ভরা মৌসুমেও আকাশছোঁয়া ইলিশের দাম। দেশের বাজারে কিছুটা কমলেও এখনও তা ক্রেতার নাগালের বাইরেই রয়েছে। রাজধানী থেকে শুরু করে চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ কিংবা পটুয়াখালী-সব জায়গার বাজারেই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে এই রুপালি মাছ। ফলে ভোজনরসিক বাঙালির পাতে ইলিশ ওঠাই এখন যেন দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে গিয়েও ক্রেতারা ইলিশের দিকে হাত বাড়াতে ভয় পাচ্ছেন।
প্রবাদ আছে, ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। কিন্তু চাল ও মাছের অস্বাভাবিক দামে সেই প্রবাদও এখন ফিকে। ইলিশের চড়া দামের বিষয়টি স্বীকার করেছেন খোদ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারও। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, ‘দেশে ইলিশের ভরা মৌসুম চললেও দাম এখনও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আসেনি।’
ইলিশের দাম নিয়ে ক্রেতাদের ক্ষোভও স্পষ্ট। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাছ কিনতে আসা আজিজুল বলেন, ‘দাম তো কমছেই না। ইলিশ এখন বড়লোকের মাছ হয়ে গেছে।’
রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শ্যামবাজার, কারও‘য়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ১ কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২২০০-২৪০০ টাকায়, ৮০০-৯০০ গ্রামের ইলিশ ১৮০০ টাকা, ৫০০-৬০০ গ্রামের ইলিশ ১৬০০ টাকা এবং দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ৩০০০ থেকে ৩২০০ টাকায়। চাঁদপুরের বড়স্টেশন পাইকারি বাজারেও একই চিত্র। সেখানে পদ্মা ও মেঘনায় ধরা এক কেজি ওজনের ইলিশ ২৪০০ টাকা, আর দক্ষিণের সাগরের ইলিশ ২২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে খুলনায় গত শুক্রবার দাম কিছুটা কমলেও তিনদিন পর আবারও উর্ধ্বমুখী। রোববার সন্ধ্যায় খুলনার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শুক্রবারের বাজার দরের থেকে কেজি প্রতি ইলিশের দাম বেড়েছে আকারভেদে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
রূপসা মাছ বাজারের ক্রেতা গৃহিনী নাজমা সুলতানা বলেন, ‘এক মাসে ইলিশ কিনেছিলাম যে দরে, আজও সেই দরেই ইলিশ কিনতে হচ্ছে। ইলিশের এখন ভরা মৌসুম। এই সময়ে এত দাম থাকবে কেন? দাম কিছুটা কম শুনে বাজারে এসেছিলাম, কিন্তু সেই আগের দামেই কিনতে হচ্ছে।’
ব্যবসায়ীরা ও আড়তদাররা বলছেন, ইলিশের দাম ওঠানামা করেছে। একদিন সামান্য কমলে পরের দিন আবার বেড়ে যাচ্ছে।
রাজধানীর কাওরান বাজারের ইলিশ ব্যবসায়ী মো. শুকুর আলী বলেন, ‘এবার ৫৮ দিন সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। নিষেধাজ্ঞার পর লঘুচাপের কারণে জেলেরা ঠিকমতো সাগরে যেতে পারেননি। তাই ইলিশ কম ধরা পড়ায় দাম চড়েছিল। এখন কিছুটা সরবরাহ বাড়ায় দাম কমছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে মাছ ধরা পড়বে; তখন দাম হয়তো খানিকটা কমবে।’
খুলনার রূপসা মাছ বাজারের বিক্রেতা আল আমিন বলেন, ‘গত সপ্তাহে যে চালান এসেছিল, সেই মাছ শেষ হয়ে গেছে। নতুন চালানে মাছ আসছে খুব কম। এখন গোন (মাছ বেশি পাওয়ার বিশেষ সময়) চলছে না, সামনের সপ্তাহে আবার গোন হলে বেশি মাছ পাওয়া যাবে, তখন সরবরাহ বাড়লে মাছের দাম কিছুটা কমবে।’
সরবরাহ ঘাটতির আশঙ্কা প্রকাশ করে মাছ ব্যবসায়ী হরিপদ বর্মণ বলেন, ‘মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ও সাগরে লঘুচাপের কারণে ইলিশ কম ধরা পড়েছে। এছাড়া দুর্গাপূজা উপলক্ষে ইলিশ রফতানির অনুরোধ জানিয়েছে ভারত। ভারতে ইলিশ রফতানির অনুমতি দেয়া হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা মজুত শুরু করতে পারে, এতে বাজারে দামের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে।’
ইলিশের চড়া দাম প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ইলিশের মৌসুম শুরুর আগেই দাদনের মাধ্যমে জেলেদের সমুদ্রে পাঠান আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। শর্ত থাকে-সব মাছ তাদের কাছেই বিক্রি করতে হবে। এভাবে ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। পরে তারা সিন্ডিকেট করে মজুত করেন এবং কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেন। ফলে মৌসুমে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া হলেও প্রকৃত জেলেরা সেভাবে ন্যায্য দাম পান না। সমস্ত সুবিধা নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। আর এভাবেই সাধারণ মানুষের পকেট কাটছেন তারা।’
এদিকে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য অধিদফতরের ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ সামনে ইলিশের দাম কিছুটা কমার বিষয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, সাধারণত আগস্ট-সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে বেশি ইলিশ মেলে। কিন্তু এবার এখনও পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এর মূল কারণ সাগরে একের পর এক লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়া। ফলে জেলেরা নিয়মিত সাগরে যেতে পারছেন না। সাগরে মাছ থাকলেও জেলে মাছ শিকারে নামতে না পারায় পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত হচ্ছে না।
আবহাওয়া অনুকূলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে এবং ১ কেজি ওজনের ইলিশের দাম ১ হাজার ৫০০ টাকায় নেমে আসতে পারে। তবে ছোট বা বড় আকারের ইলিশের দাম একইভাবে কমবে কি না, তা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের প্রভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাজারে সিন্ডিকেট তো কিছুটা অবশ্যই রয়েছে। বর্তমানে আড়তে জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ কেনা হচ্ছে ঢলন প্রথার মাধ্যমে (প্রতি মণ ইলিশের হিসাব ধরা হচ্ছে ৪২ কেজিতে)। অর্থাৎ প্রতি মণে জেলেদের ২ কেজি অতিরিক্ত মাছ দিতে হচ্ছে। এতে জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আড়তদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছেন।’
মোল্লা এমদাদুল্লাহ আরও বলেন, ‘ভোক্তার হাতে ইলিশ পৌঁছাতে পৌঁছাতে কয়েকবার হাতবদল হয়। প্রতিটি ধাপেই দামের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এই ধাপগুলো কমিয়ে আনা গেলে দাম অনেকটা কমানো সম্ভব। পাশাপাশি ভোক্তাদেরও প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইলিশ কিনে মজুত করার প্রবণতা কমাতে হবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।