জুমবাংলা ডেস্ক : নেত্রকোণা মূলত ধান উৎপাদনকারী একটি জেলা। খাদ্য চাহিদার বিপরীতে প্রায় আড়াই গুণ বেশি ধান উৎপাদন হলেও জেলায় দিন দিন কমছে স্থানীয় জাতের ধানের আবাদ। বর্তমানে স্থানীয় জাতের ধানের আবাদ কমে মোট আবাদের ০.০৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এ বছর বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৫০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের ধানের আবাদ হয়েছে। শতকরা হিসেবে যা মোট আবাদের ০.০৮ শতাংশ।
এ জেলায় আমন ও বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়। মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা তাদের জমিতে যেন অধিক ফলন পান সেজন্য তারা উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে যেহেতু বছরে একবার ফসলের (বোরো মৌসুম) আবাদ হয়। আগাম বন্যার কবল থেকে তাদের উৎপাদিত ফসল রক্ষায় তারা স্বল্প জীবনকালীন বা উচ্চফলনশীল জাতের ধান আবাদ বেশি আবাদ করেন বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
কৃষকরা বলছেন, দেশি বা স্থানীয় জাতের ধানের চেয়ে স্বল্প জীবনকালীন বা হাইব্রিড ধানের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়। তাছাড়া স্বল্প জীবনকালীন (ব্রি ধান-২৮, ৮৮, ৯৬ ) জাতের ধান, স্থানীয় জাতের ধানের চেয়ে প্রায় ২০/২৫ দিন আগে কাটা যায়। এসব ধানের বীজ কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছরই তাদের বেশি দাম দিয়ে বীজ কিনতে হচ্ছে। এতে উচ্চফলনশীল জাতের ধানের আবাদ করতে কৃষকের খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
সদর উপজেলার চরপাড়া গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ এরশাদ খান বলেন, হাইব্রিড ধান চাষের মূল কারণ হচ্ছে ফলন বেশি হয়। আর দেশি ধানে পোকামাকর কম হলেও ফলন কম হয়, এজন্য আমরা স্থানীয় জাতগুলো আবাদ কম করি। দেশি ধান এখন আবাদ হয় না বললেই চলে। আগে আমরা বিরই, নাতিশাইল, তুলসীমালা, কালোজিরা এগুলোর আবাদ করতাম। কিন্তু এখন এগুলো নাই বললেই চলে। সময়ের সাথে সাথে এগুলো হারিয়ে গেছে। আগে এক বাড়িতে ভাত রান্না করলে আরেক বাড়ি থেকে বুঝা যেত কোন চালের ভাত রান্না হচ্ছে। আর এখন তো পোলাওয়ের চাল রান্না করলেও গন্ধ পাওয়া যায় না।
সাকুয়া গ্রামের বাসিন্দা কুলসুম বেগম বলেন, আমরা আগে দেখছি বছরে দুইটা ফসল আবাদ করতো। একটা বাওয়া আর একটা আউশ। তখন বোইল্লা নামের ধান চাষ করতো, কালো রঙের হতো ওই ধানটা। ১০-১৫ সের করে ধান হতো ধান হতো প্রতি কাঠায়। আর এগুলো দিয়েই কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে আমরা দিন পার করতাম। আর এখন সমপরিমাণ জমি থেকেই কয়েক গুণ বেশি ধান আমরা ঘরে তুলতে পারি। আগে ৫-৭ জাতের ধান ছিল কিন্তু এখন যে কত ধরনের ধান এটার কোনো শেষ নেই। আমি আর এখন কোনো ধানের নাম বলতে পারি না। আগে আমাদের মা-চাচিরা বীজ ধান মটকায় ভরে রাখত। আর এখন দেখি সবাই প্যাকেট ধান কিনে নিয়ে এসে চাষ করে। আমরা বললে তো আর পুরুষ লোকেরা শুনে না। আমরা যদি বলি বিরই ধান চাষ করো, বিরইয়ে ভাত খাইতে খুব ভালা, তারা তো সেটা করবে না।
নেত্রকোণা সদর উপজেলার চল্লিশাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মুজিবুর রহমান আফসোস করে বলেন, আগের সময়ে খুব ভালো মানের ধান ছিল। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, কার্তিকশাইল, নাজিরশাইল, চিনিশাইল, কালোজিরা, টেপি এগুলো ছিল। আমাদের বাবাকেই দেখছি আট রকমের ধান চাষ করত অল্প অল্প করে। এখন বর্তমানে হাইব্রিড ছাড়া আর কোনো কিছু চাষ হয় না বললেই চলে। সবাই শুধু ধানের ফলন বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে। আমরা এখন চালের সঙ্গে বিষ খাচ্ছি। কীটনাশক ছাড়া কোনো ধানের আবাদ করা যায় না। আগে তো এগুলো কোনো কিছু দিতে হয় নাই, সার পর্যন্ত দিতে হয় নাই। আগে আমরা যে ভাত খেতাম সেটা অনেক সুস্বাদু ছিল, এখন তো শুধু খেয়ে যাচ্ছি এই পর্যন্তই কোনো রস-কষ নাই।
তবে স্থানীয় জাতের ধানের উৎপাদন কম হলেও বাজারে এর চাহিদা রয়েছে। এছাড়া দামও ভালো পাওয়া যায়। কৃষকরা বলেন, স্থানীয় জাতের ধানের ভাত অনেক সুস্বাদু হয়। এক সময় এ জেলায় বিরই, কালোজিরা, নাতিশাইল, টেপি, জলকুমড়ী, কাইশাবেণী বাসমতিসহ বিভিন্ন জাতের ধানের আবাদ হতো। এখন এসব স্থানীয় জাতের ধানের আবাদ কমে যাচ্ছে।
এনামুল খান নামে এক কৃষক বলেন, আমি হাইব্রিড এবং স্থানীয় জাত দুটোই চাষ করেছি। হাইব্রিডের ক্ষেত্রে দেখা যায় খরচ বেশি হয়, আবার ফলনও ভালো হয়। আবার দেশি ধানের ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার কম দিতে হয় এবং ফলনও কম হয়। যেমন কালোজিরা ধান আমি দুই কাঠা জমিতে রোপণ করেছি। এটাতে আমার খরচ কম হয়েছে কারণ এখানে রাসায়নিক সার কম দিয়েছি। আবার উৎপাদনও কম হয়েছে। কিন্তু এ ধানের চাল অনেক সুস্বাদু এবং অনেক সুগন্ধি আছে। আর হাইব্রিড যে ধানের জাতগুলো আছে সেগুলো পাঁচ-ছয় মণ করে হয়েছে। কিন্তু এই ধানটা সিদ্ধ করে সংরক্ষণ করলে এটার চালটা ততটা সুস্বাদু হয় না। হাইব্রিড জাতগুলো আসায় আমাদের কাছ থেকে দেশীয় ধানের বীজগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, আমাদের জায়গা বাড়ছে না কিন্তু মানুষ বাড়ছে। এজন্যই আমাদের মাঝে হাইব্রিড জায়গা করে নিচ্ছে আর দেশি জাতগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও আমি চাই আমরা সবাই মিলে আমাদের দেশি জাতগুলোকে সংরক্ষণ করি। এগুলো যেন আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে না যায়।
জেলায় স্থানীয় জাতের ধানের আবাদ বৃদ্ধি এবং আবাদে বৈচিত্র রক্ষা করতে বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) নামে একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বীজ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছে। সংস্থাটি ২০০৫ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
বারসিক’র আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মো. অহিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক সময় ১৮ হাজার স্থানীয় ধানের জাত ছিল, যা এখন বিলুপ্ত প্রায়। এসব স্থানীয় জাতের ধানের বীজ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ করতে আমরা ২০০৫ সাল থেকে কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে ৫০৪ টি স্থানীয় জাতের ধান সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমাদের প্রচেষ্টায় বর্তমানে ৮৭টি গ্রামে আমাদের এই কাজগুলো সম্প্রসারিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬৫টি ধানের জাত কৃষকরা ভালো হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এর মধ্যে মালশিরা ও হেকিম ধান নামে দুটি জাত খুব জনপ্রিয় হয়েছে কৃষকদের মাঝে। জাতগুলো কৃষক থেকে কৃষকের কাছে দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এই জাতগুলো চাষ করার মূল কারণ হলো ধানগুলোতে খরচ তুলনামূলক কম এবং পোকা মাকড়ের আক্রমণ কম। তাই এই জাতগুলো কৃষকরা বাছাই করেন। কেউ এগুলো থেকে নিজেরা ভাত খান, আবার কেউ নিজেরা পিঠা বানানো বা অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য চাষ করেন। ধানগুলো আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। একটি ধান থেকে যখন পিঠা বানানো হয় তখন সেটি ওই সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায়। যেমন বিন্নি ধান আদিবাসীদের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় জাতের ধানের বীজগুলো একটি সম্পদ। যে সম্পদটা কৃষকরা হারিয়ে ফেলে এখন কোম্পানির দ্বারে দ্বারে ঘুরে হাইব্রিড ধানের বীজ সংগ্রহের জন্য। পাশাপাশি তারা বিভিন্নভাবে প্রতারিত হন। এই প্রতারণার হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য আমরা আমাদের কাজগুলো করে যাচ্ছি।
জেলা কৃষি বিভাগ মূলত মাঠপর্যায়ে ধানের উৎপাদন বাড়াতে যে সব জাতের ফলন বেশি হয় সে সব ধানের জাত সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়ছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৫ বছর আগেও ১২৪০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের ধানের আবাদ হতো। যা এখন মাত্র ১৪০ হেক্টরে নেমে এসেছে। কৃষকরা ধানের আবাদ করে যেন অধিক ফসল পেতে পারেন সেজন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য আমরা ধানের যে উচ্চ ফলনশীল জাতগুলো আছে, সেগুলো মাঠপর্যায়ে বিস্তার ঘটানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি হাইব্রিডের জাত যেগুলো আছে সেগুলো আমাদের মাঠপর্যায়ে আবাদ সম্প্রসারণ হচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে।
মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, আমাদের এ জেলায় স্থানীয় জাতের আবাদ একেবারেই কম। বোরো মৌসুমে মাত্র ১৬০ সেক্টরের মতো জমিতে স্থানীয় জাতের ধান আবাদ হয়েছে। আগে এ সকল এলাকায় অনেক ধরনের স্থানীয় জাতের আবাদ হতো। এই স্থানীয় জাতগুলোর যেহেতু ফলন কম হয়, তাই স্থানীয় জাতগুলোর পরিবর্তে বেশিরভাগ জায়গায় উচ্চ ফলনশীল জাতগুলো আবাদ হচ্ছে। কৃষক ভাইয়েরা বেশি পরিমাণে ফলন পাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা কৃষি বিভাগ মূলত কৃষকদের ভাইদের ধানের উৎপাদন যেন বেশি হয় সেটি মাথায় রেখে মাঠে কাজ করে যাচ্ছি। সে হিসেবে যে জাতগুলো থেকে ফলন বেশি আসবে, সে জাতগুলো মাঠে সম্প্রসারণের জন্য আমরা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে যেগুলো মাঠপর্যায়ে বিস্তারের জন্য অবমুক্ত করা হয়, সেই জাতগুলো সাধারণত কৃষকদের মাঝখানে আমরা বিস্তার করে থাকি।
নতুন যে জাতগুলো আছে বিশেষ করে আমন মৌসুমের জন্য ব্রি-ধান ৭১, ব্রি-ধান ৭৫, ব্রি-ধান ৮৭, ব্রি-ধান ১০৩, এবং বিনা ধান-১৭ এগুলো আমরা মাঠপর্যায়ে বিস্তার ঘটাচ্ছি। বোরো মৌসুমের জন্য ব্রি-ধান ৮৮, ব্রি-ধান ৮৯, ব্রি-ধান ৯২, ব্রি-ধান ১০২ এই জাতগুলো আমরা কৃষকদের আবাদের জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। এগুলোর ফলন ভালো এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম। ধানের এই জাতগুলো মাঠপর্যায়ে ব্যাপক বিস্তারের ফলে আমাদের নেত্রকোণা জেলা একটি ধান উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে পরিণত হয়েছে। আমাদের যে পরিমাণ খাদ্য চাহিদা রয়েছে তার থেকে প্রায় আড়াই গুণ বেশি উৎপাদন হচ্ছে বর্তমানে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।