বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : পিসার এক বাঁধানো ঘাটে বসে আছেন গ্যালিলিও। পাদ্রিদলের এক পান্ডার আগমন ঘটল। পান্ডা হেঁকে বললেন, ‘ওহে গ্যালিলিও তুমি নাকি নিজেকে বড্ড পণ্ডিত ভাবছ? তুমি নাকি কোপার্নিকাসের তত্ত্বকে সত্যি বলে প্রচার করছ? বলছ সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরছে, পৃথিবীর চারপাশে সূর্য নয়!’
‘আপনি ঠিকই শুনেছেন পাদ্রি মশায়।’ গ্যালিলিও জবাব দিলেন।
‘ওরে তুচ্ছ গবেষক, একটা নলের মাথায় কাচ লাগিয়ে কালো জাদু-টাদু করে সাধারণ লোককে ঠকাতে পারো, ভ্যাটিক্যানের পাদ্রিদের নয়।’
‘লোক ঠকানোর কাজ দিনের পর দিন আপনারা করছেন পাদ্রি মশাই, আমি নই। আপনারা যুক্তির ধার ধারেন না, পরীক্ষা-প্রমাণে আপনাদের আস্থা নেই, নিজেরা যেটা বিশ্বাস করেন, সেটাকেই মানতে বাধ্য করেন সাধারণ মানুষকে!’ পাল্টা আক্রমণে পাদ্রিকে ভড়কে দিলেন গ্যালিলিও।
‘আপনি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন? আপনাকে আগামী সোমবার ভ্যাটিক্যানে এসে সওয়াল করতে হবে।
’
‘ঠিক আছে, আমি যা বলার ভ্যাটিক্যানে গিয়েই বলব। আপনি এখন আসুন।’
সোমবার ভ্যাটিক্যানের দরবার হলে লোকারণ্য। গ্যালিলিওর সওয়াল দেখতে এসেছে।
বিচারকের আসনে স্বয়ং পোপ। তিনি বললেন, ‘বাছা গ্যালিলিও, তুমি নাকি মানুষকে ভুলভাল শেখাচ্ছ?’
‘ভুলভাল শেখাচ্ছি না মহামান্য পোপ, আমি বরং সত্যিটাই জানাচ্ছি, একেবারে পরীক্ষার সাহায্য উদঘাটন করা সত্যি।’
‘কোপার্নিকাস-ব্রুনোরাও কিন্তু মনে করতেন, তারা সত্যি প্রচার করতেন। কিন্তু সেই মূর্খতার ফল ভালো হয়নি।’
‘আপনাদের শক্তি আছে, মুখ বন্ধ করার জন্য ব্রুনোকে পুড়িয়ে মেরেছিলেন।
কোপার্নিকাস চুপ করে গিয়েছিলেন বলে তাকে রেহাই দিয়েছিলেন। এত কিছু করেও কিন্তু সত্যকে চেপে রাখা যায়নি। সেই ব্রুনো-কোপার্নিকাসের কথাই এখন সত্যি হয়ে উঠেছে।’
‘বাছা গ্যালিলিও, তুমি সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছ, মহান অ্যারিস্টোটল আর টলেমিকে অপমান করছ?’
‘মহামান্য পোপ, অ্যারিস্টোটল আর টলেমিদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, তাদের সব কথা সত্যি নয়। তারা পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষণের মাধ্যমে সত্যিটা যাচাই করতেন না। যুক্তি-তর্কে যেটা ঠিক মনে হতো, সেটাকেই সত্যি বলে প্রচার করতেন।’
‘বাছা গ্যালিলিও, তুমি একটা ভুল দেখাতে পারবে?’ শীতল গলায় বললেন পোপ।
‘জি, পারব মহামান্য পোপ।’ জবাবে বললেন গ্যালিলিও।
‘দেখাও তাহলে।’ পোপ বললেন।
‘আগে আমি যুক্তিটা দেখাই, তারপর প্রমাণ। অ্যারিস্টোটল বলতেন পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র, তাই কোনো জিনিস ওপর দিকে ছুড়ে মারলে পৃথিবীতে ফিরে আসে। তিনি আরো বলতেন, যেসব জিনিস পৃথিবীতে ফিরে আসে, সেগুলো স্বর্গীয় নয়। আর যেসব বস্তু ফিরে আসে না, ওপরে উঠে যায়, সেগুলো স্বর্গীয় বস্তু। যেমন জলীয় বাষ্প, ধোঁয়া ইত্যাদিকে অ্যারিস্টোটল স্বর্গীয় বস্তু বলতেন। আসলে পড়ন্ত বস্তুর সঙ্গে স্বর্গীয় আর অস্বর্গীয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। অ্যারিস্টোটল মনে করতেন, একই উচ্চতা থেকে একটা হালকা আরেকটা ভারী বস্তুকে একসঙ্গে ফেললে ভারীটা আগে মাটিতে পড়বে, হালকাটা পরে পড়বে।’
‘এটাকেও তুমি ভুল বলতে চাও নাকি গ্যালিলিও?’
‘ভুলকে তো ভুলই বলব মহামান্য পোপ।’ গ্যালিলিও জবাব দেন।
‘এটা ভুল?’ একটা পাথর আরেকটা পালক একসঙ্গে মাটিতে পড়তে দেখেছ কখনো?’ পোপ ভেবেছিলেন মোক্ষম জায়গায় আঘাত করতে পেরেছেন। কিন্তু গ্যালিলিও যুক্তি দেখালেন, ‘পালক পড়ে হাওয়ায় ভেসে ভেসে, এ জন্য দেরি হয়। বাতাস যদি না থাকত পালক আর পাথর একসঙ্গে মাটিতে পড়ত। কিন্তু দুটোই যদি পাথর হয়, দুটোর ওজন যদি আলাদা হয়, তবু তারা একই সঙ্গে মাটিতে পড়বে। বাতাসের বাধা এদের ওপর খুব বেশি কাজ করতে পারবে না।’
‘এটা কি তুমি পরীক্ষা করে বলছ, গ্যালিলিও?’ পোপ জিজ্ঞেস করলেন।
‘নাহ, তবে পরীক্ষা আমি করব, সেটা আপনাদের সামনেই করব।’ জবাব দিলেন গ্যালিলিও। ‘তার আগে যুক্তিটা দেখাই?’
‘বলো,’ পোপ বললেন, ‘তোমার যুক্তিটা কী?’
‘মহামান্য পোপ,’ গ্যালিলিও শুরু করলেন, ‘ধরে নিলাম অ্যারিস্টোটলের কথাই ঠিক, ভারী বস্তু আগে মাটিতে পড়বে আর হালকাটা পরে। ধরা যাক, দুটো পাথর আছে আমাদের কাছে। একটার ওজন ১০ কেজি, আরেকটার ১ কেজি। এদের আমরা বাড়ির ছাদ থেকে নিচে ফেলব। হিসাব মতে, বস্তুর ওজন যত বাড়বে, সেটি দ্রুত মাটিতে পড়বে। তাহলে একটা ভারী বস্তুর ওজন যদি কোনোভাবে বাড়ানো যায়, তাহলে তার পতনের গতিও নিশ্চয়ই বাড়বে।
আবার যদি হালকা বস্তুর ওজন বাড়ানো হয় তাহলে তার পতনের গতিও নিশ্চয়ই বাড়বে, অ্যারিস্টোটলের মত অনুসারে। এখন ১ কেজি আর ১০ কেজি ওজনের পাথর দুটো যদি দড়ি দিয়ে বেঁধে ওপর থেকে ফেলা হয়, তাহলে কী হবে?’
পোপ অবাক হলেন, কী বলতে চায় গ্যালিলিও। ‘গ্যালিলিও বলেন, এখানেই ঝামেলাটা বাধে। তৈরি হয় প্যারাডক্স। এখানে হিসাব বলছে, ১০ কেজি ওজনের পাথরটা আগে পড়তে চাইবে। ১ কেজি ওজনের পাথরটার ওজন যেহেতু কম, সেটা পরে পড়ে। কিন্তু দুটো তো দড়ি দিয়ে বাঁধা, তাই ১০ কেজি ওজনের পাথর চাইলেও আগে পড়তে পারবে না। ১ কেজির পাথরের গতি যেহেতু কম, তাই সেটা ১০ কেজি পাথরের গতিতে বাধা দেবে। ১০ কেজি পাথরের গতি কিছুটা কমে যাবে। তারপর মাঝামাঝি একটা গতিতে দুটোই একসঙ্গে মাটিতে পড়বে।’ বলে থামলেন গ্যালিলিও।
পোপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখানেও সমস্যা ছিল না মহামান্য পোপ। কিন্তু ওজন বাড়লে যে বস্তু পতনের গতি বাড়ে। তাই ১০ কেজি আর ১ কেজির বস্তুকে বেঁধে ফেললে দুটো পাথর তখন একটা পাথরে পরিণত হচ্ছে, ফলে ওজন দাঁড়াচ্ছে ১১ কেজি। সুতরাং ১১ কেজির পাথর নিশ্চয়ই ১০ কেজির চেয়ে বেশি গতিতে পড়বে। অর্থাৎ এখানে বেড়ে যাচ্ছে পতনের গতি। কিন্তু আগের বার আমরা দেখেছিলাম বাঁধার ফলে কমে যাচ্ছে গতি। তাহলে কোনটা সত্যি?’
পোপ জবাব দিতে পারেন না। গ্যালিলিও বলেন, ‘এই প্যারাডক্সের হাত থেকে বাঁচার উপায় একটাই, যদি ভারী আর হালকা সব বস্তুই একসঙ্গে মাটিতে পড়ে। বস্তুর ওজন যাই হোক, ভূপৃষ্ঠ থেকে নির্দিষ্ট উচ্চতা সব বস্তুর পতনের গতি এক।’
‘প্রমাণ দিতে পারবে?’ পোপ বলেন।
‘আগামী বুধবার যদি পিসার হেলানো মিনারে আসেন, আমি প্রমাণ করে দেখাব।’
বুধবার পাদ্রিদের সামনে দুটো আলাদা ভরের পাথর পিসার হেলানো মিনারের ছাদ থেকে মাটিতে ফেলে গ্যালিলিও প্রমাণ করেন, সব বস্তুই একসঙ্গে মাটিতে পড়ে।
*এখানকার প্যারাডক্সটা সত্যি, কিন্তু গ্যালিলিওর সঙ্গে পোপ আর পাদ্রিদের কথোপকথন সম্পূর্ণ কাল্পনিক। হেলানো মিনার থেকে দুটি আলাদা ভরের বস্তু ফেলে গ্যালিলিও পড়ন্ত বস্তুর সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছিলেন বলে একটা গল্প চালু আছে। কিন্তু তারও ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই। তবে গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তু সম্পর্কে এ ধরনের ভাবনা ছিল। সূত্র : কালের কন্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।