জুমবাংলা ডেস্ক : পৃথিবীতে যত ধরনের বিষাক্ত সাপ রয়েছে তার মধ্যে সামুদ্রিক সাপের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা। বিশ্বে বিষধর এবং বিষাক্ত সামুদ্রিক সাপের প্রায় ৬০টির মত প্রজাতি রয়েছে।
বাংলাদেশে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ২০২৩ সালে করা গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট ১৬ প্রজাতির বিষাক্ত সামুদ্রিক সাপ রয়েছে।
এদের সবগুলোই বিষধর ও‘হাইড্রোফাইনি’র অন্তর্ভুক্ত। হাইড্রোফাইনি হল ‘ইলাপিডি’ পরিবারের বিষাক্ত সাপের একটি উপপরিবার।
এর মধ্যে বাংলাদেশে হুক নোজ বা‘বড়শি-নাক’ এবং ইয়েলো বেলিড সামুদ্রিক সাপ বেশ কয়েকবারই দেখা গেছে।
গবেষকরা বলছেন, এই দুই প্রজাতির সাপই তীব্র বিষধর।
কিন্তু বাংলাদেশে যেসব সামুদ্রিক সাপের কথা জানা যায়, তার মধ্যে সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ কোনটি? সাগরে যাওয়া জেলে বা নাবিক বা ডুবুরি কেউ যদি তাদের মুখোমুখি হয়ে পড়েন তখন সেসব বিষাক্ত সাপের ছোবল থেকে বাঁচার উপায়ই বা কী?
বাংলাদেশে সামুদ্রিক সাপ নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিতে কোনো গবেষণা হয়নি। এ নিয়ে বেশির ভাগ গবেষণাই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকিএবং পাকিস্তান আমলের।
ফলে সামুদ্রিক সাপের মোট প্রজাতির সংখ্যা সুনিশ্চিত জানা যায় না।
একেক গবেষকের মতে সংখ্যাটা একেক রকম। তবে বিভিন্ন গবেষণায় এসব প্রজাতির সংখ্যা ১৩ থেকে ১৮টির মধ্যে রয়েছে।
সামুদ্রিক সাপের প্রকারভেদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন,‘বাংলাদেশে ১৬ প্রজাতির বিষধর সামুদ্রিক সাপ রয়েছে।’
এগুলোর মধ্যে আছে বড়শি-নাক সামুদ্রিক সাপ, মালাকা বা নীল সামুদ্রিক সাপ, ক্যান্টরের সরু মাথা সামুদ্রিক সাপ, বামন সামুদ্রিক সাপ, কালো-হলুদ বা পাতাল সামুদ্রিক সাপ, দাগি লাঠি সামুদ্রিক সাপ, পারস্য উপসাগরের সামুদ্রিক সাপ।
এছাড়াও রয়েছে কালো দাগি সামুদ্রিক সাপ, মোহনার সামুদ্রিক সাপ, কোচিন দাগি, বড় মাথা সামুদ্রিক সাপ, চাপা গলা বা বাংলা সামুদ্রিক সাপ, কালো ও হলুদ বা রঙ্গিলা বা ইয়েলো বেলিড সি স্নেক, কমন ছোট মাথা, হলুদ ঠুঁটি এবং বলয়যুক্ত সামুদ্রিক সাপ।
তবে এর সবগুলোকে হামেশা দেখা না গেলেও মূলত ছয় প্রজাতির সাপ সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান অধ্যাপক মো: আবুল ফয়েজের‘সর্প দংশন ও এর চিকিৎসা’ নামক বইয়ে বাংলাদেশে ১২টি প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বঙ্গোপসাগর, সুন্দরবনের নদী মোহনা থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি এলাকায় এসব সামুদ্রিক সাপের দেখা পাওয়া যায়।
সামুদ্রিক সাপের বৈশিষ্ট্য
গবেষকরা বলছেন, এসব সামুদ্রিক সাপই‘হাইড্রোফাইনি’র অন্তর্ভুক্ত। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় হাইড্রোফাইনি হল ‘ইলাপিডি’ পরিবারের বিষাক্ত সাপের একটি উপ-পরিবার।
মো: আবুল ফয়েজের ‘সর্প দংশন ও এর চিকিৎসা’ নামক বইয়ে সামুদ্রিক সাপের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে।
এসব সাপ দৈর্ঘ্যে এক মিটার থেকে আড়াই মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সব সামুদ্রিক সাপের লেজ চ্যাপ্টা বৈঠার মতো। লেজের বৈশিষ্ট্য দেখে বিষধর ও বিষধর নয়, এমন সাপের পার্থক্য করা যায়।
সামুদ্রিক সাপের লেজ হালের কাজ করে ও সাপকে সাঁতার কাটতে সাহায্য করে।
সামুদ্রিক সাপের দেহ একই রকম গোলাকার, দানাদার আঁশ আছে। মাথা ও ঘাড়ের দিকে গোলাকৃতি।
এদের বিষদাঁত ছোট এবং সামনে অবস্থিত।
চোখ ও নাসারন্ধ্র মাথার ওপরের দিকে থাকে। চোখ গোলাকৃতি, জিহ্বা বেশ ছোট, নাসারন্ধ্র ঢাকনাযুক্ত।
নাকের ছিদ্রে কপাটিকা থাকে। পানিতে সাঁতার কাটার সময় নাকের কপাটিকা শ্বাসনালীতে পানির প্রবেশ আটকায়।
চট্টগ্রামের ভেনোম রিসার্চ সেন্টারের গবেষক মো: মিজানুর রহমান জানান,‘একটা সময় ধারণা করা হত, বিশেষ গ্রন্থির সাহায্যে সাপ শরীর থেকে অতিরিক্ত লবণ নিঃসরণ ঘটায়।’
‘কিন্তু বর্তমানে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে গ্রন্থিটি সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় না। কারণ সামুদ্রিক সাপ মিঠা পানি পান করে।’
এসব সাপ পানিতে তরঙ্গায়িতভাবে সাঁতার কাটে। যা মাথা থেকে শুরু হয়ে লেজে গিয়ে শেষ হয়।
এদের ফুসফুস লম্বা ও আকারে বড় এবং প্রায় পুরো দেহ দৈর্ঘ্য বরাবর প্রলম্বিত।
ফুসফুসের পশ্চাদভাগ বায়ুভাণ্ডারের কাজ করে এবং সাপকে পানিতে ভেসে থাকতে সাহায্য করে।
যথার্থ শ্বসনকালের বদলে দীর্ঘ ডুব-সাঁতার দেয়ার সময় অক্সিজেন সরবরাহ করে।
সামুদ্রিক সাপ কয়েক ঘণ্টা পানিতে ডুবে থাকতে পারে। প্রজনন ঋতুতে এরা কখনো কখনো সমুদ্রপৃষ্ঠে ভেসে থেকে আলো ও তাপ উপভোগ করে।
অধিকাংশ সাপই মাছ খায়। বিশেষত লম্বা বাইম ও পাইপ মাছ, আবার কোনো কোনোটি চিংড়ি, কোনোটি মাছের ডিম খায়।
অধিকাংশ সামুদ্রিক সাপ উপকূলবর্তী গরান বন ও নদীর মোহনা ঘেঁষে বাস করে।
হলুদ বা হলুদ-পেট সামুদ্রিক সাপের কেবল একটি প্রজাতি অন্যদের তুলনায় অধিক সমুদ্র-প্রেমী। উপকূলের চেয়ে গভীর সমুদ্রই এদের বেশি পছন্দ।
এটি সমুদ্রের পানিতে এক নাগাড়ে আট ঘণ্টা ডুবে থাকতে পারে।
অত্যন্ত বিষধর সাপ হওয়া সত্ত্বেও এদের মেজাজ খুবই ঠাণ্ডা। খুব সহজে কামড় দেয় না।
এরা পানিতে বাচ্চা দেয় ও ডাঙায় চলতে পারে না।
বিষধর সাপের দংশনের ফলে মাংসপেশি, স্নায়ুতন্ত্র ও কিডনির উপর বিষক্রিয়া হতে পারে।
হুক নোজ বা বড়শি নাক সামুদ্রিক সাপ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান জানান,‘বঙ্গোপসাগরে ১৬ প্রজাতির বিষাক্ত সাপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত হল ‘হুক নোজ’ বা বড়শি নাক সামুদ্রিক সাপ।’
‘এটি বাংলাদেশে প্রায়শই দেখা যায়।‘এনহাইড্রিনা স্কিসটোসা বা হাইড্রোফিস স্কিসটোসাস’ হলো এর বৈজ্ঞানিক নাম।’
এটি তীব্র বিষধর সামুদ্রিক সাপ।
‘বড়শি নাক’ সামুদ্রিক সাপের দেহ তামাটে ধূসর রঙের এবং গায়ে নীলাভ ধূসর বা কালচে ব্যান্ড থাকে।
এদের দেহের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১৪০ সে.মি এবং লেজের দৈর্ঘ্য ১১০ সে. মি।
উন্মুক্ত জলাশয়ের অগভীর পানিতে, উপকূলীয় উপহ্রদ, প্যারাবন, মোহনায় এবং নদীর মুখে বড়শি নাক সাপ পাওয়া যায়।
তবে পৃথিবীতে এ প্রজাতির সাপের ব্যাপক বিস্তৃতি রয়েছে।
এদের বঙ্গোপসাগর, পারস্য উপসাগর, মাদাগাস্কার, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তর অংশে পাওয়া যায়।
কালো-হলুদ বা রঙ্গিলা সাপ
গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজারে এবং কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে দেখা গিয়েছিল ইয়েলো বেলিড বা কালো ও হলুদ সামুদ্রিক সাপ।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ভেনোম রিসার্চ সেন্টারের সহযোগী গবেষক মো: মিজানুর রহমান বলেন,‘সব সামুদ্রিক সাপের মতোই এই ইয়েলো বেলিড সাপটি বিষাক্ত।’
‘এটি গত বছর দুটি সমুদ্র সৈকতে দেখা গেছে। তবে বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত সামুদ্রিক সাপের বিষের তীব্রতা পরিমাপের কোনো গবেষণা হয়নি।’
এর বৈজ্ঞানিক নাম হাইড্রোফিস প্ল্যাটারাস।
বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় এ সাপ দেখা যায়।
এর প্রধান খাবার সামুদ্রিক মাছ। সাপটির পেটের দিকে হলুদ এবং পিঠ গাঢ় বাদামী বা কালচে রঙের চ্যাপ্টা, আর লেজে গোলাকৃতির গাঢ় বাদামী বা কালচে রঙের চিহ্ন থাকে।
এই রঙের জন্য সাপটিকে অন্যান্য সামুদ্রিক সাপের প্রজাতি থেকে সহজেই আলাদা করা যায়।
এর থুতনি অনেক প্রসারিত। লম্বায় দুই-তিন ফুটের বেশি হয় না।
এই প্রজাতি প্রতিবারে দুই থেকে ছয়টা বাচ্চা দিতে পারে।
অক্সিজেন নেয়ার জন্য এদের সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসতে হয় এবং এরা সাঁতার কাটার সময় ত্বকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারে।
সামুদ্রিক সাপের বেঁচে থাকার জন্য মিঠাপানির প্রয়োজন হয়।
এই ইয়েলো বেলিড সাপ বৃষ্টিপাতের সময় সমুদ্রের পানির উপরিভাগ থেকে সেই পানি পান করে।
মালাকা বা নীল সামুদ্রিক সাপ
এই সাপটি সামুদ্রিক সাপগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ছোট। মালাকা বা নীল সামুদ্রিক সাপটি ১০৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে। এর শরীর সামনের দিক থেকে সরু, পশ্চাৎভাগে সংকুচিত।
এ সাপটির ঘাড়ের ব্যাস সবচেয়ে বড়। দেহের প্রায় ২ বা ৩ গুণ।
গায়ের রং হলদেটে বা সাদা-সাদা এবং নিচের দিকে ম্লান।
পুরো শরীর ৪০ থেকে ৬০ টি নীল-কালো বা গাঢ় ধূসর ব্যান্ড দিয়ে আবৃত।
এর লেজ চ্যাপ্টা এবং দেখতে নৌকার বৈঠার মতো।
ক্যান্টরের সরু মাথা সামুদ্রিক সাপ
এটি একটি মাঝারি আকারের সামুদ্রিক সাপ। এর দৈর্ঘ্যে ১৮৮ সেমি পর্যন্ত বড় হতে পারে। এই সাপের শরীর সামনের দিক থেকে খুব সরু, তবে এটি পেছনের দিকে সংকুচিত।
ক্যান্টরের সরু মাথা সামুদ্রিক সাপের পিঠের উপরিভাগ গাঢ় জলপাই বা ধূসর এবং হলুদ দাগযুক্ত।
শরীরের পেছনে ধূসর বর্ণের গাঢ় দাগযুক্ত। এর নিচের অংশ হলুদাভ, কখনো কখনো গাঢ় ডোরাকাটা। এর লেজ সাধারণত চ্যাপ্টা।
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।