মোঃ মাহামুদুল হাসান : বরেন্দ্র অঞ্চলের নদী পদ্মা, মহানন্দা, শিবনদী, পাগলা, ছোট যমুনা, আত্রাই, বারনই ও পূণর্ভবায় এখন পানির কমতি নেই। চলতি বর্ষায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় খাল বিল খাড়ি ডোবাতেও পানি জমেছে। তবুও খাবার পানি সংকটে ভুগছেন অঞ্চলের মানুষ।
চলতি বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলেও মাটির নিচে পানির স্তর ওপরে ওঠেনি। স্থানীয়রা বলছেন, সরকারের স্থাপন করা গভীর নলকূপ ছাড়া তাঁরা সুপেয় পানি পাচ্ছেন না। ভূগর্ভস্থ পানি স্তর আশংকাজনকভাবে তলানিতে ঠেকেছে। অধিকাংশ হস্তচালিত নলকূপ কয়েক বছর ধরেই পুরোপুরি অকেজো।
বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বলছে, চলতি বছর রাজশাহীর তানোর উপজেলায় বৃষ্টি হয়েছে গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তানোরে ২০১৫ সালে বৃষ্টি হয়েছিল ১ হাজার ৩০৭ মিলিমিটার, আর চলতি বছর হয়েছে ১ হাজার ১৫৬ মিলিমিটার। এরপরও সেখানে ভূগর্ভস্থ পানি স্তর ওপরে ওঠেনি।
তানোরের মতো এ অঞ্চলের অধিকাংশ উপজেলায় বর্ষাকাল শেষ হলেও ভূগর্ভস্থ পানি স্তর ওপরে ওঠেনি।
গবেষকেরা বলছেন, মাটির নিচের পানি ধারক স্তর বা ‘অ্যাকুইফার’ মারা যাওয়ায় পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলেও মাটির নিচে আর পানি জমে না। বৃষ্টি কমে গেলে কিংবা সেচের কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে এমন অবস্থার তৈরি হয়।
সাধারণত এক বছরে যে পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়, পরের বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে সেই স্তরটি পুনর্ভরণ বা রিচার্জ হওয়ার কথা। তবে বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলে সেই ‘রিচার্জ’ আর হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, অঞ্চলটিতে প্রতিবছর একটু একটু করে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বর্ষার পর তা আর আগের জায়গায় ফিরছে না। ফলে পানি ধারক স্তরের মোটা বালু ধূলিতে পরিণত হচ্ছে। এরপর যতই বৃষ্টি হোক, ওই স্তর আর পানি ধারণ করতে পারে না। তখন বুঝতে হয়, পানি ধারক স্তরটি মারা গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় প্রায় ২০টি স্থানে পানি ধারক স্তরের মৃত্যু হয়েছে।
বছরের আট মাসই বরেন্দ্র অঞ্চলের খালবিল পুকুর ডোবা খাড়ি নালা এমনকি নদীতেও পানি থাকে না। মাটির নিচে পানির স্তরও অনেক নিচে চলে যায়। ফলে মানুষেরা খাবার পানি সংগ্রহ করতে অবর্ণনীয় দুভোর্গের শিকার হয়ে থাকেন। গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজকর্ম ছাড়াও গবাদিপশু পালন ও ফসল ফলাতে সেচের পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠে।
পানি সংকটাপন্ন এলাকা হলো এমন অঞ্চল যেখানে সুপেয় পানির চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত পানির অভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত ব্যবহারের কারণে তা আরও বাড়ছে। বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩-এর অধীনে, এই ধরনের এলাকাগুলো সরকার কর্তৃক চিহ্নিত করা হয় এবং সেগুলোর ব্যবস্থাপনা, ব্যবহার ও সংরক্ষণে কঠোর নীতিমালা গ্রহণ করা হয়।
গত ২৫ আগস্ট রাজধানীর গ্রীণ রোডে অবস্থিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংস্থার (ওয়ারপো) সম্মেলন কক্ষে জাতীয় পানি সম্পদ পরিষদের নির্বাহী কমিটির ১৮তম সভায় রাজশাহী অঞ্চলের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ২৫টি উপজেলা এলাকাকে অতি উচ্চ পানি সংকট এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে।
এ সভায় পানি সম্পদ, কৃষি ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা, চারটি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও সহায়ক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রাজশাহী অঞ্চলের পানি সংকটাপন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর ভূগর্ভস্থ পানিস্তর ও পানির প্রাপ্যতা নিয়ে করা গবেষণার প্রতিবেদনের আলোকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জাতীয় পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংস্থার (ওয়ারপো) মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (প্রকৌশল) মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন জানান, ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত তিন বছরব্যাপী ‘সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৮ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে জাতীয় পানি সম্পদ পরিষদের নির্বাহী কমিটি এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন।
সভায় বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপস্থিত কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে ক্রমাগতভাবে পানিস্তর নেমে যাওয়ায় তাদের স্থাপিত অনেক গভীর নলকূপে এখন আর পানি উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকী অনেক গভীর নলকূপও অকেজো হয়ে পড়েছে।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, চলমান সংকট আর কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়া যাবে না। ভূগর্ভের সব পানি ফুরিয়ে গেলে আলোচিত উপজেলাগুলোর মানুষ আগামীতে কোনো পানি পাবে না। এলাকাগুলোতে পানির জন্য হাহাকার পরিস্থিতি তৈরি হবে।
এখনো শুস্ক মৌসুমে রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল গোমস্তাপুর ও সদর উপজেলা ছাড়াও নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার উপজেলার অধিকাংশ গ্রামেই তীব্র পানি সংকট বিরাজ করে।
পানির জন্য সবচেয়ে বেশি দুর্দাশার শিকার হচ্ছেন রাজশাহীর তানোরের অধিকাংশ এলাকার মানুষ। তারা পানির অভাবে তিনদিনে একবার গোসল করার সুযোগ পান।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের ২২টি গ্রামেও পানির তীব্র সংকটে মানুষ সারা বছরই দিন কাটায়। তপ্ত উত্তপ্ত বরেন্দ্রভূমিভুক্ত এসব এলাকার মানুষ পানির অভাবে গবাদিপশু পালন করতে পারে না। বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের স্থাপিত গভীর নলকূপ থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় নারীদের।
জাতীয় পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিষদের সর্বশেষ সভায় অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন জেলা হিসেবে তিনটি জেলার নাম ঘোষণা করা হয়। জেলা তিনটি হলো-রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ। এই তিন জেলার ২৫টি উপজেলার ২১৫টি ইউনিয়নের ৪ হাজার ৯১১টি মৌজার সাড়ে ৫ হাজার গ্রাম পানি সংকটের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবে এর মধ্যে ৪৭টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৫০৩টি মৌজাকে অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপদ্রুত এলাকাগুলোর ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৮৭ লাখের বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান এ আইন কার্যকরা সম্ভব হলে উপদ্রুত এলাকাগুলোতে যত্রতত্র ভূগর্ভস্থ পানি আর উত্তোলন করা যাবে না। কেউ তা করলে তাদের বিরুদ্ধে পানি ব্যবস্থাপনা আইনানুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।