খেলাধুলা ডেস্ক : চার গোলের লিড কত বড়? কতটুকু স্বস্তি দিতে পারে? শেষ দশটা বছর ধরে বার্সাকে ‘সহ্য’ করেছে, এমন একজন সমর্থককে জিজ্ঞেস করুন। অবধারিতভাবে উত্তরটা পাবেন– ‘একদমই না’।
কেন? ম্যাচের আগে প্রশ্নটা করলে অনেক কিছু বুঝিয়ে বলতে হতো। কিন্তু ম্যাচের প্রথম মিনিটে এই প্রশ্নটা করে থাকলে তার জবাবটা পরের ৯০ মিনিটে আপনি পেয়ে গেছেন। ৪টা গোলের লিড ধরে রেখে যেখানে আর সবার হেসে খেলে জিতে না হোক, অন্তত ড্র করে ফেরার কথা, সেখানে বার্সা হেরেই বসল। হারেও অবশ্য সমস্যা ছিল না, ভয় ছিল বরুসিয়া ডর্টমুন্ড না আবার হিসেব সমান করে দেয়, কিংবা পেছনেই ফেলে দেয়!
সেরহু গিরাসির ইতিহাস গড়া হ্যাটট্রিকে ভর করে বরুসিয়া তা করেও ফেলেছিল আর একটু হলেই। তবে শেষ পর্যন্ত তা ষোলোকলা পূরণ হলো না, বার্সার দুঃস্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিল না দুটো গোলের ব্যবধানে। প্রথম লেগে ৪-০ গোলে জেতা বার্সেলোনা আজ সিগনাল ইডুনা পার্কে হারল ৩-১ গোলে। তবে সামগ্রিক লড়াইয়ে ৫-৩ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে সেমিফাইনালে চলে গেছে দলটা।
‘চোকার্স’ শব্দটা ক্রিকেটে খুব চলে। এই ডাকনামটা দক্ষিণ আফ্রিকার। কখনো ভাগ্যের বিড়ম্বনায়, কখনো নিজেদের ভুলে নকআউট এলেই পা হড়কে যায় দলটার। যদি ডাকনামটাকে ফুটবলেও নিয়ে আসতে হয়, তাহলে এটা বার্সেলোনারই প্রাপ্য। শেষ দশ বছরে ইউরোপীয় মঞ্চে নিজেদের পারফর্ম্যান্স দিয়ে যা ‘অর্জন’ করেছে দলটা।
আজ ম্যাচের আগে আন্তর্জালে ‘মিম’ ঘুরে বেড়াচ্ছিল একটা। যোগ করা সময় চলছে, বরুসিয়া ৫-০ বার্সা। সেটা যে-ই বানিয়ে থাকুন না কেন, এমন পরিস্থিতি বার্সেলোনাই তৈরি করেছে একটু একটু করে শেষ দশ বছরে। আজকের পারফর্ম্যান্স আরেকটু হলে সেটা সিলগালাই করে দিচ্ছিল।
নাহয় বলুন, কোচ হানসি ফ্লিক যেখানে অষ্টম গোলেও অতৃপ্ত, পাংশুটে মুখে বসে থাকেন ডাগ আউটে, সেই তিনি কেন আজ মাঝমাঠ আর রক্ষণের দুই নেতা পেদ্রি গনজালেস আর ইনিগো মার্তিনেজকে ছাড়া একাদশ সাজাবেন? ইনিগোকে বাদ দেওয়া নাহয় প্রশ্নাতীত, একটা কার্ড দেখলেই সম্ভাব্য সেমিফাইনালে পাওয়া যাবে না তাকে।
কিন্তু পেদ্রিকে কেন? পেদ্রিকে ছাড়া বার্সা কী, তা গেল সপ্তাহে নিজেদের মাঠে বরুসিয়া ম্যাচটার শেষ দশ মিনিটেই বোঝা হয়ে গেছে। সেদিন শেষ দশ মিনিটে গোটা সাতেক সুযোগ তৈরি করেছিল সফরকারীরা, অফসাইড থেকে করেছিল একটা গোলও।
সেই পেদ্রিকে আজ যখন ম্যাচের শুরু থেকেই পেল না বার্সা, তখন তার সুযোগটা বরুসিয়া নিল ভালোভাবেই। একে তো সিগনাল ইডুনা পার্কে কান পাতা দায়, তার ওপর শুরুর দিকে একটা গোল, পুরো পরিস্থিতিটাই বছর ছয়েক আগে পাওয়া অ্যানফিল্ড প্যারানয়াকে ফিরিয়ে আনছিল যেন বারে বারে। প্রথম লেগে দুটো স্কুলবালকসুলভ ভুল করা গিরাসি আজ পেনাল্টি থেকে গোল করতে ভুল করলেন না।
প্রথমার্ধের শুরুটা বরুসিয়ার হয়েছিল মনমতো, শুরুর বিশ মিনিটে ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক দেখেছে ম্যাচটা। বার্সেলোনা ধীরে ধীরে ম্যাচে ফিরেছে বটে, তবে লামিন ইয়ামাল, রাফিনিয়া কিংবা রবার্ট লেভান্ডভস্কিদের পারফর্ম্যান্স দেখে মনে হয়নি এই দলটা গোল করতে পারে। শুরুর অর্ধে তা পারলও না।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে দ্বিতীয় গোলের দেখা পেয়ে গেল স্বাগতিকরা। এবারও সেই গিরাসিই। বার্সার প্রথম লেগের লিডটা চকিতে নেমে এল অর্ধেকে, আর ততক্ষণে রোমা, অ্যানফিল্ডের ভুত খুব ভালোভাবেই সওয়ার হয়ে গেছে দলটার কাঁধে। ঠিক তখনই দলটা লাইফলাইন পেল ফেরমিন লোপেজের কাছ থেকে। তার ক্রস ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজেদের জালেই জড়িয়ে দিলেন কাল ৩০ ছুঁতে যাওয়া র্যামি ব্যানসেবাইনি।
একটু পর পেদ্রি এলেন। মাঝমাঠের দখলটাও একটু একটু করে বুঝে পেতে শুরু করল বার্সা। আর একটা গোল পেলেই ম্যাচটার হিসেব শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু লেগানেস ম্যাচের মতো বার্সেলোনার ফরোয়ার্ডরা যেন আজ পণই করে বসেছিলেন, গোল করব না কেউই। ফরোয়ার্ডদের একপাশে রাখুন না হয়, জুলস কুন্দে, ফেরমিন লোপেজদের কাছে একাধিক সুযোগ এসেছিল, তারাও কেউ জালের দেখা পাননি শেষমেশ।
এমন সব কাণ্ড মনে করাচ্ছিল যথাক্রমে ৫ আর ৬ বছর আগের ওই দুই ম্যাচ, যেখানে ৩ গোলের লিড হারিয়ে বিদায় নিতে হয়েছিল বার্সাকে। সে ম্যাচদুটোতেও বার্সা একগাদা সুযোগ নষ্ট করেছিল, পরিণতি হিসেবে বাদ পড়তে হয়েছিল দলটাকে।
সেসব ম্যাচের সঙ্গে এদিনের আরও এক মিল, রক্ষণাত্মক ভুল। সে ভুলটা ৭৬ মিনিটে করে বসলেন রোনাল্ড আরাউহো। নিচু ক্রস ক্লিয়ার করতে গিয়ে তুলে দিলেন হ্যাটট্রিকের অপেক্ষায় থাকা গিরাসির পায়ে।
সামনে থাকা আরাউহো আর শেজনিকে বোকা বানিয়ে জালে পাঠাতে ভুল করেননি তিনি। তাতেই প্রথম আফ্রিকান খেলোয়াড় হিসেবে বার্সার বিপক্ষে হ্যাটট্রিকের স্বাদ পেয়ে যান তিনি।
একটু পর বদলি হিসেবে নামা জুলিয়ান ব্রান্ডটও বল জড়ালেন বার্সার জালে। আপনি বার্সাভক্ত হয়ে থাকলে ততক্ষণে আপনার আত্মারাম খাঁচাছাড়াই হয়ে যাওয়ার কথা। তবে সঙ্গে সঙ্গে লাইন্সম্যানের অফসাইডের পতাকা দেখে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে বার্সার।
এরপর একটু একটু করে বার্সা অপেক্ষা করেছে শেষ সময়ের। কচ্ছপের পিঠে চড়ে সে সময়টা যখন এল, চূড়ান্ত স্বস্তির নিশ্বাসটা কাতালানরা ফেলল তখন। তবে ততক্ষণে দুটো রেকর্ড ভেঙে গেছে। বরুসিয়ার কাছে কখনো হারেনি বার্সা, আজ হারল। যা আবার চলতি বছর বার্সার প্রথম হারও বটে।
সেসব নিয়ে আজ মাথা ঘামানোর সময় কমই আছে। বার্সা যে উঠে গেছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে, নকআউট জুজু কাটিয়ে, মেসি-পরবর্তী যুগে প্রথম বারের মতো। শেষবার কবে বার্সা সেমিতে খেলেছিল জানেন? আজকের ম্যাচটা যে ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে, সে লিভারপুলের বিপক্ষে ২০১৯ সালে। এবার ফলটা তেমন কিছু হোক, তা নিশ্চয়ই চাইবে না। বায়ার্ন মিউনিখ হোক বা ইন্টার মিলান, যেই আসুক না কেন, তাদের হারিয়ে ফাইনালেই নিশ্চয়ই নিজেদের দেখতে চাইবে কোচ হানসি ফ্লিকের দল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।