সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু : সনটা এ মুহূর্তে ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ১৯৭৪ হবে। তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী উদ্বোধন করেছিলেন সে সময়ের বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম কংক্রিটের সেতু, ‘কালীগঙ্গা সেতু’।
আমেরিকান নির্মান প্রতিষ্ঠান VZP (Vienel Zackeri & Perivin) ব্রিজটি নির্মাণ করেছিল। আমরা বলতাম ‘ভেনাল কোম্পানী’। কেন বলতাম, জানিনা। সবাই বলতো আমরাও বলতাম।
সে সময়ের প্রেক্ষিতে সেটি ছিল এক মহাযজ্ঞ। বিশাল বিশাল ক্রেন, বড় বড় পাথর ভাঙার মেশিনসহ আরও কত বিস্ময়কর যন্ত্রপাতি এনেছিল তারা।
এই ব্রিজ নির্মাণে এক ছটাক নদীর বালু, ইটের খোয়াও ব্যবহার করা হয়নি। বড় বড় ডাম্পট্রাকে করে পাথর আনা হতো। বিশাল সাইজের পাথরগুলোকে প্রথমে অটোমেটিক মেশিনে বড় বড় টুকরা করা হতো, তারপর সেগুলোকে মেশিনে পিষে বানানো হতো পাথরের খোয়া, পাথরের বালু।
আমরা তখন স্কুলে পড়ি। বন্ধের দিন হলে তো কথাই নেই, স্কুল খোলার দিনও বিকেলের দিকে ছুটতাম ব্রিজ বানানোর কর্মযজ্ঞ দেখতে। আর নজর থাকতো বড় বড় পাথরের দিকে। সুযোগ পেলে দু-একটাকে চুরি করবার ধান্ধা থাকতো। কিন্তু কড়া পাহারা আর কাঁটাতারের বেড়ার কারণে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সেসময় পাঁচ-দশ কেজি এমনকি এক মণ, দু-মণ ওজনের পাথরগুলো ছিল আমাদের কাছে বিস্ময়কর, অলৌকিক বস্তু।
আর কালীগঙ্গাও তখন ছিল যৌবনবতী। কাঠের জোড় নৌকার ফেরিতে গাড়ি পারাপার হতো। নদীর তীব্র স্রোত আর জলঘূর্ণির কবলে পরে প্রতি বর্ষাতেই দু-চারবার ফেরিডুবি, নৌকাডুবিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতো।
এই নদীতে পিলার বসাতে গিয়ে ‘ভেনাল কোম্পানী’র দম যায় যায় অবস্থাও দেখেছি নিজ চোখে। তীব্র স্রোত আর নদীর তলদেশের মাটি দেবে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছেন বারবার।
একটি দুর্ঘটনার কথা মনে আছে। ব্রিজের কাজে নিয়োজিত একটি এসকেভেটরের চালক কর্মরত অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁকে যখন মহকুমা সদর হাসপাতালে আনা হয় তখন তাঁর পুরো শরীরে এক ইঞ্চি চামরাও ছিল না। সাদা ধবধবে একজন মানুষ। ঢাকা নেবার আগেই তার মৃত্যু হয়েছিল। এসকেভেটরের ওয়েলট্যাংক বিস্ফোরিত হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
তরা ঘাটে যেদিন কালীগঙ্গা ব্রিজের উদ্বোধন হয় সেদিন মানিকগঞ্জে ছিল সাজ সাজ রব। বিশেষ করে আমাদের বাড়ির পাশে সিএণ্ডবি’র (বর্তমানে যার নাম রোডস এন্ড হাইওয়ে) ডাকবাংলো সাজানো হয়েছিল বিয়েবাড়ির মত। ঢাকা থেকে আসা মন্ত্রী, সচিবসহ বড় বড় কর্তাদের পনেরো-বিশটি গাড়ির বহর ছিল ডাকবাংলোয়। অতিথিরা ব্রিজ উদ্বোধন করে নাস্তা আর মধ্যাহ্নভোজ সেরেছিলেন এখানে। আমাদের শহরে তখন মাত্র দুতিনটি গাড়ি চলতো। এত গাড়ি একসাথে দেখার বিষয়টি ছিল আমাদের কাছে ঘোর লাগার মত। ভিতরে ঢুকবার সাহস আর পারমিশন ছিল না বলে আমাদের বয়েসি ডজনদুয়েক কিশোর ডাকবাংলোর নিচু দেয়ালের এপাশ থেকে সব দেখছিলাম।
একসময় মাঝারিপদের এক কর্তা দুজন কর্মচারীকে নিয়ে গেটের কাছে আসলেন। তাদের হাতে ছিল বড়সাইজের দুটো কার্টন বক্স। আমাদের ডাকলেন, আমরা সভয়ে ভিতরে ঢুকতেই আমাদের সবাইকে একটি করে নাস্তার প্যাকেট দিলেন, ঢাকা থেকে আনা। প্যাকেটের ভিতরে তিনচার পদের খাবার ছিল। কেকের টুকরো ছাড়া বাকিগুলোর নাম তখন জানতাম না।
সেই নদী মাত্র ৫৪ বছরের ব্যবধানে আজ প্রাণহীন বালুচর। মাত্র মাস তিনেক জলের খেলা থাকে তারপর কালীগঙ্গা পরিণত হয় স্রোতহীন টুকরো টুকরো অসংখ্য ডোবায়। দিন গড়াচ্ছে হারাচ্ছে কালীগঙ্গা।
স্বাধীন দেশে আমাদের প্রাণের নদীরা মরে গেল, চোখের সামনে, অবলীলায় মরে গেল, আমরা কেউ কষ্ট পেলাম না!
লেখক- সিনিয়র সাংবাদিক ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।