স্বাস্থ্য ডেস্ক : শারীরিক অবসাদ কিংবা ত্বক শুকিয়ে গেলে সম্ভবত বেশি বেশি পানি করতেই পরামর্শ দেবেন চিকিৎসকরা; এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ যেখানেই যাক না কেন, সঙ্গে পানির বোতল নিয়ে যাওয়ার অভ্যাসটাই শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পানি পানের কারণ হতে পারে।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পানি করার অনীহার কারণে মানুষকে মৃত্যুর কাছাকাছি যেতে হয়েছে বলে জানান ‘হাইড্রোপ্যাথির’ প্রতিষ্ঠাতা ভিনসেন্ট প্রিসনিৎজ। তার মতে, ‘দারিদ্র্য সীমার সবশেষ পর্যায়ে নেমে আসা লোকেরাই’ তখন পানি দিয়ে তাদের তৃষ্ণা মেটায়। অনেকেই এক বসাতে আধা কাপের বেশি পানি করেনি সেসময়।
কিন্তু সময় কীভাবে বদলে গেছে, লিখেছে বিবিসি।
কয়েক বছর আগের চেয়ে এখন যুক্তরাজ্যের প্রাপ্তবয়স্করা বেশি বেশি পানি পান করছে। যুক্তরাষ্ট্রে বোতলজাত পানি বিক্রি সোডা বিক্রির পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে। পানি পান করার উপকারিতামূলক বার্তায় ভরে গেছে মোবাইল ফোনের ইনবক্সও। বলা হচ্ছে, ভালো স্বাস্থ্য, অধিক এনার্জি, মোলায়েম ত্বকের গোপন রহস্য হল প্রতিদিন কয়েক লিটার পানি পান করা, যা মানুষের ওজন কমায় এবং ক্যান্সারের হাত থেকে বাঁচায়।
লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড বা টানেলের ভেতর দিয়ে চলা যাত্রীদের পানির বোতল সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্লাসে পানির বোতল নিয়ে আসতে বলা হয় শিক্ষার্থীদের। কিছু অফিস মিটিং তো ডেস্কের মাঝে বিশাল পানির জগ ছাড়া হতেই পারে না।
বিবিসি লিখেছে, পানির জন্য এই আকাঙ্ক্ষা ‘৮*৮’ নিয়মের কারণে, যা কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ স্বীকৃত নয়। এই নীতি অনুযায়ী প্রতিদিন ২৪০ মিলিলিটারের আট গ্লাস সমপরিমাণ পানি পান করতে বলা হয়, যা দুই লিটারেরও কম।
তবে এই নিয়মটি বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কিছু নয়। অথবা যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নির্দেশিকাও বলে না যে, কারো এই পরিমাণ পানি পান করা উচিত।
প্রতিদিন কী পরিমাণ পানি পান করতে হবে, তা নিয়ে নানা অস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। এই নানা মতের উৎপত্তি সম্ভবত কয়েক দশক আগের দুটি পরামর্শ বা গাইডলাইনের ভুল ব্যাখ্যা থেকে।
১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বোর্ড প্রাপ্তবয়স্কদের খাবারের প্রতি ক্যালোরির জন্য এক মিলিলিটার তরল খাওয়ার পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী নারীদের ২ হাজার ক্যালোরির বিপরীতে ২ লিটার তরল এবং পুরুষের আড়াই হাজার ক্যালোরির বিপরীতে আড়াই লিটার তরল পান করতে হয়। তবে তরল বলতে এখানে কেবল পানি নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফল ও সবজির মত পানির উৎসের কথা বলা হয়। কারণ এসবে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত পানি থাকতে পারে।
এরপর ১৯৭৪ সালে ‘নিউট্রিশন ফর গুড হেলথ’ বইয়ের সহলেখক পুষ্টিবিদ মার্গারেট ম্যাকউইলিয়ামস ও ফ্রেডেরিক স্টার সুপারিশ করেন, গড় প্রাপ্তবয়স্করা দিনে ছয় থেকে আট গ্লাস পানি পান করতে পারে। তবে লেখকদ্বয় এও লেখেন, এই পরিমাণ পানির উৎসের জন্য ফল, সবজি, ক্যাফেইনসমৃদ্ধ কোমল পানীয় এমনকি বিয়ারও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
হাইড্রেশন বা জলযোজন বিজ্ঞান
মানুষের জন্য পানি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। মানব শরীরের ওজনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পানি, যা শরীরের পুষ্টি ও বর্জ্য পদার্থ বহন করে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, জয়েন্টগুলোতে লুব্রিকেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং দেহের ভেতরে রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপে সাহায্য করে।
ক্রমাগত ঘাম, প্রস্রাব আর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমেও শরীর থেকে পানি চলে যাচ্ছে। দেহের সুষ্ঠু ভারসাম্য ও পানি শূন্যতা এড়াতে পর্যাপ্ত পানি থাকাটা জরুরি। শরীর থেকে ১-২% পানি চলে গেলে মানুষ পানি শূন্যতার বিষয়টি টের পায়। আর এই তরলের ঘাটতি পূরণ না করলেই অবস্থার অবনতি হতে থাকে। পানি শূন্যতা মারাত্মক পর্যায়েও চলে যেতে পারে, তবে সেটি বিরল ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।
‘৮*৮’ গাইডলাইনের কারণে বছরের পর বছর ধরে অপ্রমাণিত দাবিগুলোই মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে যে, পানির তৃষ্ণা মানেই শরীর বিপজ্জনকভাবে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা অনেকাংশে এখন একমত যে, শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত তরলের কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
ম্যাসাচুসেটসের টাফটস ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড এজিং ল্যাবরেটরির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী আরউইন রোজেনবার্গ বলেন, “হাইড্রেশন বা জলযোজনের নিয়ন্ত্রণ হল সবচেয়ে জটিল বিষয়গুলোর একটি, যা আমরা উন্নয়ন ঘটিয়েছি বিবর্তনের মাধ্যমে। পূর্ব পুরুষদের সমুদ্র থেকে ভূমিতে উঠে আসার যে বিবর্তন, সেসময় থেকেই এর উন্নয়ন ঘটেছে। পর্যাপ্ত হাইড্রেশন বজায় রাখার প্রক্রিয়ায় আমাদের প্রচুর পরিশীলিত কৌশল রয়েছে।”
পানিশূন্যতা তৈরি হলে বা তৃষ্ণা পেলে সুস্থ দেহে মস্তিস্ক সাড়া দেয়। মস্তিস্ক তখন হরমোনও নিঃসরণ করে, যা কিডনিকে পানি সংরক্ষণের জন্য সংকতে পাঠায়।
“আপনি যদি শরীরকে বুঝতে পারেন, তবে তৃষ্ণার্ত হলেই শরীর আপনাকে বলে দেবে,” বলেন অধ্যাপক কোর্টনি কিপস।
ব্লেনহেইম ও লন্ডন ট্রায়াথলনসের মেডিকেল ডিরেক্টর কিপস বলেন, “তৃষ্ণা পাওয়ার মানেই যে শরীরে তরলের ঘাটতি রয়ে গেছে- এমন অলীক ধারণা তৈরি হয়েছে একটি অনুমানকে ভিত্তি করে। আর সেটি হল, মানুষের তরল ঘাটতি বোঝার ক্ষেত্রে তৃষ্ণা কোনো নিখুঁত মানদণ্ড নয়।”
কিন্তু শরীরের অন্য সবকিছু কেন নিখুঁত আর তৃষ্ণা কেন যথাযথ মানদণ্ড হবে না- সেই প্রশ্ন তুলে স্পোর্ট, এক্সারসাইজ অ্যান্ড হেলথ ইনস্টিটিউটের স্পোর্টস অ্যান্ড এক্সারসাইজ মেডিসিনের অধ্যাপক কিপস বলেন, “তরল ঘাটতি বোঝার ক্ষেত্রে তৃষ্ণা মানুষের বিবর্তনের হাজার হাজার বছর ধরে বেশ ভালোভাবে কাজ করেছে।”
স্রেফ পানিতে কোনো ক্যালোরি না থাকায় এটি স্বাস্থ্যকর উপাদান হলেও চা-কফির মত অন্য পানীয়গুলোও মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করে। ক্যাফেইনের কারণে প্রস্রাবের পরিমাণ হালকা বেড়ে গেলেও গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, চা-কফি এবং অন্যান্য অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় হাইড্রেশনে ভূমিকা রাখে।
পানি খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে বা ওজন কমে?
অধিক পানি খেলে শরীরের পানিশূন্যতা এড়ানোর বাইরে অন্য কোনো উপকারে লাগে কিনা, সে ব্যাপারে কম প্রমাণই আছে। তবে গবেষণা বলছে, পানি শূন্যতা এড়ানো বা মৃদু পানি শূন্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে বেশি বেশি পানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা রয়েছে। কিছু সংখ্যক গবেষণা বলছে, হালকা পানি শূন্যতা এড়াতে পর্যাপ্ত পানি পান মস্তিস্কের কার্যক্রমে সহায়তা করে।
২০২৩ সালের একটি গবেষণা বলছে, শরীরে পর্যাপ্ত পানির যোগান দিলে বয়সের ছাপ বা বুড়িয়ে যাওয়ার গতি কমিয়ে দেয়। সেইসঙ্গে হার্ট ও ফুসফুসের সমস্যার মত দীর্ঘ মেয়াদী জটিলতা থেকে দূরে রাখে।
শরীরে তরল গ্রহণ ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে বলে জানাচ্ছে কিছু গবেষণা। ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও স্টেট ইউনিভার্সিটির মানবপুষ্টি, খাদ্য ও শরীর চর্চার অধ্যাপক ব্রেন্ডা ডেভি তরল গ্রহণ ও ওজন নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কিছু গবেষণা চালিয়েছেন।
একটি গবেষণায় দৈবচয়নের ভিত্তিতে দুইটি দলের একটিকে গবেষণার বিষয় ঠিক করে দেন ডেভি। এরপর উভয় দলকেই তিন মাস স্বাস্থ্যকর খাবার বা ডায়েট নীতি মেনে চলতে বলা হয়। কিন্তু শুধু একটি দলকে বলা হয়, প্রতিবার খাওয়ার আধাঘণ্টা আগে আধা লিটার পানি খেতে। পরে দেখা যায়, যে দলের সদস্যরা খাবারের আগে পানি খেয়েছে, তাদের ওজন অন্য দলটির সদস্যদের চেয়ে বেশি কমেছে।
উভয় দলকেই বলা হয়েছিল প্রতিদিন ১০ হাজার কদম হাঁটতে। যারা পানির খাওয়ার নিয়মটি মেনে চলে, তারা হাঁটার নিয়মও আরো ভালোভাবে মেনে চলেছে। এ থেকে ডেভির অনুমান, শরীরে মৃদু পানি শূন্যতা বা ১-২% পানি শূন্যতার বিষয়টি সবার মধ্যেই আছে। সেটি যখন ঘটে, অনেকেই তা বুঝতে পারে না। মৃদু হলেও তা মানুষের মেজাজ ও এনার্জিকে প্রভাবিত করে।
পানিশূন্যতা আসলে কী?
শরীরে তরল গ্রহণের তুলনায় তরল কমতে থাকলে তাকে পানিশূন্যতা বলা হয়ে থাকে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেল সার্ভিস পানিশূন্যতার যে লক্ষণগুলো বলছে তাহল- গাঢ় হলুদ প্রস্রাব, ক্লান্তি চলে আসা, মাথা ঘোরা, ঠোট-মুখ ও চোখ শুকিয়ে আসা এবং দিনে চারবারেরও কম প্রস্রাব হওয়া। তবে এসবের মধ্যে পানিশূন্যতার সবথেকে সাধারণ লক্ষণ হল তৃষ্ণা পাওয়া।
মানুষের পরিপাকক্রিয়া নিয়ে কাজ করা পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বারবারা রোলস বিবিসিকে বলেন, “পানি খাওয়ার ফলে ওজন কমার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে চিনি যুক্ত পানীয়র বদলে সাধারণ পানি গ্রহণ। তবে খাবারের আগে পানি খেয়ে নিলে ওজন ঝরে যাবে, এই ধারণাটিও প্রতিষ্ঠিত নয়।
“খালি পেটে থাকা পানি দ্রুত বের হয়ে যায়। কিন্তু কেউ যদি স্যুপের মত খাবারের মাধ্যমে শরীরে পানি প্রবেশ করায়, সেটি খাবারের মাধ্যমে আবদ্ধ থাকে এবং দীর্ঘক্ষণ পেটে অবস্থান করে।”
বেশি বেশি পানি পান করার আরেকটি স্বাস্থ্য উপকারিতা হিসেবে উজ্জ্বল ও আর্দ্র ত্বকের কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই দাবির পেছনেও বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব আছে।
অনেক বেশি পানি খান?
যারা প্রতিদিন আট গ্লাস পানি খাওয়ার নিয়ম মেনে চলেন তাদের ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতি বা ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু শরীর যা চায়, তার চেয়ে বেশি খাওয়ার দরকার বলে যারা বিশ্বাস করেন, সেটি কখনো আবার বিপদও ডেকে আনতে পারে।
অধিক পরিমাণে তরল গ্রহণে রক্তে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে ব্রেইন ও ফুসফুস ফুলে যেতে পারে, যেহেতু ওই তরলের কারণে রক্তে সোডিয়ামের ভারসাম্য মাত্রার পরিবর্তন হতে পারে।
স্পোর্টস অ্যান্ড এক্সারসাইজ মেডিসিনের অধ্যাপক কোর্টনি কিপস গত প্রায় এক দশকে এমন ১৫টি ঘটনা দেখেছেন, যেখানে খেলার সময় অতিরিক্ত পানি পানের কারণে অ্যাথলেটদের মৃত্যুও হয়েছে।
কোর্টনি কিপস মনে করেন, এই ঘটনাগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটে। কারণ তৃষ্ণা লাগার স্বাভাবিক যে পক্রিয়া, সেটির প্রতি মানুষ অবিশ্বাসী হয়ে পড়ে। মানুষ মনে করে, শরীর যতটুকু পানি চায়, পানিশূন্যতা এড়াতে তারও বেশি পান করার প্রয়োজন।
“পানিশূন্যতার অভাবে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রোগী দেখতে পাবেন চিকিৎসক ও নার্সরা। এই ঘটনাগুলো ম্যারাথনের সময় ডিহাইড্রেশন নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় থাকা লোকেদের থেকে খুব আলাদা”, বলেন তিনি।
২০১৮ সালে রেকর্ড গরমের মধ্যে লন্ডন ম্যারাথনে দৌড়েছেন জোহানা পাকেনহ্যাম। ওই ম্যারাথনের বেশিরভাগ ঘটনাই মনে করতে পারেন না তিনি। কারণ দৌড়ের সময় এত বেশি পানি পান করেছিলেন যে, তার ‘ওভারহাইড্রেশন’ তৈরি হয়েছিল, যাকে বলা হয় ‘হাইপোনাট্রেমিয়া’। পরদিনই পাকেনহ্যামকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।
রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে গেলে ‘হাইপোনাট্রেমিয়া’ তৈরি হয়। শরীরে তরলের মাত্রা ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে সাহায্য করে সোডিয়াম। শিরা ও মাংসপেশী সঠিকভাবে কাজ করার ক্ষেত্রেও এটি সাহায্য করে।
জোহানা পাকেনহ্যাম বলেন, “গরমে রেসের সময় আমার বন্ধু ও সঙ্গী ভেবেছিল, আমার পানিশূন্যতা তৈরি হবে। যে কারণে তারা বড় এক গ্লাস পানি দিয়েছিল।
“…আমার হার্ট থেমে গিয়েছিল এবং এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। রোববার সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত আমার সংজ্ঞা ছিল না।”
এ বছর আবারো ম্যারাথনে অংশ নিতে চাইছেন প্যাকেনহাম। তার ভাষ্য, “ম্যারাথন পোস্টার আর বন্ধুরা একমাত্র স্বাস্থ্য পরামর্শ হিসেবে শুধু প্রচুর পানি খাওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু আমি সত্যিই চাই লোকে জানুক, খুব সাধারণ কিছুই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।”
কতটুকু পানি প্রয়োজন?
আমাদের বারবার পানি খেতে হবে- এই ধারণার ফলে অনেকে যেখানেই যান সঙ্গে পানি রাখেন এবং শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পান করেন।
লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর স্পোর্ট, এক্সারসাইজ অ্যান্ড হেলথের গবেষণা পরিচালক হিউ মন্টগোমারি বলেন, “মরুভূমির মাঝখানে সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি গরমে একজন ব্যক্তি এক ঘণ্টায় দুই লিটার ঘামতে পারে, কিন্তু সেটি সত্যিই কঠিন পরিস্থিতি।
“লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়ে চলার সময় আপনি সেই হারে ঘামবেন না। এমনকি যদি গরমে আপনার ঘাম টপটপ করে পড়তেও থাকে, তারপরও আন্ডারগ্রাউন্ডে ২০ মিনিট চলার জন্য আধা লিটার পানি সঙ্গে রাখার প্রয়োজন পড়বে না।”
ফলে যারা তৃষ্ণার ক্ষেত্রে সরকারি বা আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার চেয়েও বেশি পান করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাদের জন্য যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের পরামর্শ হল- দিনে ছয় থেকে আট গ্লাস তরল পান করার। তরল বলতে এর মধ্যে থাকতে পারে কম ফ্যাটযুক্ত দুধ, চিনি ছাড়া পানীয়, চা ও কফি।
তবে মনে রাখা জরুরি যে, বয়স ৬০ এর বেশি হলে মানুষের তৃষ্ণার মেকানিজমগুলো সংবেদনশীলতা হারায়। গবেষকরা ২০২২ সালের একটি গবেষণায় দেখতে পান, এই বয়সের পরে পানিশূন্যতার লক্ষণগুলো প্রায়শই চোখ এড়িয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ বোঝা যায় না।
“বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রাকৃতিক তৃষ্ণার প্রক্রিয়া কম সংবেদনশীল হয়ে ওঠে এবং আমরা অল্পবয়সীদের তুলনায় বেশি ডিহাইড্রেশন প্রবণ হয়ে পড়ি। ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে পর্যাপ্ত পানি বা তরল রাখার ক্ষেত্রে তরল খাওয়ার অভ্যাসের প্রতি আরো মনোযোগী হতে হবে,” বলেন ডেভি।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই একমত যে, মানুষের শরীরে তরলের প্রয়োজনীয়তা তার বয়স, শরীরের আকার, লিঙ্গ, পরিবেশ এবং শারীরিক কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে।
রোজেনবার্গ বলেন, “৮*৮’ নিয়মের একটি সাধারণ ভুল হল- জীব হিসেবে আমরা যে পরিবেশে আছি, সেই পরিবেশে আমাদের ক্রিয়াকলাপের ওপর এই নিয়মটি সম্পূর্ণভাবে অতি সরলীকরণ করা হয়েছে। তরলের প্রয়োজনকে আমাদের শক্তির প্রয়োজনের মত করেই ভাবতে হবে। এও দেখতে হবে আমরা কোন তাপমাত্রায় আছি এবং কীসব শারীরিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছি।”
২০২২ সালে এবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তাদের অনুমানে বলেন, একজন মানুষের প্রতিদিন ১.৫ লিটার থেকে ১.৮ লিটার পানি প্রয়োজন। বহুল প্রচলিত ‘৮*৮’ নিয়মের ২ লিটার বা আট গ্লাস নয়। একজন মানুষের দিনে কতটুকু পানি খাওয়া প্রয়োজন সেই পরিমাণ নির্ধারণে ২৩টি দেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনায় তারা এই সিদ্ধান্তে আসেন।
তারা এও দেখেছেন, যে বা যারা গরম, আর্দ্র পরিবেশ, উঁচু অঞ্চল বা অধিক উচ্চতায় বাস করেন, সেইসঙ্গে ক্রীড়াবিদ, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের অন্যদের তুলনায় বেশি পানি পান করতে হবে।
একজনের কতটুকু পানি প্রয়োজন, তা নির্ভর করবে তার কতটা শক্তি ক্ষয় হয়। তার মানে ‘সবার জন্য এক সাইজ’- এই নীতি আসলে কোনো সমাধান বা উত্তর নয়।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই একমত যে, প্রতিদিন বাছবিচারহীনভাবে পানি পান করা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। মানুষ তৃষ্ণার্ত হলে শরীর সংকেত পাঠায়। যেমন- ক্ষুধার্ত বা ক্লান্ত হয়ে পড়লে পানি পান করার চাহিদা তৈরি হয়। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পানি পান করার একমাত্র স্বাস্থ্য উপকারিতা হতে পারে অতিরিক্ত ক্যালরি ঝরানো, যেটি বেশিরভাগ সময়ই মানুষ ছোটাছুটি বা দৌড়াদৌড়ি করে ঝরিয়ে থাকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।