বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : ফসিল, মৃতদেহ, এমনকি সভ্যতার নিদর্শনের বয়স বের করতে কার্বনের তেজস্ক্রিয় ধর্মকে কাজে লাগানো হয়। সাধারণ কার্বন তেজস্ক্রিয় নয়। এর একটা আইসোটোপ আছে। সাধারণ কার্বনকে বলা হয় কার্বন ১২। এর অন্য আইসোটোপটির নাম কার্বন ১৪। ১৪, কারণ, এর নিউক্লিয়াসে দুটো অতিরিক্ত নিউট্রন আছে, সেই নিউট্রন দুটোতেই ভাঙন ধরে।
কার্বন ১৪-এর পারমাণবিক ভর ১৪। আবার নাইট্রোজেনের পারমাণবিক ভর ১৪। পার্থক্য আসলে প্রোটন আর নিউট্রনের সংখ্যাতে। নাইট্রোজেনের নিউক্লিয়াসে ৭টি প্রোটন আর ৭টি নিউট্রন থাকে। অন্যদিকে কার্বন ১৪-তে থাকে ৮টি নিউট্রন আর ৬টি প্রোটন। এখানে মজার একটা ব্যাপার আছে।
তেজস্ক্রিয় কার্বন, অর্থাৎ কার্বন ১৪ কিন্তু অনবরত তৈরি হচ্ছে পৃথিবীতে। কীভাবে?
নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার সাহায্যে। সেই বিক্রিয়া ঘটাতে সাহায্য করছে মহাকাশ থেকে আসা নিউট্রন। মহাকাশ থেকে প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে ধেয়ে আসছে কসমিক রে বা তেজস্ক্রিয় রশ্মি। এই রশ্মিতে নানা রকম কণা থাকে, তরঙ্গ থাকে। এদের মধ্যে একটা বড় উপাদান হলো নিউট্রন। এর সবচেয়ে বড় জোগানদাতা সূর্য নিজে।
কসমিক রশ্মি থেকে ছুটে আসা নিউট্রন আঘাত করছে বায়ুম্ললে। এর ফলে বায়ুমলের অন্য উপাদানগুলোর কী হচ্ছে কে জানে, প্রভাবিত হচ্ছে নাইট্রোজেন গ্যাস। প্রবল বেগে ধেয়ে আসা নিউট্রনগুলো আঘাত করছে নাইট্রোজেনের নিউক্লিয়াসে। ফলে ভাঙন ধরছে নাইট্রোজেনের নিউক্লিয়াসে। আঘাতের ফলে নিউক্লিয়াস থেকে ছিটকে যাচ্ছে একটা করে প্রোটন আর যোগ হচ্ছে মহাকাশ থেকে আসা নিউট্রনটি। সুতরাং নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াসে তখন নিউট্রনসংখ্যা হচ্ছে ৮ আর প্রোটনসংখ্যা কমে দাঁড়াচ্ছে ৬। নিউক্লিয়াসে প্রোটনসংখ্যা আসলে একটা মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা।
আর পারমাণবিক সংখ্যার ওপরই নির্ভর করে পরমাণুর ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য। নিউট্রনসংখ্যা যতই হোক, একটা নিউক্লিয়াসে ৬টি প্রোটন থাকা মানে সেটা কার্বনের পরমাণু। নিউট্রনের আঘাতে তাই নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াসের যে বদল ঘটছে, এর ফলে কমে যাচ্ছে প্রোটনসংখ্যা। তাই সেটাকে আর তখন নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াস বলা যাবে না। সেটা তখন কার্বনের নিউক্লিয়াসের মতো আচরণ করবে। সুতরাং নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াস রূপ বদল করে বনে যাবে কার্বনের নিউক্লিয়াসে।
নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াস কার্বনের নিউক্লিয়াসে পরিণত হবে ঠিকই, কিন্তু এর নিউক্লিয়াসের বাইরে যে ৭টি ইলেকট্রন ছিল, সেটার কী হবে। ৬ ইলেকট্রন যেহেতু ৬টি প্রোটনের আকর্ষণে বাঁধা পড়বে, বাকি ইলেকট্রনটি তখন হয়তো ছিটকে বেরিয়ে যাবে নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ থেকে। এভাবেই জন্ম হয় কার্বন ১৪। কিন্তু ঝামেলা একটা রয়েই যায়। কার্বন ৬-এর যে নিউক্লিয়াসের আকার, সেখানে ৬টি প্রোটন আর ৬টি নিউট্রন থাকতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে। কিন্তু বাড়তি দুটি নিউট্রনকে জায়গা দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায়। স্থিতিশীল অবস্থায় থাকতে পারে না নিউক্লিয়াস। তাই অচিরেই ভাঙন ধরে সেই নিউক্লিয়াসে। বিটা রশ্মি বিকিরণ করে একটা নিউট্রন পরিণত হয় প্রোটনে। ফলে বেড়ে যায় একটা প্রোটনের সংখ্যা, নিউট্রন কমে ১টি। আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে নিউক্লিয়াসটি, ৭টি প্রোটন আর ৭টি নিউট্রন নিয়ে সেটা পরিণত হয় পুরোদস্তুর নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াসে। তখন আবার বাইরে থেকে একটা মুক্ত ইলেকট্রন ধরে পরিণত হয় আগের চেহারার নাইট্রোজেন পরমাণুতে।
নাইট্রোজেন থেকে কার্বন এবং কার্বন থেকে নাইট্রোজেনে পরিণত হওয়ার সূত্র। এখানে নাইট্রোজেনের নিউক্লিয়াসে এসে আঘাত করছে কসমিক রশ্মি থেকে মুক্ত হওয়া নাইট্রোজেন। ফলে উৎপন্ন হচ্ছে কার্বন ১৪-এর নিউক্লিয়াস এবং এবং একটা প্রোটন। আবার তেজস্ক্রিয় কার্বনের নিউক্লিয়াস তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে জন্ম দিচ্ছে একটা স্থিতিশীল নাইট্রোজেন ১৪ পরমাণু। সঙ্গে জন্ম নিচ্ছে একটি ইলেকট্রন এবং একটি অ্যান্টিনিউট্রিনো নাইট্রোজেন থেকে কার্বন এবং কার্বন থেকে নাইট্রোজেনে পরিণত হওয়ার সূত্র। এখানে নাইট্রোজেনের নিউক্লিয়াসে এসে আঘাত করছে কসমিক রশ্মি থেকে মুক্ত হওয়া নাইট্রোজেন। ফলে উৎপন্ন হচ্ছে কার্বন ১৪-এর নিউক্লিয়াস এবং এবং একটা প্রোটন। আবার তেজস্ক্রিয় কার্বনের নিউক্লিয়াস তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে জন্ম দিচ্ছে একটা স্থিতিশীল নাইট্রোজেন ১৪ পরমাণু। সঙ্গে জন্ম নিচ্ছে একটি ইলেকট্রন এবং একটি অ্যান্টিনিউট্রিনো
কিন্তু পুরো এই প্রক্রিয়া ঘটতে কিছুটা সময় লাগে। ততক্ষণে হয়তো সব কটি না হলেও কিছু তেজস্ক্রিয় কার্বন অক্সিজেনের সঙ্গে রাসায়নিক বন্ধন তৈরি করে। ফলে তৈরি হয় তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাই-অক্সাইড। আবার তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকেও তেজস্ক্রিয় কার্বন রশ্মি বিকিরণ করে নাইট্রোজেন তৈরি করে ফেলতে পারে। কিন্তু এর আগেই এগুলোর মধ্য থেকে বেশ কিছু তেজস্ক্রিয় কার্বন শুষে নেয় গাছগুলো। সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করে নিজেদের খাদ্য। তখন এসব কার্বন আবার অংশ হয় উদ্ভিদদেহের। সেই উদ্ভিদকে আবার খায় তৃণভোজী ও মানুষের মতো সর্বভুক প্রাণীরা। তৃণভোজীদের আবার খায় খাদ্যজালের ওপরের দিকে থাকা মাংসাশী প্রাণিগুলো। এভাবে উদ্ভিদের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয় কার্বন ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর তামাম প্রাণিকুলের মধ্যে। তাই বলে ভাববেন না, উদ্ভিদগুলো শুধু তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাই-অক্সাইড দিয়েই নিজেদের খাদ্য তৈরি করে। বরং সাধারণ ও তেজস্ক্রিয়তা দুই ধরনের কার্বণই শোষণ করে উদ্ভিদগুলো। আলাদা করে চেনার ক্ষমতা এদের নেই। জীবন্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দেহে খাদ্য হিসেবে অনবরত কার্বন ঢুকে পড়ে। জীবন্ত প্রাণীর দেহের ভেতরেও তেজস্ক্রিয় কার্বন থাকে। কিন্তু অনবরত তেজস্ক্রিয় কার্বনের জোগান থাকে বলে, একটা নির্দিষ্ট অনুপাতের নিচে নামে নামে না এর সংখ্যা।
গোটা ব্যাপার এমনভাবে ঘটে, জীবিত যেকোনো প্রাণীর দেহে স্থিতিশীল ও তেজস্ক্রিয় কার্বনের অনুপাত সর্বদা সমান, অর্থাৎ ১: ১ থাকে। কিন্তু প্রাণী বা উদ্ভিদের মৃত্যুর পর বন্ধ হয়ে যায় সব রকম কার্বনের জোগান। কার্বন ১২ তো ভাঙে না। তাই উদ্ভিদ বা প্রাণিদেহে কার্বনের পরিমাণ হেরফের হয় না। হ্যাঁ, জীবদেহ পচে যায়। বাকল, চামড়া, মাংস ইত্যাদি পচে মাটিতে মিশে যায়। কিন্তু যেটুকু অক্ষত থাকে কঙ্কাল বা কাঠ হিসেবে, সেটুকুই যথেষ্ট বয়স বের করার জন্য। অক্ষত মৃতদেহে যে অংশই পাওয়া যাক, তাতে কার্বন ১২ ও কার্বন ১৪-এর অনুপাতই বলে দেয় মৃতদেহ ঠিক কত বছর আগে জীবিত ছিল।
বিয়ে হতেই দর বাড়ালেন কিয়ারা! জানেন ‘ডন ৩’-এর জন্য কত টাকা নিচ্ছেন?
কার্বন ১৪-এর পরমাণুগুলো তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে ক্রমাগত ক্ষয় হতে থাকে। কিন্তু কার্বন ১২-এর পরমাণুগুলোর নিউক্লিয়াস স্থিতিশীল। তাই যেকোনো সময় এদের অনুপাত বের করা কঠিন নয়। তেজস্ক্রিয় কার্বনের অর্ধায়ু ৫,৭৬০ বছর। অর্থাৎ ৫,৭৬০ বছরে মৃতদেহে মিশে থাকা কার্বন ১৪ ক্ষয় হয়ে অর্ধেকে পরিণত হয়। বাকি অর্ধেক অবশিষ্ট থাকে। তার মানে এই সময় পরে জীবদেহে কার্বন ১২ ও কার্বন ১৪-এর অনুপাত হবে ১: ০.৫। এভাবে দ্বিতীয় অর্ধায়ু ১১,৫২০ বছর পর অনুপাতটি দাঁড়াবে ১: ০.২৫। তেমনি দুই অর্ধায়ুতেই বয়স বের করা যাবে, তা নয়। কার্বনের অর্ধায়ু আর প্রতি সেকেন্ডে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের হার যেহেতু বিজ্ঞানীদের জানা, তাই সহজেই ১ হাজার বা ৮ হাজার কিংবা যেকোনো বয়সী মৃতদেহ বা ফসিলের বয়স বের করা কঠিন নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।