জুমবাংলা ডেস্ক : ২০১৯ সালটা ছিল আমার জীবনের কঠিন একটি সময়। বাবা ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান গুণলেন। বড় ভাইয়ের দুই মাস আগে চাকরি চলে গেল, মা ভীষণ অসুস্থ। সবমিলিয়ে পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ চলছিল। এরই মধ্যে আমার এসএসসি/দাখিল পরীক্ষার ফি জমা দেয়ার সময় চলে এলো। হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই। পরিবারের কারো কাছে চাইবো সে উপায়ও নেই। এই কঠিন সময়ে চার–পাঁচ হাজার টাকা তারা আমাকে কিভাবে দিবে।
পড়াশোনা তো চালিয়ে যেতে হবে। পরিচিত কয়েকজনের কাছে পরীক্ষার ফি দেয়ার জন্য পাঁচ হাজার টাকা ঋণ চাইলে কারো কাছ থেকেই কোনো ধরনের সাড়া পেলাম না। একজন তো টাকা ঋণ চাওয়ার কারণে তাকে যেন আর বিরক্ত করতে না পারি তাই মেসেঞ্জারে আমাকে ব্লক করে দিলো। সেদিন কী পরিমাণ যে দুঃখ পেয়েছিলাম তা বলে বোঝানো সম্ভব না। মুখ লুকিয়ে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না।
কথাগুলো বলছিলেন ২৬ বছর বয়সী তরুণ উদ্যোক্তা আহনাফ নিয়াজ। তিনি শেরপুর জেলার তিরছা থানার নকলা গ্রামের রেজাউল করিমের সন্তান। নিয়াজ বর্তমানে থাকেন রাজধানীর শনিরআখড়া, যাত্রাবাড়ীতে।
তিনি পবিত্র কোরআনের হাফেজ এবং রওজাতুস সালিহীন ফাযিল মাদ্রাসায় ফাযিল অধ্যয়নরত। পাশাপাশি নারায়নগঞ্জ তোলারাম কলেজে অনার্স পড়ছেন।
২০১৯ সালে পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ঘোচানোর ইচ্ছা থেকেই নিয়াজ চিন্তা করলেন তার একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু কী করবেন ভেবে পান না। একপর্যায়ে ভিডিও এডিটিংয়ের ব্যাপক চাহিদার কথা ভেবে টিউশনি করে জমানো কিছু টাকা ছিল সেটা দিয়ে তিনি ভিডিও এডিটিং শেখার একটি কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলেন। কিন্তু দুই-তিনটা ক্লাস করে বুঝতে পারলেন এ কাজ ভালোভাবে রপ্ত করতে গেলে তার ব্যক্তিগত একটি কম্পিউটার বা ল্যাপটপ থাকতে হবে। সুতরাং ভিডিও এডিটিং তার আর শেখা হলো না।
আহনাফ নিয়াজ বলেন, ওই সময়গুলো আমার যে কিভাবে কেটেছে আমি আর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মারাত্মক ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। বিভিন্নজনকে বলতাম আমাকে একটা চাকরি দেয়ার জন্য। বেতন যেমনই হোক। কিন্তু কেউ দেয়নি। এমনকি ওই সময় কেউ যদি আমাকে দারোয়ানের চাকরিও দিতো আমি অবশ্যই করতাম।
আহনাফ নিয়াজ আরো বলেন, একটি ঘটনা আমার জীবনের গতিবেগ পাল্টে দিয়েছে। আমার জীবনে স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছি। একদিন ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ কণ্ঠশিল্পী ও দাঈ জুনায়েদ জামশেদের একটি ভিডিও আমার চোখে পড়ল।
ভিডিওতে তিনি বলছিলেন তিনি যখন গানের শিল্পী থেকে ইসলাম ও দ্বীনদারির পথে ফিরে আসলেন তখন তার উপার্জনের সমস্ত মাধ্যম একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে তার বাড়ি-গাড়ি সব বিক্রি করতে হয়। ওই সময় তিনি জমানো সামান্য কিছু টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ওই ব্যবসায় আল্লাহ তাকে এত বরকত দেন যে তার জীবন-মান পরিবর্তন হয়ে যায়।
জুনায়েদ জামশেদের ওই ভিডিও দেখে আমি ভীষণ অনুপ্রাণিত হই এবং মাত্র ১,৫০০ টাকা দিয়ে দুই বক্স আতর কিনে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করে দেই।
আহনাফ নিয়াজ বলেন, যেই কোম্পানি থেকে আমি পাইকারি আতর কিনে আনতাম তারা আমার মার্কেটিং স্ট্রেটেজি দেখে তাদের কোম্পানিতে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসাবে আমাকে চাকরি দেয়।
আলহামদুলিল্লাহ, প্রথম মাসেই তাদের আতর খুব ভালো পরিমাণে বিক্রি করতে পারায় তারা আমাকে প্রথম মাসেই ২৫ হাজার টাকা বেতন দেয়।
২০২০ সালে করোনার প্রকোপ শুরু হলে তিন মাসের চাকরি জীবন আমাকে ইতি টানতে হয়। একেবারে বেকার হয়ে বাসায় বসে পড়লাম। হঠাৎ লক্ষ করলামম অনেকেই যার যার অবস্থান থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে অনলাইনে বিক্রি করছে। আলেমরাও /কওমি উদ্যোক্তা/ নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে। অনেকে অনলাইনে কোর্স করে বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জন করছে। কেউ কেউ ফ্রিল্যান্সিং করছে। ওই সময় ল্যাপটপের প্রচুর চাহিদা তৈরি হয় দেশে। আমার কাছে ২০ হাজার টাকা ছিল। সেই টাকা দিয়ে আমিও একটা ল্যাপটপ কিনে অনলাইনে বিক্রি করলাম। এরপরে এভাবে একটা–দুটা করে ল্যাপটপ কিনে এনে অনলাইনে বিক্রি করতে থাকলাম।
এরপরে ২০২৩ সালে জানুয়ারি মাসে অনলাইনে ল্যাপটপ বিক্রির পাশাপাশি ‘মিস্টার ল্যাপটপওয়ালা’ নাম দিয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনিড়আখড়া আয়েশা মোশাররফ শপিং কমপ্লেক্সের ৪র্থ তলায় একটা দোকান নেই। সেখান থেকেই অনলাইনে ল্যাপটপ বিক্রির পাশাপাশি অফলাইনেও বিক্রি করছি। মাত্র ২০ হাজার টাকায় শুরু করা ব্যবসায় বর্তমানে প্রতিমাসে গড়ে ১০ লাখ টাকার ল্যাপটপ বিক্রি করতে পারছি আলহামদুলিল্লাহ।
গত ২ মার্চ কওমি উদ্যোক্তার খুলনা বিভাগীয় সম্মেলনে মিঃল্যাপটপওয়ালার স্বত্বাধিকারী আহনাফ নিয়াজকে সেরা উদ্যোক্তা সম্মাননা এওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ওই সম্মেলনে কওমি উদ্যোক্তার ফাউন্ডার রোকন রাইয়ান, ইসলামি লেখক,গবেষক মিরাজ রহমান, ও সোপান ফুডের স্বত্বাধিকারী আরিফুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
আহনাফ নিয়াজ বলেন, আমাকে যখন আমার মা মাদ্রাসায় ভর্তি করেন তখন আশেপাশের অনেকে বলেছিল–ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়িয়ে কী হবে? কী করবে জীবনে? হুজুররা মানু্ষের বাসায় মিলাদ পড়ানো ছাড়া আর কী করতে পারবে?
সেই লোকগুলোকে আমার এখন ইচ্ছে করে কওমি উদ্যোক্তা গ্রুপটাকে দেখাতে। এখানে হাফেজ, আলেমসহ এমন কোনো পেশার লোক নেই যে এই গ্রুপে সম্পৃক্ত নেই। হুজুররা এখন সব সেক্টরে আছে, সব জায়গাতেই তাদের পদচারণা আছে। আলহামদুলিল্লাহ।
ব্যবসায় কীভাবে ভালো করা যায় সেই প্রসঙ্গে আহনাফ নিয়াজ বলেন, ব্যবসায় সফলতার জন্য আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কথা-কাজে মিল রাখতে পারা। ক্রেতার সাথে কোনোভাবেই প্রতারণা করা যাবে না। আপনি যদি মনে করেন এটাই আপনার প্রথম এবং শেষ ক্রেতা এবং তাকে কোনোভাবে পণ্য গছিয়ে দিতে পারলেই আপনি ভালো বিক্রেতা, তাহলে এ ধারণা মারাত্মক ভুল। শুধু তাই না এমন মানসিকতা নিয়ে ব্যবসা করলে আপনার ব্যবসায় গ্রোথ হবে না।
দিন যতো যাবে আপনার ব্যবসার ধস নামবে। যে পণ্যই বিক্রি করুন আপনার রিপিট ক্রেতা থাকাটা অনেক জরুরি। আর রিপিট ক্রেতা ধরে রাখার জন্য আপনার কমিটমেন্ট বজায় রাখাটাও অতীব জরুরি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।