বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : গত নভেম্বরে প্রযুক্তির বাজারে আসে চ্যাটজিপিটি। প্রযুক্তিটি ব্যবহারের পর অনেকেই বলেছেন এর প্রভাবে আগামীর গণমাধ্যমে আমূল পরিবর্তন আসবে। এখনকার সময়ে যেভাবে সংবাদ উপস্থাপনা, লেখা কিংবা সম্পাদনা করা হয়, তার অনেকখানি বদলে যাবে চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) ছোঁয়ায়।
চ্যাটজিপিটি থেকে শুরু করে অন্যান্য এআই’র হাত ধরে গণমাধ্যমে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে, তা শুধু সংবাদকর্মী না, সাধারণ মানুষেরও আগ্রহের বিষয়।
অনেকের মনেই প্রশ্ন, চ্যাটজিপিটি কী সাংবাদিকদের চাকরি দখল করবে? দখল করলে কীভাবে করবে? কোন ধরনের সাংবাদিকরা ঝুঁকির মধ্যে আছেন? সংবাদমাধ্যমে চ্যাটজিপিটি কি এখন চ্যালেঞ্জ, নাকি সুবিধার আরেক নাম?
বাড়ছে এআই’র ব্যবহার
চলতি বছর এপ্রিলে কুয়েত নিউজের পর্দায় ভেসে ওঠে ফেদাহ নামে এক নারীর মুখ। সাবলীলভাবে সে জানায়, আসলে সে মানুষ না, একটি এআই। এরপর একের পর এক সংবাদের শিরোনাম পড়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় ফেদাহ। সবার মনে একই প্রশ্ন, এআই হয়ে কীভাবে এত সাবলীলভাবে সংবাদ উপস্থাপন করল ফেদাহ।
সাধারণ প্রশ্ন একসময় শঙ্কায় রূপ নিল, যখন সংবাদকর্মীরা বুঝতে পারলেন পৃথিবীতে এমন এক প্রযুক্তি এসেছে, যা মানুষের জায়গা দখল করে নেবে। এআই’র কারিশমা থেকে গণমাধ্যমও যে বাদ পড়বে না তা সহজেই অনুমেয়।
কুয়েতের মতোই চলতি বছরে ভারতের একটি নিউজ চ্যানেল ‘আজতাক নিউজ’ সানা নামে এআই দিয়ে খবর পড়ানো শুরু করে। পেশাদার সংবাদ উপস্থাপিকা এআই সানাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, মানুষ ক্লান্ত হয়, নেতিয়ে পড়ে, হোঁচট খায়। এসব এআই’র মধ্যে নেই। সানা সবসময় সতেজ, উৎফুল্ল ও ক্লান্তিহীন।
সানা ভারতের যেকোনো ভাষায় সংবাদ উপস্থাপন করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে অনেকেই বুঝতে পারছেন আলাদা করে একেক ভাষায় একেকজন সংবাদ উপস্থাপক রাখা, তাদের আলাদা বেতন দেয়া, বছরান্তে বেতন বাড়ানোর মতো ঝক্কি ঝামেলায় যাওয়ার থেকে একটি এআই দিয়ে কাজ চালিয়ে দেয়া যেকোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের জন্য সহজ।
সম্প্রতি নিউজজিপিটি নামে একটি নিউজ চ্যানেল চালু হয়েছে, যেটি শতভাগ এআই নির্ভর। এই চ্যানেলের সংবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক, উপস্থাপক, এডিটর সবাই এআই। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অ্যালান লেভি বলেন, দীর্ঘসময় থেকে একপাক্ষিক ও খামখেয়ালি ধাঁচের সংবাদ দেখে ও পড়ে আমরা ক্লান্ত। মানুষ কখনো নিরপেক্ষ হতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে একজন সাংবাদিক পক্ষপাতমূলক আচারণ করে ফেলে। সেখানে আমাদের এআইভিত্তিক এ সংবাদমাধ্যম শতভাগ নিরপেক্ষ থাকতে সক্ষম।
এর নিজের সুবিধার জন্য উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রকাশের কোনো প্রয়োজন নেই। আগামীর মিডিয়া এআই’র হাত ধরে আরও শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ হবে বলে মনে করেন অ্যালান।
যেভাবে বাড়লো এআই’র ব্যবহার
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদসংস্থা ওয়াল স্ট্রিটের সাবেক সংবাদিক ও অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) এআই বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সেসকো মার্কোনি বলেন, মূলত তিন ধাপে গণমাধ্যমে এআই তার জায়গা করে নিয়েছে।
প্রথম ধাপে শুধু তথ্য সংগ্রহের জন্য এআই ব্যবহার করা হতো। অটোমেশনের মাধ্যমে নানা এআই ব্যবহার করে নানা রকমের প্রতিবেদন তৈরি করা হতো। এপি, এএফপি ও রয়টার্সের মতো প্রতিষ্ঠানও প্রতিবেদন তৈরি করতে এআই’র সাহায্য নিতো।
দ্বিতীয় ধাপে বড় বড় পত্রিকা অফিসগুলো এআই ল্যাব খুলতে শুরু করে। সেখানে সাধারণত ভাষা ও তথ্যসমৃদ্ধ উন্নতমানের প্রতিবেদন তৈরির জন্য এআই ব্যবহার শুরু হয়।
আর বর্তমানে এমন এক নতুন ধাপ শুরু হয়েছে, যেখানে এআই নিজেই একটি আস্ত প্রতিবেদন লিখে দিতে সক্ষম।
এতে করে দেখা যায় শুধু সংবাদ উপস্থাপনা না তথ্য সংগ্রহ করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন লেখার সক্ষমতাও এআই’র আছে।
এআই হবে না মানুষের বিকল্প
ফিন্যানশিয়াল টাইমসের এআই এডিটর মধুমিতা মুরগিয়া বলেন, চ্যাটজিপিটির মতো সফটওয়্যারের জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে বড় দুটি কারণ হলো, এটির ব্যবহার অনেক সহজ। এছাড়া এর আচরণ একদম মানুষের মতো। চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথা বললে মনে হয় ওপাশ থেকে বিজ্ঞ কেউ একের পর এক তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
পুরো ব্যাপারটি যে মেশিনঘটিত এটা সহজে বোঝা যায় না। যে সফটওয়্যার দিয়ে এত সহজে তথ্য পাওয়া যায়, কিছু একটা লিখিয়ে নেয়া যায়, তাকে পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করে প্রতিবেদন লিখিয়ে নেয়া কঠিন কিছু না।
তবে মধুমিতা মনে করেন, চ্যাটজিপিটি দিয়ে কেবল তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট লেখানো কিংবা রিপোর্ট এডিট করা সম্ভব। অনুসন্ধানী রিপোর্ট কিংবা বিস্তারিত ব্যাখ্যামূলক রিপোর্ট লেখানোর ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটি কখনো মানুষের বিকল্প হবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘সাংবাদিকতা মানে নতুন কিছু বের করে নিয়ে আসা। এরজন্য দরকার দক্ষ মগজ ও অনুসন্ধানী চোখ। চ্যাটজিপিটি তাই বলে, যা আগে থেকে সবাই জানে। নতুন কিছু তৈরি করা এই সফটওয়্যারের পক্ষে সম্ভব না। কোনো কিছুকে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে গেলেও চ্যাটজিপিটি ভিমরি খেয়ে যায়। তাই গণমাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজকে সহজ ও নিখুঁত করে তুলতে পারে, মানুষের বিকল্প হতে পারে না।’
সংবাদ উপস্থাপনার বিষয়ে মধুমিতা বলেন, এআই’র ভালো গুণ হচ্ছে সে মানুষের কণ্ঠ বেশ ভালোভাবে নকল করতে পারে। কিন্তু নিজস্বতা সৃষ্টি করতে পারে না। এতে করে এআই দিয়ে সংবাদ পাঠ করালে একদিন-দুইদিন হয়তো ভালো লাগবে। কিন্তু পরবর্তীতে একদমই মেকি ও কৃত্রিম মনে হবে। কথা বলার মধ্যে যে একটি শিল্প আছে, তা কেবল মানুষের কণ্ঠেই মানায়।
এসবের বাইরেও এআই দিয়ে কাজ করানো ঝামেলার বলে উল্লেখ করে এআই বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সেসকো মার্কোনি বলেন, ‘অনেকে ধরেই নিয়েছেন এআই নির্ভুল কাজ করে। চ্যাটজিপিটির কথাই যদি বলি, তাহলে প্রায়ই এটি স্থানগত ও সময় সংক্রান্ত নানা ভুল তথ্য দিয়ে থাকে। সংবাদে যদি স্থান ও সময় ভুল হয়, তাহলে খবরের মান বলে আর কিছু থাকে না। এআইকে প্রত্যাখ্যান করার যেমনি কিছু নেই, তেমনি চোখ বুঝে এআই সব পারে এমন কথা বলাও ভিত্তিহীন।’
মার্কোনির কথার সঙ্গে মিল রেখে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের এআই-জার্নালিজম বিভাগের প্রধান অধ্যাপক চার্লি বেকেট বলেন, সংবাদমাধ্যমে এআই ব্যবহার একটি বিপ্লব ঘটাবে এ কথা সত্যি। তবে এখানে মানুষের দেখভাল করা সবচেয়ে জরুরি। প্রযুক্তি ব্যবহার ভালো, কিন্তু প্রযুক্তির ওপরে একেবারে নির্ভরশীল হয়ে পড়লে ভুগতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণ প্রতিবেদকরা যখন তাজা খবর পাঠান, সেই খবর কিন্তু হুবহু তুলে দেয়া হয় না। এডিটিং প্যানেলের কয়েক হাত ঘুরে এটি প্রকাশ পায়। কেউ যদি ভাবে এআই বসিয়ে দেবো, সেই খবর লিখবে, ছাপাবে তাহলে সেটা ভুল। এআই দিয়ে কোনো কাজ করালে সেটিও এডিটিংয়ের দাবি রাখে।’
এআই ব্যবহারে ভবিষ্যতের গণমাধ্যমের কাজ আরও সহজ হবে। তবে যেভাবে চারদিকে তথ্যের ছড়াছড়ি ও এআইয়ের মাধ্যমেও যেভাবে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে করে তথ্যের সাগরে ডুবে কোন্টি সঠিক আর কোন্টি ভুল তা ফিল্টার বা ফ্যাক্ট চেক করেও একেবারে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে অনলাইন মিডিয়াগুলোর ৯০ শতাংশ সংবাদ সৃষ্টি হবে এআই’র হাত ধরে। এতে করে যেসব সাংবাদিক কেবল প্রতিদিনকার ইভেন্ট কাভার করে দিনতিপাত করেন, তারা বিপদে পড়বেন বলে মনে করেন মার্কোনি।
এমন দিন দূরে নয়, যেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের জায়গায় ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন হাতে এআই দেখা যাবে। এডিটিং প্যানেলেও দেখা যাবে এআই কাজ করছে। হয়তো কাজ ও সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে এআই’র পদোন্নতি পর্যন্ত হবে। তবে যাই হোক না কেন, নতুন এক বিশ্বের জন্য প্রস্তুত থাকা ও নতুন এক গণমাধ্যমের জন্য সংবাদকর্মীদের গড়ে তোলার দিকে জোর দেয়ার এখনই সময়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।