ধর্ম ডেস্ক : কোরবানি ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে নামাজ আদায় করো ও পশু কোরবানি করো।’ (সুরা : কাউসার, আয়াত : ২) কোরবানির রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না উহার (জন্তুর) গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩৭)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকার পরও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২৩)
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহতাআলার নিকট কোরবানির দিন মানবজাতির কোরবানি অপেক্ষা অধিকতর পছন্দনীয় কোনো আমল নেই। বিচারদিনে কোরবানির পশুকে তার শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত করা হবে। পশুর রক্ত জমিনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর কাছে তা বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়, সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো। (তিরমিজি, হাদিস : ১৩৯১)
আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের অনন্য মাধ্যম কুরবানি। জাকাতের মতো নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে কোরবানি দিতে হয়। তবে, বেশির ভাগের মতে—রাসুল (সা.) তাদের কোরবানি দিতে বলেছেন, যাদের ঈদের দিনের সব অভাব পূরণ করার পর পশু জবাইয়ের জন্যও অতিরিক্ত অর্থ থাকে। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করবে। মানে সামর্থ্য থাকলে কোরবানি করবে। এটাকে সালাতের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যেমন—সামর্থ্য থাকলে সালাত আদায় করতে হবে, তেমনি আর্থিক সামর্থ্য থাকলে কোরবানি করবে। সুতরাং কোরবানি করার সামর্থ্য থাকলেই করবেন। এটাই নিয়ম। কিন্তু কী পরিমাণ সম্পদ বা টাকা থাকলে কোরবানি করা আবশ্যক?
কোরবানি বছরে একবার দিতে হয়; এ কারণেই অনেকেই জানে না যে, কী পরিমাণ সম্পদ বা টাকা থাকলে কোরবানি করা আবশ্যক। এ না জানার কারণে অনেকের ওপর কোরবানি আবশ্যক হওয়া সত্ত্বেও কোরবানির মতো গু্রুত্বপূর্ণ ইবাদত থেকে বিরত থাকে। কী পরিমাণ টাকা বা সম্পদ থাকলে কোরবানি আবশ্যক; এ সম্পর্কে ইসলামিক স্কলারদের থেকে রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা।
হিজরি বছরের জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ কোরবানির পশু জবাই করতে হয়। কোরবানি দেওয়ার জন্য শর্ত হলো এ দিনগুলোতে পরিবারের জীবিকা নির্বাহের খরচ ছাড়া অতিরিক্ত নিসাব (নির্ধারিত) পরিমাণ সম্পদ বা টাকার মালিক কিংবা নির্ধারিত পরিমাণ স্বর্ণ বা রুপার বাজার দর অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা থাকে তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব।
সম্পদ বা টাকার নিসাব
সম্পদের নিসরাব হলো- সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ বা এর সমমূল্য কিংবা সাড়ে ৫২ তোলা রুপা কিংবা তার সমমূল্যের সম্পদ থাকা। আর কুরবানি আবশ্যক হওয়ার জন্য এ পরিমাণ টাকা বা সম্পদ এক বছর মালিকানাধীন থাকতে হবে এমন কোনো শর্ত প্রযোজ্য নয়।
স্বর্ণের নিসাব ও মূল্যের বিবরণ
কেউ যদি স্বর্ণকে নিসাব ধরে তবে তাকে সাড়ে ৭ ভরি/তোলা স্বর্ণের মূল্যের উপর টাকার পরিমাণ হিসাব করতে হবে। যেমন চলতি বছরের জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী-
২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) দাম- ৭২ হাজার টাকা হিসাবে সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণের দাম- ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
২১ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) দাম ৬৯ হাজার টাকা হিসাবে সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণের দাম- ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টাকা।
১৮ ক্যারেটের স্বর্ণের প্রতি ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) দাম ৬০ হাজার টাকা হিসাবে সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণের দাম- ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম- ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা হিসাবে সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণের দাম- ৩ লাখ ৭১ হাজার ২৫০টাকা (স্বর্ণের এ দাম ওঠা নামা করতে পারে। সেক্ষেত্রে বাজার দর হিসাব করে নিসাব নির্ধারণ করতে হবে।)
সুতরাং যারা স্বর্ণের নিসাবে কুরবানি করবেন, তাদের জন্য প্রায় ৪ লাখ টাকা বা সম্পদ জিলহজ মাসের ১০-১২ তারিখ (এ তিন দিন) তাদের মালিকানায় থাকলে তার জন্য কোরবানি দেওয়া আবশ্যক।
রুপার নিসাব ও মূল্যের বিবরণ
কেউ যদি রুপাকে নিসাব ধরে তবে তাকে সাড়ে ৫২ ভরি/তোলা রুপার মূল্যের উপর টাকার পরিমাণ হিসাব করতে হবে। যেমন চলতি বছরের জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী-
২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি রুপার মূল্য ১ হাজার ৫১৬ টাকা হিসাবে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার দাম হয়- ৭৯ হাজার ৫৯০ টাকা।
২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি রুপার দাম ১ হাজার ৪৩৫ টাকা হিসাবে সাড়ে ৫২ তোলা বা ভরির দাম হয়- ৭৫ হাজার ৩৩৭ টাকা পঞ্চাশ পয়সা।
১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি রুপার দাম ১ হাজার ২২৫ টাকা হিসাবে সাড়ে ৫২ তোলা/ভরির দাম হয়- ৬৪ হাজার ৩১২ টাকা পঞ্চাম পয়সা। এবং
সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি রুপার দাম ৯৩৩ টাকা হিসাবে সাড়ে ৫২ তোলা/ভরির দাম ৪৮ হাজার ৯৮২ টাকা পঞ্চাশ পয়সা।
তাই কারো কাছে যদি সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকাও থাকে তবে তাকে রুপার নিসাব পরিমাণ অর্থের বিধান অনুযায়ী কোরবানি করতে হবে।
সুতরাং পরিবারের খরচ মেটানোর পর যদি জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ নির্ধারিত পরিমাণ স্বর্ণ বা রুপা থাকে কিংবা নির্ধারিত পরিমাণ স্বর্ণ বা রুপার বাজার দর অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা থাকে ওই ব্যক্তির জন্য কোরবানি করা আবশ্যক।
রদ্দুল মুহতার গ্রন্থে এসেছে, সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলিম নর-নারী ঋণমুক্ত থাকা অবস্থায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে কোরবানি না করলে ওয়াজিব তরকের দায়ে গোনাহগার হবেন।
বাদায়েউস সানাঈ গ্রন্থে এসেছে, নাবালেগ; পাগল; যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকও হয় তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। তবে তাদের অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে থেকে কোরবানি করলে তা বিশুদ্ধ হবে।
দুররুল মুখতার গ্রন্থে এসেছে, মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। মুসাফির দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যে ব্যক্তি কমপক্ষে ৪৮ মাইল সফরের নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে।
বাদায়েউস সানাঈতে এসেছে, কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য কোরবানির ৩ দিনই মুকিম থাকা জরুরি নয়। বরং কেউ যদি এ ৩ দিনের শুরুর দিকে মুসাফির থাকে আর শেষ দিকে মুকিম হয়ে যায় তবে তার নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার কুরবানি ওয়াজিব হবে। আর কেউ যদি এ ৩ দিনের শুরুতে মুকিম থাকে এবং শেষের দিকে মুসাফির হয়ে যায় তাহলে তার ওপরে কোরবানি ওয়াজিব হবে না।’
আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহর সব নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদেরকে যথাযথভাবে কোরবানি আদায় করার মাধ্যমে তার নৈকট্য অর্জনের তাওফিক দান করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।