আন্তর্জাতিক ডেস্ক : টাইটানিক- নামের মতোই বিশাল এক যাত্রীবাহী জাহাজ। কিন্তু প্রথম যাত্রাতেই জাহাজটির হারিয়ে যায় আটলান্টিকের অতল তলে। কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে ডুবে যায় টাইটানিক। সেই থেকে সাগরের তলদেশেই পড়ে আছে পরাক্রমশালী টাইটানিক।
১৯১২ সালে তখনকার সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ হিসেবে স্বীকৃত আরএমএস টাইটানিক তার প্রথম যাত্রায় আটলান্টিক মহাসাগরে একটি হিমবাহের সঙ্গে ধাক্কা খায়। জাহাজটি ডুবে যায় এবং জাহাজের ১ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি যাত্রী মারা যান।
টাইটানিক ঘিরে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। তৈরি হয়েছে অস্কার জয়ী চলচ্চিত্র। এমনকি এই টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে মানুষ সাগরতলে যায় গাটের পয়সা খরচ করে। আর এই কাজে নেতৃত্বে ছিলো ওশেনগেট নাম এক প্রতিষ্ঠানের তৈরি ছোট আকারের ডুবোজাহাজ- টাইটান।
টাইটানিক দেখতে যাওয়া এই যানের পরিণতিও হয়েছে টাইটানিকের মতো। প্রায় ৫০টি অভিযান চালানোর পর ডুবোজাহাজ টাইটানের সলিল সমাধি হয়েছে টাইটানিকের কাছেই। এখনও সেই সলিল সমাধিকে ঘিরে শোকের আবহ বিশ্বজুড়ে।
এর আগেন টাইটান যাত্রীরা জানাচ্ছেন, ডুবোজাহাজটির যে এমন পরিণতি হবে সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন। তারা দুষছেন, ওশেনগেট কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টকটন রাশকে। তিনি নিজেও ছিলেন হতভাগ্য ডুবোজাহাজটির যাত্রী।
প্রয়াত স্টকটন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, আর সেই কারণেই টাইটানের এমন পরিণতি, দাবি তাঁদের। ডিসকভারি চ্যানেলের ক্যামেরা অপারেটর ব্রায়ান উইড বলেন, আমি শতাভাগ নিশ্চিত ছিলাম এমন কিছু ঘটতে চলেছে।
২০২১ সালের মে মাসে তিনি টাইটানের এক পরীক্ষামূলক অভিযানে শামিল হয়েছিলেন। যদিও তাঁরা মাত্র ১০০ ফুট গভীরে নেমেছিলেন। কিন্তু সেবারই তাঁরা প্রবল সমস্যার মুখে পড়েছিলেন। তিনি জানান, টাইটানের যন্ত্রের মধ্যে বড় ধরনের গোলমাল হয়েছিলো।
উইড বলেন, টাইটানের প্রপালশন ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটছিল। সাড়া দিচ্ছিল না কম্পিউটারগুলো। সব রকমের যোগাযোগ ছিন্ন যায় মূল জাহাজের সঙ্গে। সেই সময় স্টকটন নিজেও অসন্তুষ্ট ছিলেন এই পারফরম্যান্সে। কিন্তু তারপরও তিনি অজুহাত দাড়া করান যাত্রীদের কীভাবে রাজি করানো যায়।
তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করে এই যানটি সাড়ে ১২ হাজার ফুট গভীরে যাবে! টাইটান নিখোঁজ হবার পর থেকেই তাই বুক ধড়ফড় করছিলো। শেষ পর্যন্ত তাঁর আশঙ্কা সত্যি করে টাইটানের সলিল সমাধি হলো। প্রশ্ন উঠছে, কেন আগে আরও সতর্ক হল না কর্তৃপক্ষ?
টানা পাঁচ দিনের বিশাল আকারের তল্লাশি অভিযানের পর গেলো ২২ জুন আটলান্টিকের তলে খোঁজ মিলে হারিয়ে যাওয়া ডুবোজাহাজ টাইটানের। তার মধ্যে যে পাঁচ জন ছিলেন, তাঁরা কেউই বেঁচে নেই বলে জানায় আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনী আর ওশেনগেট এক্সপেডিশানস।
১১১ বছর আগে আটলান্টিকের অতলে ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসস্তুপ দেখতে গিয়ে সেখানের মৃত্যু হয় পাঁচ অভিযাত্রীর। কানাডার পূর্বে নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের উপকূল থেকে ডুব দেয় টাইটান। যাত্রা শুরুর ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে ডুবোযানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
টানা চার দিন তল্লাশির পর আমেরিকার কোস্টগার্ড জানায়, টাইটানে থাকা কোনও যাত্রীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। রোবটের মাধ্যমে টাইটানের ধ্বংসাবশেষের খোঁজ মিলেছে। তার সব মিলিয়ে বড় পাঁচটি টুকরোর খোঁজ পেয়েছেন। সেগুলো উদ্ধার করা হবে কিনা, এখন নিশ্চিত নয়।
টাইটানের যাত্রীরা হলেন, ওশেনগেটের ৬১ বছর বয়সী সিইও স্টকটন রাশ, ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ (৪৮), তার ছেলে সুলেমান (১৯) ও ব্রিটিশ ব্যবসায়ী হামিশ হার্ডিং (৫৮), ফরাসি নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি ও বিখ্যাত পর্যটক পল-হেনরি নারজিওলেট (৭৭)।
টাইটানের ধ্বংসাবশেষ মিলেছে টাইটানিক ধ্বংসাবশেষ থেকে ১৬০০ ফুট দূরে। তবে ধ্বংসাবশেষ কোথায় আছে জানা গেলেও তার কাছাকাছি পৌঁছনো যায়নি। দুর্ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি অত্যন্ত প্রতিকূল বলে জানিয়েছে আমেরিকা ও কানাডার উপকূলরক্ষী বাহিনী।
দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে আকস্মিক ‘ইমপ্লোশন’-এর কথা বলা হয়েছে। ইমপ্লোশন হল বিস্ফোরণের (এক্সপ্লোশন) বিপরীত অবস্থা। এর ফলে কোনও বস্তু আচমকা ফেটে না গিয়ে, ভেতরের দিকে চুপসে যায়। এভাবে কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে ধ্বংস হয়েছে টাইটান।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, টাইটানিকের দিকে টাইটান যখন এগিয়ে যাচ্ছিলো, তখন সমুদ্রের একটি নির্দিষ্ট অংশে পৌঁছে পানির প্রচণ্ড চাপ পড়ে ডুবোযানের উপর। তার ভেতরে থাকা বায়ুর চাপের চেয়েও বাইরের পানির চাপ ছিলো অনেক বেশি। এ কারণে হঠাৎ চুপসে যায় টাইটান।
ডুবোযানের ধাতব দেয়াল দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ফলে ভেতরেই দেয়ালের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা যান যাত্রীরা। মনে করা হচ্ছে, টাইটানের যাত্রীরা বেশি সময় পাননি। মৃত্যু ছিল তাৎক্ষণিক আকস্মিক। কী হচ্ছে, বুঝে ওঠার আগেই ডুবোযানটি চুপসে যায়। পিষে মৃত্যু হয় ভেতরের সবার।
টাইটানের দৈর্ঘ্য ছিল ২২ ফুট। ওজন ৯,৫২৫ কেজি। টাইটান ছিল ৯ ফুট চওড়া। এই ডুবোযানে যাত্রীদের জন্য জায়গা ছিলো খুবই অল্প। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর বা হাঁটু মুড়ে বসার মতো জায়গাও ছিলো না টাইটানের ভেতরে। পা ভাঁজ করে বসে থাকতে হতো।
কার্বন ফাইবার এবং টাইটানিয়াম দিয়ে তৈরি এই ডুবোযানের পাঁচ জনের বেশি বহন ক্ষমতা ছিলো না। ধারণা করা হচ্ছে, টাইটানের ধাতব কাঠামো ত্রুটিপূর্ণ ছিলো, যা পানির নিচের চাপ সহ্য করতে পারেনি। যার কারণে, পানির চাপে সেটি চুপসে যায়।
সমুদ্রের ১৩,১২০ ফুট গভীর পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা ছিল টাইটানের, তেমনটাই দাবি অভিযানের আয়োজক সংস্থা ওশানগেটের। আর বিলাসবহুল জাহাজ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে আটলান্টিবের সাড়ে ১২ হাজার ফুট গভীরে।
কোনও জানলা ছিল না টাইটানে। ছিলো কেবল একটি ‘পোর্টহোল’। তা দিয়েই সমুদ্রের তলার দৃশ্য এবং টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ চাক্ষুষ করার সুযোগ মেলে অভিযাত্রীদের। এখন ধ্বংস হয়ে যাওয়া সেই টাইটানের খোঁজ পাওয়ার পর তদন্ত নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে।
১৯৮৫ সালে আটলান্টিকের তলদেশে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার হয়। আর ২০১৮ সালে ওশ্যানগেট টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখানোর জন্য পর্যটকদের বহন করার প্রস্তুতি নেয়। দুই দফা চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর, ২০২০ সাল থেকে শুরু টাইটানের টাইটানিক দর্শন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।