি ত্বকের প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া হ্রাসে কার্যকর।
অ্যালোভেরা জেল: প্রকৃতির শীতলী বরণ
কীভাবে প্রয়োগ করবেন:
- একটি পাকা অ্যালোভেরা পাতা তাজা কেটে নিন।
- ভেতরের স্বচ্ছ জেলটি বের করে পাতার হলুদ রস (অ্যালোইন, যা জ্বালা করতে পারে) ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন।
- এই জেলটি সরাসরি সানট্যানে আক্রান্ত ত্বকে ঘন করে লাগান।
- ২০-৩০ মিনিট রেখে ঠাণ্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলুন (প্রথম কয়েকবার) বা শুষ্ক ত্বকে শুষ্ক হয়ে যেতে দিন (পরের দিকে)।
- দিনে ৩-৪ বার লাগাতে পারেন।
কেন কাজ করে: অ্যালোভেরায় রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি (প্রদাহনাশক) গুণ, যা লালভাব ও ফোলাভাব কমায়। এর জেল ত্বককে তাৎক্ষণিক শীতল করে, জ্বালাপোড়া কমায়। এতে বিদ্যমান অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস ও ভিটামিন সি এবং ই ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক কোষের মেরামত ও পুনর্জন্মে সাহায্য করে। জার্নাল অফ এথনোফার্মাকোলজিতে প্রকাশিত গবেষণায় অ্যালোভেরার ত্বক পুনরুদ্ধার ক্ষমতার প্রমাণ মেলে।
ঠাণ্ডা দই বা টকদই: প্রোবায়োটিকের সুশীতল ছোঁয়া
কীভাবে প্রয়োগ করবেন:
- এক কাপ তাজা, সরল (ফ্লেভারহীন) দই বা টকদই নিন।
- ফ্রিজে রেখে ঠাণ্ডা করুন (বরফের মতো ঠাণ্ডা নয়)।
- আক্রান্ত ত্বকে পুরু একটি স্তরে ব্রাশ বা পরিষ্কার হাত দিয়ে লাগান।
- ১৫-২০ মিনিট রেখে ঠাণ্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলুন।
- দিনে ২-৩ বার প্রয়োগ করুন।
কেন কাজ করে: দইয়ে থাকা ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বকের মৃত কোষ সরাতে ও নতুন কোষ গঠনে সাহায্য করে। এর প্রোবায়োটিক (লাইভ ব্যাকটেরিয়া) ত্বকের প্রদাহ কমাতে এবং প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা বলয় শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। ঠাণ্ডা দই ত্বককে শীতল করে জ্বালা কমায়। গবেষণা (ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ডার্মাটোলজি) দেখায় যে ল্যাকটিক অ্যাসিডের মৃদু এসিডিক প্রকৃতি সান-ড্যামেজড ত্বকের পিএইচ ব্যালেন্স ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
শসার রস বা টুকরো: ত্বকের জন্য প্রাকৃতিক টনিক
কীভাবে প্রয়োগ করবেন:
- একটি তাজা শসা ভালো করে ধুয়ে নিন।
- পাতলা টুকরো করে কেটে ফ্রিজে রেখে ঠাণ্ডা করুন।
- ঠাণ্ডা শসার টুকরোগুলো সরাসরি সানবার্নে আক্রান্ত স্থানে ১৫-২০ মিনিট রেখে দিন। টুকরোগুলো গরম হয়ে এলে পাল্টে দিন।
- বিকল্প: শসা ব্লেন্ড করে পেস্ট বানিয়ে ত্বকে লাগিয়ে ১৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
- দিনে ৩-৪ বার ব্যবহার করুন।
কেন কাজ করে: শসায় প্রায় ৯৫% পানি থাকে, যা ত্বকের আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনে। এর মধ্যে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস (ভিটামিন সি, কাফেইক অ্যাসিড) প্রদাহ ও লালভাব কমায়। শসার শীতল ও শান্তিদায়ক প্রভাব ত্বকের জ্বালাপোড়া ও অস্বস্তি দূর করে। এটি ত্বককে টানটান ভাব থেকে মুক্তি দেয়।
গ্রিন টি বা ক্যামোমাইল টি ব্যাগ: অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর সেঁক
কীভাবে প্রয়োগ করবেন:
- দুটি গ্রিন টি বা ক্যামোমাইল টি ব্যাগ একটি বাটিতে গরম পানিতে ১০-১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন।
- বাটিসহ ফ্রিজে রেখে সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা করুন (কমপক্ষে ৩০ মিনিট)।
- ঠাণ্ডা টি ব্যাগ দুটি বের করে সামান্য চিপে অতিরিক্ত পানি ঝরিয়ে নিন।
- সরাসরি সানবার্নে আক্রান্ত স্থানে (বিশেষ করে চোখের চারপাশে) আলতো করে চেপে ধরুন বা ১০-১৫ মিনিট রেখে দিন।
- বিকল্প: ঠাণ্ডা চায়ের পানি তুলায় ভিজিয়ে আক্রান্ত স্থান মুছে নিন।
- দিনে ২-৩ বার প্রয়োগ করুন।
কেন কাজ করে: গ্রিন টি এবং ক্যামোমাইল টিতে প্রচুর পরিমাণে পলিফেনলস (এপিগ্যালোক্যাটেচিন গ্যালেট ইজিসিজি) ও ফ্ল্যাভোনয়েডস নামক শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস থাকে। এগুলো ইউভি রশ্মির কারণে সৃষ্ট ফ্রি র্যাডিকেল ড্যামেজ কমায়, প্রদাহ হ্রাস করে এবং ত্বকের লালভাব ও ফোলাভাব দূর করে। ক্যামোমাইলের শান্তিদায়ক গুণ ব্যথা ও জ্বালা কমাতে সাহায্য করে।
ওটমিলের স্নান: চুলকানি ও শুষ্কতা দূর করার মহৌষধ
কীভাবে প্রয়োগ করবেন:
- এক কাপ দলা পাকানো বা কলয়ডাল ওটমিল (Oats) নিন (সাধারণ ওটস ব্লেন্ডারে গুঁড়ো করে নিলেও চলবে)।
- টাব বা বালতিতে হালকা গরম (কখনো গরম নয়) পানি নিন।
- ওটমিল গুঁড়ো পানিতে ছড়িয়ে দিন এবং ভালোভাবে মিশিয়ে নিন যেন দুধের মতো সাদা হয়ে যায়।
- এই পানিতে ১৫-২০ মিনিট ভিজে থাকুন।
- বের হয়ে আলতো করে তোয়ালে দিয়ে টেপাটেপ করে শুকিয়ে নিন (ঘষবেন না)।
- দিনে একবার (বিশেষ করে রাতে) এই স্নান নিন।
কেন কাজ করে: ওটমিলে রয়েছে অ্যাভেনানথ্রামাইডস নামক বিশেষ যৌগ, যা শক্তিশালী প্রদাহরোধী ও অ্যান্টি-ইচ (চুলকানি নাশক) গুণসম্পন্ন। এটি ত্বকের প্রাকৃতিক বাধা (ময়েশ্চারাইজিং ব্যারিয়ার) মেরামত করে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে, ফলে শুষ্কতা ও চুলকানি কমে। আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজি (AAD) ওটমিলকে শুষ্ক ও জ্বালাযুক্ত ত্বকের জন্য অত্যন্ত কার্যকর প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে সুপারিশ করে।
জলপাইয়ের তেল ও মধুর মিশ্রণ: ত্বকের পুষ্টি ও ময়েশ্চারাইজার
কীভাবে প্রয়োগ করবেন:
- এক টেবিল চামচ এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ও এক টেবিল চামচ কাঁচা মধু মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন।
- মিশ্রণটি আক্রান্ত ত্বকে লাগিয়ে আলতো করে ম্যাসাজ করুন।
- ২০-৩০ মিনিট রেখে দিন।
- ঠাণ্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলুন।
- দিনে একবার (রাতে) ব্যবহার করুন।
কেন কাজ করে: জলপাইয়ের তেল ভিটামিন ই এবং অলিওক্যান্থাল নামক অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি যৌগে সমৃদ্ধ, যা ত্বকের মেরামতে সাহায্য করে। মধু প্রাকৃতিক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং হিউমেক্ট্যান্ট (আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা), যা ত্বককে নরম রাখে এবং ক্ষত নিরাময়ে ত্বরান্বিত করে। এই মিশ্রণ সানট্যান পরবর্তী শুষ্ক ও রুক্ষ ত্বককে পুষ্টি ও আর্দ্রতা প্রদান করে।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন? সানট্যানের বিপদসীমা চিনুন
যদিও বেশিরভাগ সানট্যান ঘরোয়া উপায়ে সেরে যায়, কিছু লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। দেরি করলে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
যেসব পরিস্থিতিতে অবিলম্বে ডাক্তার দেখান:
- শরীরের বড় একটি অংশ (পিঠ, বুক, উভয় হাত/পা) গুরুতরভাবে পুড়ে গেলে।
- প্রচুর ফোসকা পড়লে (বিশেষ করে ব্যথাযুক্ত বা ফেটে যাওয়া ফোসকা)।
- তীব্র ব্যথা, ফোলা বা জ্বালাপোড়া যা ৪৮ ঘন্টার মধ্যে কমছে না।
- জ্বর (১০১°F বা ৩৮.৩°C এর বেশি), ঠাণ্ডা লাগা, বমি বমি ভাব, বমি বা মাথাব্যথা হলে (এগুলো হিট স্ট্রোক বা সান পয়জনিং এর লক্ষণ হতে পারে)।
- ত্বক থেকে পুঁজ বের হলে বা সংক্রমণের লক্ষণ (লালচে দাগ ছড়ানো, স্পর্শকাতরতা বৃদ্ধি) দেখা দিলে।
- চোখ ব্যথা করা বা আলো সহ্য করতে না পারা।
- সানট্যান সেরে যাওয়ার পরও ত্বকে অস্বাভাবিক দাগ, গর্ত বা পরিবর্তন থাকলে (স্কিন ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে)।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ন্যাশনাল স্কিন সেন্টার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডার্মাটোলজি বিভাগ বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (BSMMU) বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সতর্ক করে যে বারবার সানবার্ন হওয়া ত্বকের ক্যান্সারের (মেলানোমাসহ) ঝুঁকি বাড়ায়।
সানট্যান প্রতিরোধই সর্বোত্তম পথ: সূর্য থেকে বাঁচতে যা করবেন
সানট্যান দূর করার চেয়ে প্রতিরোধ করা অনেক সহজ ও নিরাপদ। কিছু সহজ অভ্যাস আপনাকে রোদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারে।
সানট্যান এড়ানোর কার্যকর কৌশল:
- সানস্ক্রিন অত্যাবশ্যকীয়: বাইরে বের হওয়ার অন্তত ১৫-৩০ মিনিট আগে SPF 30 বা তার বেশি এবং “ব্রড স্পেকট্রাম” (UVA & UVB রশ্মি থেকে সুরক্ষা দেয় এমন) সানস্ক্রিন মুখ, গলা, কান, হাত, পায়ে ভালো করে লাগান। প্রতি দুই ঘন্টা পরপর এবং সাঁতারের পর বা ঘামে ভিজে গেলে পুনরায় লাগান। WHO এর তথ্য অনুযায়ী, নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার মেলানোমা ঝুঁকি প্রায় ৫০% কমাতে পারে।
- সূর্যের তীব্র সময় এড়িয়ে চলা: সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সূর্যের UV রশ্মি সবচেয়ে তীব্র থাকে। এই সময়ে বাইরের কাজকর্ম সীমিত করুন।
- সুরক্ষামূলক পোশাক: হালকা রঙের, ঢিলেঢালা, পুরু কাপড়ের পোশাক পরুন। লম্বা হাতার শার্ট, প্যান্ট বা লম্বা স্কার্ট পরুন। UV প্রটেকশন ফ্যাক্টর (UPF) যুক্ত পোশাক সর্বোত্তম।
- চওড়া কানজড়া টুপি ও রোদচশমা: চওড়া কিনারা (অন্তত ৩ ইঞ্চি) যুক্ত টুপি মুখ, কান ও ঘাড় ঢেকে রাখবে। UV-A ও UV-B রশ্মি ৯৯-১০০% ব্লক করে এমন সানগ্লাস ব্যবহার করুন। এটি চোখের চারপাশের কোমল ত্বক ও চোখকেও রক্ষা করবে।
- ছায়ার সন্ধান: বাইরে থাকাকালীন যথাসম্ভব ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন। ছাতা ব্যবহার করুন।
- শিশুদের বিশেষ যত্ন: শিশুদের ত্বক অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাদের সরাসরি তীব্র রোদে রাখবেন না। SPF 50+ সানস্ক্রিন ও উপযুক্ত পোশাক দিতে ভুলবেন না।
জেনে রাখুন: সানট্যান ও ঘরোয়া সমাধান সম্পর্কে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
প্রশ্ন: সানট্যান সেরে উঠতে সাধারণত কতদিন সময় লাগে?
উত্তর: হালকা সানট্যানের ক্ষেত্রে লালভাব ও জ্বালাপোড়া সাধারণত ৩-৫ দিনের মধ্যে কমে যায় এবং ত্বক উঠতে শুরু করে। মাঝারি সানট্যান ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। গুরুতর সানট্যান (ফোসকা সহ) সারতে ২ সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে। ঘরোয়া সমাধান নিয়মিত ব্যবহার করলে আরাম দ্রুত আসে এবং সারার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। তবে সম্পূর্ণ নিরাময় ত্বকের গভীরতা ও ক্ষতির মাত্রার উপর নির্ভর করে।
প্রশ্ন: সানট্যানের জায়গায় তেল (নারকেল তেল, ভ্যাসলিন) লাগানো কি ঠিক?
উত্তর: প্রাথমিক ২৪-৪৮ ঘন্টা, যখন ত্বক প্রচণ্ড জ্বালা করছে এবং ফোলা থাকে, তখন ভারী তেল বা পেট্রোলিয়াম জেলি (ভ্যাসলিন) লাগানো উচিত নয়। এগুলো ত্বকের উপর একটি স্তর তৈরি করে তাপ আটকে রাখতে পারে, ফলে জ্বালাপোড়া বাড়তে পারে। প্রথমে শুধু ঠাণ্ডা সেঁক ও অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার করুন। জ্বালাপোড়া কমে গেলে এবং ত্বক শুকনো ও খসখসে হয়ে এলে তখন হালকা ময়েশ্চারাইজার (যেমন অ্যালোভেরা জেল, ক্যালামাইন লোশন বা অলিভ অয়েল) লাগানো যেতে পারে।
প্রশ্ন: ফোসকা পড়লে কি করব? ফোসকা ফাটানো কি ঠিক?
উত্তর: কখনোই নিজে থেকে সানট্যানের ফোসকা ফাটাবেন না বা খোঁচাবেন না। এতে সংক্রমণের (ইনফেকশন) মারাত্মক ঝুঁকি থাকে। ফোসকা ত্বকের নিচের ক্ষতিগ্রস্ত স্তরকে বাইরের জীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয়। ফোসকাগুলোকে অক্ষত রাখুন। হালকা সাবান-পানি দিয়ে পরিষ্কার করে উপরে আলোচিত ঠাণ্ডা সেঁক বা অ্যালোভেরা জেল আলতো করে লাগাতে পারেন। ফোসকা নিজে নিজেই শুকিয়ে যাবে। যদি ফোসকা নিজে থেকে ফেটে যায়, তাড়াতাড়ি অ্যান্টিসেপটিক (যেমন বেটাডিন সলিউশন) দিয়ে পরিষ্কার করুন এবং জীবাণুমুক্ত গজ দিয়ে ঢেকে রাখুন। ফোসকার সংখ্যা বেশি বা ব্যথা তীব্র হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখান।
প্রশ্ন: সানট্যান দাগ (হাইপারপিগমেন্টেশন) থেকে মুক্তি পেতে ঘরোয়া উপায় কি?
উত্তর: সানট্যান ভালো হয়ে যাওয়ার পর অনেক সময় গাঢ় দাগ থেকে যায়। এই দাগ কমাতে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি সাহায্য করতে পারে:
- লেবুর রস: তাজা লেবুর রস তুলায় লাগিয়ে দাগের উপর আলতো করে ঘষুন, ১০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন (শুধু রাতে, রোদে বের হওয়ার আগে নয়, সানস্ক্রিন মিস করবেন না)। ভিটামিন সি দাগ হালকা করে।
- আলুর রস: আলু কুচি করে দাগে ঘষুন বা রস লাগিয়ে রাখুন। আলুতে ক্যাটেকোলেজ এনজাইম দাগ হালকা করে।
- মধু ও দই প্যাক: এক টেবিল চামচ মধু ও এক টেবিল চামচ দই মিশিয়ে দাগে লাগিয়ে ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। এতে দাগ হালকা হয় ও ত্বক উজ্জ্বল হয়।
- সানস্ক্রিন: দাগ যাওয়ার পরও দাগের জায়গায় নিয়মিত উচ্চ SPF সানস্ক্রিন লাগানো অপরিহার্য, নাহলে দাগ আবার গাঢ় হতে পারে।
প্রশ্ন: গরমে সানট্যান থেকে বাঁচতে খাবারের ক্ষেত্রে কি কোনও পরামর্শ আছে?
উত্তর: হ্যাঁ, কিছু খাবার ত্বককে ভেতর থেকে সূর্যের ক্ষতি প্রতিরোধে সাহায্য করে:
- অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল: টমেটো (লাইকোপেন), তরমুজ, বেরি জাতীয় ফল (ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি), কমলা, পেয়ারা (ভিটামিন সি)।
- সবুজ শাকসবজি: পালং শাক, ব্রকলি, কেল (লুটেইন, জিয়াক্সানথিন)।
- সুস্থ চর্বি: বাদাম (আলমন্ড, ওয়ালনাট), বীজ (ফ্ল্যাক্সসিড, চিয়া), ফ্যাটি ফিশ (স্যালমন – ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড)।
- গ্রিন টি: প্রতিদিন ১-২ কাপ গ্রিন টি পান করুন।
- পর্যাপ্ত পানি: ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে প্রচুর পানি ও তরল খাবার (ডাবের পানি, লেবুর পানি) পান করুন। এই খাবারগুলো ত্বককে ভেতর থেকে শক্তিশালী করে এবং সান ড্যামেজের ঝুঁকি কিছুটা কমাতে পারে, তবে এগুলো সানস্ক্রিন বা অন্যান্য বাহ্যিক সুরক্ষার বিকল্প নয়।
প্রশ্ন: রোদে পোড়া ত্বকে বরফ সরাসরি দিলে কি ক্ষতি হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, সরাসরি বরফ সানট্যানে আক্রান্ত সংবেদনশীল ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তীব্র ঠাণ্ডা ত্বকের টিস্যুর আরও ক্ষতি করতে পারে, এমনকি ফ্রস্টবাইটের মতো অবস্থাও ডেকে আনতে পারে (যদিও বাংলাদেশের আবহাওয়ায় তা বিরল)। সবসময় বরফ একটি পরিষ্কার পাতলা কাপড়ে পেঁচিয়ে বা আইস প্যাক ব্যবহার করুন এবং এক জায়গায় দীর্ঘক্ষণ (২০ মিনিটের বেশি) রাখবেন না। প্রতি ৫-১০ মিনিট পরপর সরিয়ে নিন। ঠাণ্ডা পানির সেঁকই বেশি নিরাপদ।
সানট্যান দূর করার ঘরোয়া সমাধান প্রকৃতির অফুরান ভাণ্ডার থেকে পাওয়া সহজ উপায়। ঠাণ্ডা সেঁক, অ্যালোভেরার জেল, দই, শসা, গ্রিন টি সেঁক, ওটমিল স্নান – এই উপাদানগুলোর শীতল ও নিরাময়কারী গুণ ত্বকের জ্বালাপোড়া, লালভাব ও ফোলাভাব দ্রুত কমিয়ে আপনাকে স্বস্তি দিতে পারে। তবে মনে রাখবেন, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। নিয়মিত উচ্চ SPF সানস্ক্রিন ব্যবহার, সূর্যের তীব্র সময় এড়িয়ে চলা এবং সুরক্ষামূলক পোশাক পরা – এই অভ্যাসগুলোই আপনাকে সানট্যানের যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা থেকে দূরে রাখবে। ত্বক সুস্থ রাখুন, সূর্যের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করুন। ত্বকের সুস্থতাই সৌন্দর্যের মূল ভিত্তি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।