আজরফ ইসলাম অর্ক : রূপকথারা সিনেমার পর্দায়ও বেশিক্ষণ বাঁচে না। তবু স্বপ্নবিদ্ধ মানুষ এক রূপকথার রাজ্য খুঁজে ফেরে আজীবন। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সিনেমাটি রূপকথার স্বপ্নভূমি যুগোস্লাভিয়ার কথা বলে, যার জন্য একদিন অধীর হয়েছিল বলকান অঞ্চলের মানুষ। তাদের স্বপ্নভূমি ধরা দিয়েও আবার চিরতরে মুছে গিয়েছিল মানচিত্রের বুক থেকে। তারপর অ্যালঝেইমারের রোগীর মতো মানুষ খুঁজে ফিরেছিল নিজেদের ঘর। পরিচালক এমির কুস্তুরিৎসার মতো কেউ কেউ ভুলতে পারেনি সে ক্ষতের কথা। প্রিয়জন হারানোর চেয়ে মানচিত্র হারানোর হাহাকার গভীরতর। দেশভাগ নিয়ে মর্মপীড়া ঋত্বিক ঘটকের মতোই কাঁকরের মতো বিঁধে ছিল এমির কুস্তুরিৎসার মনে। সে কঠোর বাস্তবতার কথা আছে বলেই হয়তো সিনেমাটির অন্য নাম ‘একদা একটি দেশ ছিল’।
১৯৯৫ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমার জন্য পাম ডি’অর পদক জিতে নিয়েছিল সদ্যোজাত দেশ সার্বিয়ার পরিচালক এমির কুস্তুরিৎসা। যদিও এমিরের জন্য সম্মানটা নতুন কিছু নয়। এর আগে যখন এ পদক পেয়েছিলেন, তখন তিনি ছিলেন এক যুগোস্লাভ। বর্তমানে তিনি সার্বিয়ান। নতুন এ পরিচয়কে কখনো মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি এমির।
গল্পটা দুই কমিউনিস্ট মার্কো আর ব্ল্যাকির লাগামহীন বন্ধুত্বের। দুজনই ডাকসাইটে অভিনেত্রী নাটালিয়ার প্রেমে মত্ত। ত্রিকোণ প্রেমের আড়ালে গল্পটা একাধারে পিতা ও পুত্রের, যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ-বিরোধিতার, রক্ষক বনাম ভক্ষকের, দেশপ্রেমের বিপরীতে বিশ্বাসঘাতকতার। সেই বহুস্তর, বহুমাত্রার জটিলতাকে ধরার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। গল্প নয়, সত্য ইতিহাস।
রোমান ও অটোমানদের কাছে পরাধীনতার শেকলে বহু বছর বাঁধা থাকার পর দক্ষিণের স্লাভরা বলকানদের জন্য একটা অভিন্ন রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়, তারা খুঁজে পায় সাধের সে ‘প্রমিজড ল্যান্ড’। ১৯১৮ সালে সার্বিয়া, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া আর মন্টিনিগ্রো সমন্বিতভাবে গঠন করে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন। তারপর একদিন সেখানে হানা দিল এক দানব, ঠিক রূপকথার গল্পের মতো।
১৯৪১ সালের এপ্রিলের এক মধ্যরাতে লুটের অগণিত টাকা ওড়াতে ওড়াতে শহরে ঢোকে মার্কো-ব্ল্যাকি। আর পরদিন সকালে রাজধানী বেলগ্রেডে এসে পড়ল জার্মানদের বোমা। মুহুর্মুহু গুলি, মর্টার শেলের আওয়াজে কেঁপে উঠতে লাগল জাগরেব-মারিবোর আকাশ,৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল যুগোস্লাভিয়া। রক্তে ভিজে যেতে থাকল হাসপাতালের সাদা বেডশিট। ছত্রভঙ্গ মানুষ খুঁজে বেড়াতে লাগল নিরাপদ আশ্রয়। জায়গা খুঁজে নিল মাটির নিচে বাঙ্কারে। সে আন্ডারগ্রাউন্ডে গোপনে চলছে মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের জার্মান ও সরকারবিরোধী কার্যক্রম। এ যেন দেশের মাটির নিচে এক অন্য দেশ।
বিশ্বযুদ্ধের শেষে যখন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটল যুগোস্লাভিয়ার, ততদিনে প্রেসিডেন্ট টিটো হয়ে উঠেছেন দেশটির ভাগ্যবিধাতা। মার্কো আর ব্ল্যাকি রাতারাতি হয়ে পড়ল সে এক নায়কের সহযোগী, টিটোপন্থী কমান্ডোদের নেতা।
ভালোবাসা, বিশ্বাস আর সমর্পণের অদম্য আবেগ বারবার ধ্বনিত হলো জনমানুষের কণ্ঠে।
অথচ বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়া মানুষজন ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না বাইরের পৃথিবীতে থেমে গেছে যুদ্ধের তাণ্ডব। জার্মানদের হামলার কৃত্রিম শব্দ, সাইরেনের আওয়াজে ছলে-বলে-কৌশলে বাঙ্কারবাসীকে বারবার বিশ্বাস করানো হলো সে বানোয়াট যুদ্ধের পরিস্থিতি। এ বাঙ্কার কোল্ড ওয়ারের সময়কার যুগোস্লাভিয়ার আমজনতার প্রতিরূপ, তাদের নিজস্ব জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা।
নিজের হারানো দেশের আদ্যোপান্ত ইতিহাসকে সিনেমার ফ্রেমে ধরতে গিয়ে বাস্তবতা আর স্বপ্নের মাঝের সূক্ষ্মরেখাকে ভেঙে একসঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন এমির কুস্তুরিৎসা। রূপক, স্বপ্নদৃশ্য আর পরাবাস্তব ইমেজারির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করেছেন সরাসরি বাস্তব সব চরিত্র ও দৃশ্যকে। প্রেসিডেন্ট টিটোর সঙ্গে একই ফ্লোরে নাচতে থাকে সিনেমার চরিত্র মার্কো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমাবিধ্বস্ত নগরীর মাঝে হেঁটে বেড়ায় ব্ল্যাকি। যুদ্ধশেষে বিজয় র্যালির পাশে নাচতে দেখা যায় নাটালিয়াকে। এভাবে লং টেক, ট্র্যাকিং শটের ফাঁকতালে ঐতিহাসিক নিউজ ফুটেজের মাঝে ঢুকে গেছে আন্ডারগ্রাউন্ডের চরিত্ররা। বিষাদমাখা কাহিনীকে এমির উপস্থাপন করেছেন চড়া দাগের কৌতুকের মেজাজে। নিয়মের ধার না ধরেই কখনো অতীত, কখনো বর্তমান, আবার কল্পিত ভবিষ্যতে গেছে সিনেমার ন্যারেটিভ।
চোখ ধাঁধানো সিনেমাটোগ্রাফি, অদ্ভুত পোশাক-পরিচ্ছদ আর সেট ডিজাইনেও এমির নজর দিয়েছেন নিজের সংস্কৃতির দিকে। বাঙ্কার, হাইওয়ে, বেলগ্রেডের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বিধ্বস্ত অবস্থা, ডুবতে থাকা ট্রেন আর পাড়ভাঙা নদীর মধ্য দিয়ে যুগোস্লাভিয়াকে বারবার তুলে ধরতে চাওয়ার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় বিচক্ষণ একজোড়া চোখকে। চরিত্রগুলোর উদ্দাম উন্মাদনাকে প্রকাশ করতে আবহসংগীত হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে জিপসি সংগীত, বলকান অঞ্চলের লোকগীত। মনস্তাত্ত্বিকভাবে জটিল, আবেগের ওঠানামায় বহুরৈখিক, যন্ত্রণাকাতর বহুবর্ণিল সব চরিত্রে প্রাণের সঞ্চার করেছেন মিকি মনোজলোভিক, লাজার রিস্তোভস্কি, মিরজানা জোকোভিচ, আর্নস্ট স্টোটজনার। বিশেষ করে নাটালিয়া চরিত্রে মিরজানা জোকোভিচের অভিনয় হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। তার কণ্ঠে যখন বিষাদগ্রস্ত হয়ে ‘আই হ্যাভ বিন ডেড ফর টোয়েন্টি ইয়ার্স’ উচ্চারিত হয়, তখন আন্ডারগ্রাউন্ড আর যুগোস্লাভিয়ার থাকে না, হয়ে ওঠে সমগ্র ইউরোপের, হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।