অর্চি অতন্দ্রিলা, বিবিসি নিউজ বাংলা : বিশ্বজুড়েই বিভিন্ন ধর্ম কিংবা লোককাহিনীতে প্রথম মানব হিসেবে আদম-হাওয়া বা ইংরেজিতে অ্যাডাম-ইভের নাম আসে। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গের একদম প্রথমদিকের সূত্রও আছে সেখানে।
বলা হয়, তাদের দুই সন্তান হাবিল ও কাবিল (কুরআন), ইংরেজিতে Able & Cain (পুরাতন বাইবেল) ছিল যথাক্রমে রাখাল ও কৃষক। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে দুই ভাই একটি করে কুরবানি হাজির করেছিল যার একজনেরটা কবুল হয় বলে উল্লেখ রয়েছে কুরআনে।
ইহুদি ধর্মগ্রন্থ বা আদি বাইবেল অনুযায়ী এবল তার পালের শ্রেষ্ঠ মেষ নিয়ে যায়, আর কেইন নিয়ে যায় নিজ ক্ষেতের কিছু শস্য। এর মাঝে এবলেরটা গ্রহণ করা হয়, কেইনেরটা নয়। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, এবল যেমন শ্রেষ্ঠ উপকরণ বেছে নিয়েছিল, কেইন তেমনটি করেনি।
পরবর্তীতে প্রতিহিংসায় এবলকে হত্যা করে কেইন। তবে পশু কোরবানি নিয়ে ইসলামে যে ব্যাপক প্রচলন সেটি অবশ্য এসেছে আরও অনেক পরে ভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।
কিন্তু অন্য ধর্মে বিষয়গুলো কীভাবে রয়েছে? বিশেষত হিন্দু ধর্ম, ইহুদি ধর্ম ও খ্রিষ্টধর্মে পশু উৎসর্গের রীতি বা প্রচলন সম্পর্কে কেমন ব্যাখ্যা রয়েছে?
হিন্দু বা সনাতন ধর্ম
হিন্দু ধর্মে পশু বলি বিষয়টা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই মতভেদ থাকলেও এর চর্চা যে নেই তেমনটাও নয়। যেমন বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই দুর্গাপূজা বা কালিপূজা ছাড়াও অনেক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে পশু বলি দেয়া হয়।
বিশেষত ‘শাক্ত’ মতাবলম্বী, অর্থাৎ ‘শক্তি’ বা দেবীকেন্দ্রিক উপাসনায় এই প্রথার প্রচলনের কথা উল্লেখ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তী।
“বিবিধ শাস্ত্রে এই পশু বলির কথা উল্লেখ রয়েছে, যেমন রামায়ণ, মহাভারত, বিবিধ পুরাণ; পশু বলি বিষয়টি সনাতন ধর্মে বৈদিক যুগ থেকেই আছে। ঋগ্বেদের প্রথম মন্ডলে ১৬২ নম্বর সূক্তে অথবা যজুর্বেদের মধ্যেও আছে, সেখানে বলির যে পশু আছে সে মুক্তি লাভ করে, বন্ধন থেকে মুক্ত হয়” এমন উদাহরণ দেন তিনি।
এমন ক্ষেত্রে ছাগল অথবা মহিষ উৎসর্গের প্রচলনটাই বেশি।
বেদ থেকে সনাতন ধর্মের দুই ধরনের উপাসনা পদ্ধতি আসে, সাকার ও নিরাকার। সাকারের মধ্যে পাঁচটি মতের একটি শাক্ত। আর বাঙ্গালিদের মধ্যে শাক্ত মতাবলম্বী বেশি থাকায় দুর্গাপূজা বা কালীপূজার প্রাধান্য দেখা যায়।
বাঙ্গালিদের অনেক প্রাচীন মন্দিরগুলোতে এখনও বলির প্রচলন দেখা যায়।
যেমন বাংলাদেশে ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির, চট্টগ্রামের চট্টেশ্বরী মন্দির, ভারতের ত্রিপুরার বড় মন্দির ত্রিপুরা সুন্দরী, আসামের কামাখ্যা, কোলকাতার কালীঘাট এমন বেশ কিছু মন্দিরের কথা উল্লেখ করেন ড. চক্রবর্তী।
ঐতিহাসিক দিক বিবেচনায় হিন্দু ধর্মে যেটি বহুল আলোচিত সেটি অশ্বমেধ যজ্ঞ। ভারতের পৌরাণিক বিষয়ক লেখক ড. রোহিণী ধর্মপাল রামায়ণ ও মহাভারতের উদাহরণ দিয়ে বিবিসিকে বলেন, সেই যজ্ঞের নিয়মটাই ছিল যে ঘোড়া ছেড়ে দেয়া হতো, এবং যিনি সম্রাট হবেন তার প্রতিনিধিরা সেই ঘোড়ার সঙ্গে থাকতেন।
সেই ঘোড়া যে যে রাজ্য ঘুরবে, সেই রাজ্যগুলির লোক যদি ঘোড়াকে আটকাতো তাহলে যুদ্ধ হতো ঐ রাজার প্রতিনিধির সঙ্গে। কোনও রাজ্যে যদি ঘোড়াকে না আটকানো হতো তাহলে ধরে নেয়া হতো এই ঘোড়াটি বা সেই রাজা এই রাজ্যটিকে জয় করে নিচ্ছে।
পরিক্রমা করে সেই ঘোড়াটি যখন ফিরতো, সেই ঘোড়াটিকে কিন্তু যজ্ঞের আগুনে দেয়া হতো এবং সেই মাংস সবাই খেতেন।
এছাড়া, “মহাভারতের সময়ও ব্রাহ্মণরাও মাংস খেতেন, রাম নিজেই রীতিমত ননভেজ মানুষ ছিলেন এবং মাংস ছাড়া থাকতে পারতেন না। যখন সীতাকে রাবণ নিয়ে চলে গেছিল তখন বিরহে মদ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল,” উল্লেখ করেন ড. ধর্মপাল।
যদিও তিনি নিজে পশু বলি না বরং মানুষের ভেতরকার নেতিবাচক দিকগুলো বলির বিষয়ে জোর দেন এবং বর্তমানে ভারতে তেমন প্রকাশ্য পশু বলির প্রচলনও তিনি লক্ষ্য করেন না বলে জানান।
শ্রীলঙ্কা এবং নেপালে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পশু বলি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে সেটা যে একেবারেই পালন হয় না তেমনটাও নয়।
অবশ্য এক্ষেত্রে মিঃ চক্রবর্তীর অভিজ্ঞতা ভিন্ন। বাংলাদেশে বড় পরিসরে বেশিরভাগ পূজাতেই বলির প্রচলন দেখেছেন তিনি।
এর মাঝে কালী পূজা, দুর্গাপূজা তো আছেই, এছাড়াও কাত্যায়নী পূজা বা কার্ত্তিক মাসের দুর্গাপূজা, বাসন্তী পূজা বা বসন্তের দুর্গাপূজা, মনসাপূজা, এমনকি বৈষ্ণবরা – যারা সাধারণত পশু বলির পক্ষে না তাদের জগন্নাথ মন্দিরেও সীমিত পরিসরে বা উৎসবে পশু বলির উদাহরণ রয়েছে।
যদিও ইদানিংকার ক্ষেত্রে যেভাবে মাংস খাওয়ার আয়োজন বা বছরব্যাপি ফ্রিজে তুলে রাখতে, সমর্পণ বা দরিদ্রদের দানের দিকে জোর না দিয়ে অনেকটাই আত্মতুষ্টি, প্রতিযোগিতা বা ভোগের প্রবণতা লক্ষ্য করছেন সেটাতে বলির আধ্যাত্মিক মাহাত্মের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে বলে মনে করছেন তিনি।
ইহুদি ধর্ম
ইসলামের ইতিহাসের সাথে অনেকটাই মিল আছে ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের। তবে পশু উৎসর্গ বা কোরবানির দিকটা ইহুদিদের উৎসবেই ছিলো বেশি।
ইহুদি ধর্মে মূলত ৩টি তীর্থযাত্রার উৎসব পেসাহ (Passover), শাভুওয়াত (Feast of Weeks, সপ্তাহের উৎসব), এবং সুখট (Feast of Tabernacles, কৃষি সংক্রান্ত উৎসব) এর সাথে পশু উৎসর্গের রীতির মাহাত্ম রয়েছে।
আর এর বাইরে ‘রশ হাশানাহ’ বা ইহুদি নববর্ষ এবং ‘ইয়ম কিপুর’ (Day of Atonement, প্রায়শ্চিত্তের দিন), এমন সব উৎসবেই পশু উৎসর্গের রীতি থাকার কথা উল্লেখ করেন যুক্তরাজ্যের একজন ইহুদী পণ্ডিত বা র্যাবাই গ্যারি সমারস, যিনি লিও বিক কলেজের একাডেমিক সার্ভিসের প্রধান।
মুসলিমদের কোরবানির ইতিহাসের সাথে যে নবী ইবরাহীমের ঘটনা আসে, সে ইতিহাস ইহুদি ধর্মগ্রন্থেও রয়েছে। তবে ইহুদিদের জন্য পশু উৎসর্গের নির্দেশ আসে আরও পরে একটু ভিন্নভাবে।
প্রাথমিক ইতিহাসের দিকে দেখলে যেমনটা তোরাহ বা তাওরাতে উল্লেখ রয়েছে, ৩০০০ বছরেরও বেশি সময় আগে মিশরের ফারাও বা ফেরাঊন রাজারা ইসরায়েলাইটস নামে একদল ইহুদিকে দাস করে রেখেছিল।
ইহুদি ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ নবী মোশি (আরবীতে মূসা, গ্রীক মোসেস) ফারাওদের কাছে বেশ কয়েকবার দাসকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেন।
এরপর বলেন যদি তাদের মুক্তি না দেয়া হলে ঈশ্বর মিশরীয়দের উপর মহামারী ঘটাবেন। ফেরাউনরা না মানায় মহামারী আসে। সে সময়ের দশটি মহামারীর একটি ছিল মিশরীয় পরিবারে প্রথম জন্ম নেওয়া শিশুটিকে মৃত্যুর দেবদূতের হাতে হত্যা।
সেসময় “ভেড়া কোরবানি দিয়ে তার রক্তচিহ্ন দরজার বাইরে এঁকে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়, যেন মৃত্যুর দূত মিশরের প্রথমজাত সন্তানকে নিতে আসলে তারা সেই চিহ্ন দেখে ইসরায়েলিদের চিনে তাদেরকে বাদ দিতে পারে,” এভাবেই প্রথমবারের মতো পশু উৎসর্গের নির্দেশ আসে যেটা ‘পেসাহ’ বা ‘পাসওভার’ হিসেবে পরিচিত বলে জানান মিঃ সমারস।
বলা হয় এই শেষ মহামারিতে ফেরাউনের নিজ সন্তানের মৃত্যুর পর মূসাকে ডেকে ইহুদি দাসদের নিয়ে মিশর থেকে চলে যেতে বলেন এবং ইহুদিদের ২০০ বছরের বেশি সময়ের দাসত্বের অবসান হয়।
কিতাব অনুসারে ইহুদিদের বেশিরভাগ উৎসবেই নিজস্ব ধরনের উৎসর্গ বা বিসর্জনের উল্লেখ রয়েছে যার নির্দিষ্ট সময় এবং স্থানের নিয়ম রয়েছে বলে উল্লেখ করেন র্যাবাই সমারস।
“এখন অবশ্য আমাদের এমন উৎসর্গের রেওয়াজ নেই কারণ আমাদের সেই মন্দিরটি নেই যেখানে গিয়ে প্রাণী উৎসর্গ করার নিয়ম ছিল। এখন প্রার্থনায় এই উৎসর্গের দিকটা উঠে আসে যেন আমরা সেটা মনে রাখি যে এটা ইহুদি ধর্মের অপরিহার্য অংশ,” বলছিলেন তিনি।
সেই মন্দির বলতে টেম্পল মাউন্টকে বোঝানো হচ্ছে যেখানে এখনকার আল আকসা মসজিদ রয়েছে। ইহুদিরা সেই মন্দির পুনর্গঠনের জন্য প্রার্থনা করেন এবং বিশ্বাস করেন সেই মন্দির পুনর্গঠন হলে তারা ধর্মীয়ভাবে পশু উৎসর্গের রীতিতে ফেরত যেতে পারবেন।
মন্দির না থাকায় বেশির ভাগ ইহুদি পশু উৎসর্গ না করলেও জেরুজালেমে কিছু গোষ্ঠী আছে যারা এখনও পশু উৎসর্গ করেন। যেমন সামারিটান গোষ্ঠী পাসওভারে পশু উৎসর্গ করে থাকেন।
আবার অনেকে আছেন যারা একটি প্রাণী উৎসর্গ করতে যে খরচ হতো সেটা দান করে থাকেন।
আর মেষ, মহিষ, গরু, ভেড়া যেই প্রাণীই হোক না কেন, উৎসর্গের জন্য প্রাণী ধর্মীয়ভাবে নির্দেশিত সুস্থ, নিখুঁত ধরনের বা উপযুক্ত হতে হবে যেটাকে ‘কোশার’ বলা হয়। আর ঠিক উৎসর্গ না করা হলেও অনেক উতসবেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ মাংস খাওয়া।
১২ জিবি র্যামের সংেগ্ দুর্ধর্ষ ফিচার নিয়ে লঞ্চ হলো এই স্টাইলিশ স্মার্টফোন
ইহুদি ধর্মে পশু উৎসর্গের অনেক ধরনের রীতিনীতি এবং নিয়মকানুন রয়েছে যেগুলো উদ্দেশ্যভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।