সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ওরফে কালা জাহিদ সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন জেলার পরিবহন খাত থেকে একচ্ছত্র চাঁদাবাজি করে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। এক সময় মুদি দোকানের কর্মচারী থেকে বনে গেছেন শত কোটি টাকার মালিক। একাধিক আলীশান বাড়িও রয়েছে তার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের আগে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড মসজিদ মার্কেটে নিজের মামা মরু মিয়ার মুদি দোকানে কর্মচারী ছিলেন জাহিদ। এরপর কিছুদিন বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও পরে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য (সাবেক) জাহিদ মালেকের হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগদান করেন জাহিদ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। জাহিদ মালেকের প্রত্যক্ষ মদদে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন জাহিদ। এরপরই পরিবহন খাত থেকে শুরু হয় তার একচ্ছত্র চাঁদাবাজি।
জাহিদুল ইসলাম ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেকের প্রত্যক্ষ মদদে মানিকগঞ্জ পৌর বাস টার্মিনালসহ পরিবহন মালিক সমিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেকে সভাপতি ঘোষণা করেন। সেই সাথে জেলার বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, অটো-টেম্পু ওনার্স গ্রুপ দখল করে জাহিদুল ইসলাম নেতৃত্বে চলে প্রকাশ্য চাঁদাবাজি।
জাহিদুল ইসলাম জাহিদ তার আত্মীয়-স্বজন ও নিজস্ব ভাই ভাতিজা দিয়ে তৈরী করেন চাঁদাবাজির একটি সিন্ডিকেট। তার নেতৃত্বে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের দোকানপাট থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হতো। চাঁদাবাজির সাথে সাথে টেন্ডারবাজি ও জমি দখলসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিতেন জাহিদ।
জেলার বিভিন্ন ধরনের সহস্রাধিক পরিবহন থেকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে মালিক সমিতির নামে প্রতিদিন কয়েক লক্ষ টাকা চাঁদাবাজি করলেও তিনি ছিলেন ধরাছোয়ার বাইরে। অজানা কারণে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি প্রশাসনকে। অভিযোগ রয়েছে, চাঁদাবাজি করে আদায় করা এসব টাকার একটি অংশ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদেরকে দিয়েই টিকিয়ে রেখেছিলেন নিজের আধিপত্য।
চাঁদাবাজি করে শতকোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এই আওয়ামী লীগ নেতার ২টি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে মানিকগঞ্জে। জয়রা গ্রামে তিন তলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক বাড়িটির সৌন্দর্য্য হার মানাবে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বাড়িকেও। একইসাথে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে গড়ে তুলেছেন ৩ তলা একটি ভবন। যার নাম দিয়েছেন ‘জাহিদ টাওয়ার’। জাহিদ টাওয়ারের ২য় তলায় ছিল জাহিদুল ইসলামের ব্যক্তিগত অফিস। এছাড়া ঢাকার সাভারেও একটি বাড়ি রয়েছে তার। এছাড়া, তার সাভারে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ১২ শতাংশ আরেকটি জমিও রয়েছে বলে জানায় একটি সূত্র। চলাচলের জন্য রয়েছে এক্সিয়াস ব্রান্ডের দামী গাড়ি ও শুভযাত্রা পরিবহনের ২টি মিনিবাস রয়েছে জাহিদের।
আরো জানা গেছে, জাহিদুল ইসলাম জাহিদের নেতৃত্বে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে পরিবহন থেকে চাঁদা এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন জাহিদের আপন ভাই মাহিদুল ইসলাম মাহিদ, জাহিদের বড় ভাই জসিম, ভাতিজা জকি, জাহিদের চাচা টিটু, আরেক চাচা হাজী, আব্দুল হালিম, জাহিদের চাচাতো ভাই সবুজ, আরেক চাচাতো ভাই আকতার। এরা সরাসরি চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
২০২২ সালে দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা জাহিদুল ইসলাম জাহিদের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে একটি তদন্ত রিপোর্ট দেন। কিন্তু এরপরও বন্ধ হয়নি তার চাঁদাবাজি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবির প্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ থেকে পলায়নের পর আওয়ামী লীগের অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের সাথে সাথে জাহিদুল ইসলাম জাহিদও গা ঢাকা দেয়। এদিকে, গত রবিবার জাহিদ টাউয়ার থেকে চাঁদাবাজি ও অবৈধ টাকা ভাগবাটোয়ারার নথি ও ফাইলপত্র সহ জাহিদের ভাগ্নে পরিচয়দানকারী মামুন মিয়া নামের এক যুবককে আটক করে শিক্ষার্থীরা। পরে সেই নথিপত্রসহ তাকে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
স্থানীয়রা বলেন, চাঁদাবাজি করে বহু টাকার মালিক বনে গেছেন জাহিদ। রাজকীয় বাড়ি নির্মাণের সাথে সাথে বিলাসী জীবনযাপনেও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাহিদের এক প্রতিবেশি (সত্তরোর্ধ) জানান, জাহিদের বাবার নিজস্ব কোন সম্পত্তি ছিলনা। তার বাবা ও পরিবারের লোকজন সরকারি জমিতে ঘর উঠিয়ে থাকতো। জাহিদ এখন অনেক টাকা পয়সার মালিক হয়ে গেছে। কিন্ত সেই সরকারি জমি এখনো তারা দখল করে আছে।
মানিকগঞ্জের জয়রা এলাকায় জাহিদুল ইসলামের বাড়ি এবং বাসস্ট্যান্ডের জাহিদ টাওয়ারে গিয়ে জাহিদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, জাহিদ বর্তমানে পলাতক রয়েছে। জাহিদের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তার সাথে মোবাইলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে জয়রা এলাকায় জাহিদুল ইসলামের বাড়ির ছবি তুলতে গেলে তার মা এগিয়ে এসে জানান, আমার দুই ছেলে জাহিদ ও মাহিদ অনেক আগে বাসস্ট্যান্ড মসজিদ মার্কেটে আমার ভাইয়ের মুদি দোকানে কাজ করতো। তারপর রাজনীতিতে ঢুকে ধীরে ধীরে ঠিকাদারি শুরু করে। সাভারে অনেক আগে একটা জমি কিনেছিল, কিন্তু সেটি দখলে নিতে পারেনি। বাড়ির জমিটাও আমার ভাই কিনে দিয়েছে। বাসস্ট্যান্ড আর বাড়িতে এই দুইটা বিল্ডিংই আছে। ঠিকাদারি করেই এগুলো করেছে। আর কোন সম্পদ নেই, জমি জমাও নেই। একটু হলেই মানুষ অনেক বাড়িয়ে বলে।
জাহিদ কোথায় আছে জানতে চাইলে তার মা জানান, হাসিনা যেদিন দেশ ছেড়ে গেছে সেদিনই জাহিদ বাড়ি থেকে চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে আমাদের বলে যায়নি।
উল্লেখ্য, জাহিদুল ইসলাম জাহিদ না থাকায় বর্তমানে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ রয়েছে। এতে বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের মধ্যে স্বস্তি দেখা গেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে আর কেউ যেন চালকদের বা ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে চাঁদা আদায় করতে না পারে সেই দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।