গাজা যুদ্ধ যেভাবে বদলে দিতে পারে বিশ্বরাজনীতি

বিশ্বরাজনীতি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের রাজনৈতিক পটভূমি কতটা বদলে গেছে এবং পরাশক্তিগুলোর পারস্পরিক রশি-টানাটানি কতটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিয়ামক হয়ে উঠেছে, ভবিষ্যতে বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কী হতে পারে বা কীভাবে বদলে যেতে পারে তা চলমান গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই যুদ্ধ নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থার দিকে আমাদের ধাবিত করতে যাচ্ছে।

বিশ্বরাজনীতি

গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ পুরো বিশ্বের জনসাধারণের উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়। এতে নিহত হন ১ হাজার ১৩৯ জন। আহত হওয়ার সংখ্যা ৮ হাজার ৭৩০। এ হিসাব ইসরায়েল সরকারের। হামাসের হামলার জবাবে ৭ অক্টোবরই গাজায় পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। তাদের হামলা থেকে মসজিদ, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, আশ্রয়শিবির-কিছুই বাদ যায়নি। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহতের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২ হাজারে। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ৭৩ হাজার ফিলিস্তিনি। যার বেশিরভাগ নারী ও শিশু। উদ্বাস্তু হয়েছে গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ১৮ লাখের বেশি।

যুদ্ধটি শুধু দুই দেশের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। এরই মধ্যে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং লোহিত সাগর পর্যন্ত এটি বিস্তৃত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও এই যুদ্ধের প্রভাব ব্যাপকহারে অনুভূত হয়েছে। যার ফলে বিশ্বে বাকস্বাধীনতা নিয়ে তীব্র লড়াই, জাতিসংঘে তীব্র কূটনৈতিক ঝগড়া এবং ইহুদি, মুসলিম বা আরবদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ এবং ঘৃণা ছড়িয়েছে।

এদিকে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এই বছর ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। আর প্রায় ৪০টি দেশে চলতি বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এসব দেশের বেশ কয়েকটিতে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ রাজনৈতিক ফাটল সৃষ্টি করেছে বা আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে, যা প্রকৃত নির্বাচনী ফলাফল পাল্টে দিতে পারে। আগামী বছরে বিশ্ব রাজনীতির মধ্যে এই যুদ্ধ কীভাবে প্রতিফলন ঘটাতে পারে তার চিত্রায়ণ রয়েছে এখানে।

যুক্তরাষ্ট্র:

গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে গভীরভাবে অনুভূত হবে। কারণ, সেখানে ভোটারদের কাছে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল কূটনৈতিক বিষয় গুরুত্ব বহন করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেভাবে ‘ইসরায়েলের বন্ধু’ হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছেন, ইসরায়েলকে আকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, ইসরায়েলকে সামরিকখাতে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে যাচ্ছেন, তেল আবিবকে সহায়তা করতে কংগ্রেসকে চাপ দিচ্ছেন, এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মানবিক যুদ্ধবিরতির দাবিতে ভেটো দিয়েছেন। তা নিয়ে তার দেশের মধ্যে এমনকি তার দলের মধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এদিকে গাজায় বিস্ময়কর মৃত্যুর সংখ্যা এই সমালোচনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে গাজায় এখন মার্কিন সহায়তার কৌশল ব্যবহার করছেন তিনি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবি করেন, ‘তিনি নিজেও একজন ইহুদিবাদী। আর তিনি মনে করেন, ইহুদিবাদী হওয়ার জন্য কাউকে ইহুদি হওয়ার প্রয়োজন নেই।’ তার এই ‘জায়োনিস্ট’ হয়ে উঠা ব্যাপকভাবে সমালোচিত। তিনি একটি দেশ তথা দলের প্রেসিডেন্ট হসেবে কীভাবে যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। এমনকি ইসরায়েলের প্রতি ডেমোক্রেটিক পার্টির অটল সমর্থনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

এবিসি নিউজ/ইপসোসের করা নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থিতা প্রত্যাশী অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় জনপ্রিয়তার দিক থেকে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তার হার আগের চেয়ে আরও কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে। তিনটি ক্ষেত্রে রিপাবলিকান প্রার্থিতা প্রত্যাশী রন ডিস্যান্টিস, নিকি হ্যালি, বিবেক রামাস্বামী এবং এসা হাটচিনসনের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে আছেন ট্রাম্প।

কমপক্ষে ৬৮ শতাংশ রিপাবলিকান সদস্য এবং রিপাবলিকান সমর্থকেরা বলেছেন, ট্রাম্প প্রার্থিতা পেলে নভেম্বরের নির্বাচনে তার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে নিকি হ্যালির প্রতি সমর্থন ১২ শতাংশ, ডিস্যান্টিসের প্রতি সমর্থন ১১ শতাংশ। অন্য প্রার্থিতা প্রত্যাশীদের প্রতি সমর্থনের হার এক অঙ্কের ঘরে।

জরিপে অংশগ্রহণকারী রিপাবলিকান সমর্থকেরা দলটির অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তুলনায় ট্রাম্পকে বেশি ‘বলিষ্ঠ নেতা’ ও প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ‘সবচেয়ে যোগ্য’ বলে মনে করেন। সব মিলিয়ে ৭০ শতাংশের বেশি রিপাবলিকান প্রাপ্তবয়স্ক সমর্থক চাইছেন ট্রাম্পকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হোক। অন্যদিকে ৫৭ শতাংশ ডেমোক্র্যাট সদস্য বাইডেন সম্পর্কে এমন মনোভঙ্গি পোষণ করেন। জরিপ অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের জনপ্রিয়তার হার কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত ১৫ বছরে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা এতটা কম ছিল না।

কাজটি এখন ডেমোক্র্যাটদের জন্য আরও কঠিনতর হয়ে উঠেছে কারণ জাতীয় সংবাদমাধ্যমের শিরোনামেই শুধু ট্রাম্প এগিয়ে থাকছেন না। বরং তিনি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়, এমন বিভিন্ন রাজ্যে জনপ্রিয়তায় বেশ এগিয়ে গেছেন। গত নির্বাচনে বাইডেনের জয়ের পেছনে যে ভোটিং গ্রুপগুলো নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে, সেই গ্রুপগুলোর মধ্যেও এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিক ভোটারদের ভেতরেও ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়ছে।

বাইডেন এখনও ট্রাম্পের চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকলেও বাইডেন জনপ্রিয়তার যে বিশাল ব্যবধান গতবার উপভোগ করেছিলেন, সেই জনপ্রিয়তা এখন আর তার নেই। অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ যে ভোটাররা গতবার ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তারা তাঁদের সেই সমর্থনের জায়গা থেকে সরে আসেননি। ডেমোক্র্যাটদের জন্য সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার কথা হচ্ছে, তরুণ ভোটারদের অনেকেই পক্ষত্যাগ করছেন। ২০২০ সালের ৩০ বছরের কম বয়সী ভোটারদের মধ্যে ২৫ পয়েন্ট পেয়েছিলেন বাইডেন। কিন্তু এবার সেই সংখ্যা প্রায় সমান সমান হয়ে এসেছে।

এরপরও ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের সমর্থন তরুণ ভোটারদের উত্তরোত্তর বিক্ষুব্ধ করছে। বিশেষ করে মিশিগানের মতো আরব আমেরিকান সুইং ভোটার অধ্যুষিত অঙ্গরাজ্যগুলোতে বাইডেনের জনসমর্থন অনেক কমে গেছে। এসব দিক বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, এবার ট্রাম্পকে হারানো বাইডেনের জন্য গতবারের চেয়ে অনেক কঠিন হবে।

ভারত:

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে কোটি কোটি মানুষ ভোট দেয়। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৈদেশিক নীতি ভোটের ফলাফল পরিবর্তনে প্রাথমিক ফ্যাক্টর না হলেও এটি যে কোন বিষয় নয় তা হবে না।

দীর্ঘ কয়েক দশক ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পর ১৯৯০ এর দশকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে আবার জোড়া লাগায় ভারত। সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছে ভারত, বিশেষ করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে। এদিকে ইসরায়েল মস্কোর পর ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে।

ইসরায়েলের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে মোদির কিছু অনুসারীরা অনুপ্রেরণা হিসেবেও গ্রহণ করেছেন। ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট ফর পিস-এর ড্যানিয়েল মার্কি বলেছেন, ‘ভারতের উগ্র হিন্দুরা ইসরায়েলকে এমনভাবে কল্পনা করতে ভালোবাসেন যেন জাতিগত সংখ্যগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ইসলামী সন্ত্রাসবাদের হুমকির মধ্যে পড়েছে তারা।’

এমনকি মোদির বিজেপি হামাসের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটি ভিডিও টুইট করে সেই আক্রমণকে ইসলামী সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ভারতের সংগ্রামের তুলনা করে করে ইসলামোফোবিয়ার শিখাকে আরও উস্কে দেয়।

লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক নিকোলাস ব্লারেল গাজার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করে বিজেপির এই সম্প্রচারকে আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে দেখছেন।

এদিকে ক্রাইসিস ২৪ এর ওয়াশ অপারেশন ম্যানেজার এমমেট পোটস বলেছেন, গাজা যুদ্ধে ভারতের প্রতিক্রিয়া ভোটারদের মধ্যে প্রধান বিষয় হয়ে উঠতে পারে।

রমজানে ইফতারির টেবিলে রাখতে পারেন জাফরানের পায়েস

জার্মানি:

২০০৮ সালে তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল যখন ইসরায়েল সফর করেন তখন তিনি দেশটির নিরাপত্তাকে জার্মানির রাষ্ট্রীয় কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রতি জার্মানির দৃৃঢ় সমর্থন নিয়ে দেশটিতে একটি ঠান্ডা মেজাজের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। দেশটির মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

এদিকে জার্মানির বুদ্ধিজীবীরা গাজার ‘গণহত্যা’ বন্ধের জন্য খোলা চিঠি দিচ্ছেন।

সূত্র: ফরেইন পলিসি