লাইফস্টাইল ডেস্ক : অফিসে কাজের ক্ষেত্রে একে অন্যের উপর অনেক ধরনের নির্ভরতা থাকে। একজন মানুষের কর্মদক্ষতা দিয়ে পুরো অফিস চলতে পারে না। এখানে নিশ্চিত করতে হয় যে প্রত্যেক কর্মী দক্ষতা, সততা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন।
কর্মীদের মধ্যে এই দক্ষতা, সততা, আন্তরিকতার কমতি দেখা গেলে, তার পেছনে কোনো কারণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব থাকে ডিপার্টমেন্টের প্রধানের উপরে। সঠিক কারণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পুরো বিষয়টি নিয়ে সেই কর্মীর সঙ্গে আলোচনায় বসা। তার কাজে কোথায় সমস্যা হচ্ছে তা জানা। তারপর সে অনুযায়ী তাকে ফিডব্যাক দেওয়া।
কিন্তু এই কাজটি করা কঠিন। কারণ প্রায় সবার প্রশংসা শোনার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সমালোচনা শোনার ক্ষেত্রে প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা থাকে। তারা গুণগতমান নিয়ে আলোচনা করাকে সহজ ভাবে নিতে পারেন না।
আসুন জেনে নিন, ফিডব্যাক দিতে গিয়ে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং তা কাটিয়ে ওঠার উপায় কী।
সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়
অফিস বা ডিপার্টমেন্ট প্রধানের একটি বড় দায়িত্ব থাকে অফিসের সবার জন্যে একটি সুন্দর কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা। যেখানে কর্মীরা ভালোভাবে তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে কাজ করবে। তবে এটি নিশ্চিত করা একটি পরিশ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ কাজ।
ফিডব্যাকের বিষয়টি কর্মী যদি ভালোভাবে না নেন, তাহলে তার কাজের গুণ এবং পরিমাণ আরও কমে যেতে পারে, দলের মধ্যে কাজের সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হতে পারে, কর্মী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করতে পারে—এ রকম নানা ধরনের চিন্তা–ভাবনা ডিপার্টমেন্ট প্রধানের মধ্যে ফিডব্যাক দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা তৈরি করে।
প্রস্তুতিতে যথেষ্ট সময় দিতে অনিচ্ছা
জরুরি কাজ, লক্ষ্য পৌঁছানোর যাবতীয় কাজ, ডিপার্টমেন্টের কর্মীদের পরিচালনা করা, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামলানো ইত্যাদি এত কিছুর ভিড়ে আলাদা করে আদ্যোপান্ত বিবেচনা করে এবং যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে ফিডব্যাক দেওয়াকে অনেক ডিপার্টমেন্টের প্রধান তাদের অন্যতম জরুরি কাজ বলে বিবেচনা করেন না। সে কারণে সাধারণত দুইটার মধ্যে যেকোনো একটা ঘটনা ঘটে–
১. যথাযথ সময়ের মধ্যে ফিডব্যাক দিতে পারেন না।
২. প্রস্তুতি না নিয়েই ফিডব্যাক দেন।
সমস্যা হচ্ছে, এই দুটো বিকল্পের কোনোটিই কর্মীর জন্যে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। বরং দলের কাজের পরিমাণ ও গুণগতমানের ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করে।
নেতিবাচক পরিণতির ভয়
‘কি হবে যদি অমুক আপসেট হয়! তার কাজের মান খারাপ হয়ে যায়! আমার নামে যদি বিচার দেয়? তাহলে তো ভালো হওয়ার চেয়ে আরও খারাপ হবে। এর চেয়ে যেভাবে চলছে চলুক’—এই ধরনের দুশ্চিন্তা ফিডব্যাকের সময় ডিপার্টমেন্টের প্রধানকে নিরুৎসাহিত করে। অনেক সময় ডিপার্টমেন্ট প্রধানের সমস্যা থেকে পলায়নপর মনোভাব ডিপার্টমেন্টকে সমষ্টিগতভাবে অনেক পিছিয়ে রাখে। নেতিবাচক পরিণতির ভয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছা দলের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনে না।
পরিণতি নিয়ে জবাবদিহিতার ভয়
‘কি হবে যদি বস আমার কাছে জানতে চান? আমি কেন কাজ নিয়ে বকলাম, তখন আমি কি বলবো। বাদ দেই, যেভাবে চলছে চলুক’। যখন ফিডব্যাকের সার্বিক বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হয় না, তখন এই ভয় আসতেই পারে।
কেন আলোচনা ফলপ্রসূ হয় না
প্রস্তুতির ও সহমর্মিতার অভাব ফিডব্যাককে একটি শক্তিশালী এবং কার্যকর যন্ত্রে পরিণত হতে দেয় না। প্রস্তুতির অভাবে অনেক বেফাঁস কথা বের হয়ে যেতে পারে, কর্মী কোনো প্রশ্ন করলে তার যথাযথ উত্তর না থাকতে পারে, কর্মী বাজেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালে তখন কি করতে হবে তার আন্দাজ না থাকতে পারে। যে কারণে আলোচনা থেকে যেই ফল আশা করা হয়, তা প্রস্তুতির অভাবে সম্পূর্ণ হয় না।
তেমনিভাবে সহমর্মিতার অভাব ডিপার্টমেন্ট প্রধানকে অসংবেদনশিল কথাবার্তায় উৎসাহিত করতে পারে। প্রস্তুতির একটা সুবিধা হচ্ছে যে কোন কথা বলা হবে আর কি বলা যাবে না, নিদেনপক্ষে সেই সীমারেখা নির্ধারণ করে রাখা। দুই পক্ষের যে কোনো একপক্ষ সংবেদনশীল না হলে তা অপরপক্ষকে মানসিকভাবে অসহযোগী করে তুলতে পারে এবং সেই আলোচনা ফলপ্রসূ কোনো সিদ্ধান্তে আসতে বাঁধাগ্রস্ত করে।
সহমর্মিতা ও সম্মান প্রদর্শন দুই পক্ষের মধ্যেই থাকতে হয়। যদিও গুণাবলিগুলো ডিপার্টমেন্ট প্রধানের মধ্যে বেশি থাকা ডিপার্টমেন্টের জন্যে জরুরি বেশি, তবুও যে কোনো একপক্ষের মধ্যে তার অভাব আলোচনাকে ফলপ্রসূ হতে দেয় না।
আবার যাকে ফিডব্যাক দেওয়া হচ্ছে তার ব্যক্তিত্বের মধ্যেও সমালোচনা গ্রহণ করার অনিচ্ছা তীব্র থাকতে পারে। আমরা প্রত্যেকেই জীবনে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হই। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে এমন অনেক কিছুই থাকে যা আমাদেরকে ট্রিগার করে।
দেখা যায় অনেকেই আছে যারা যুক্তিযুক্ত সমালোচনাও গ্রহণ করতে পারে না। অনেকে আছে খুব অল্পতে ভুল বুঝে, অনেকে খুব অল্পতেই আত্মরক্ষামূলক মানসিক অবস্থায় চলে যায়। এই ধরনের মানসিকতাও অনেক সময়ই ফলপ্রসূ আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করে।
যেই সময়ের মধ্যে ফিডব্যাক দেওয়া দরকার, তখন না দিলে অনেক সময় ফিডব্যাকের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। অনেক ডিপার্টমেন্টের প্রধান আশা করেন ধৈর্য ধরলে সমস্যা নিজের থেকে মিটে যাবে কিংবা কর্মী নিজে নিজেই বুঝে যাবে সমস্যা। এ ধরনের বৃথা আশা সমাধানকে আরও দূরে নিয়ে যায়।
কীভাবে আলোচনা ফলপ্রসূ করা যায়
একজন ডিপার্টমেন্টের প্রধান যখন যথাযথ প্রস্তুতি নেবেন, তখন তিনি আশা করতে পারেন একটি ফলপ্রসূ আলোচনার। ডিপার্টমেন্ট প্রধান প্রস্তুত হলে ফিডব্যাক দেওয়ার মতো জটিল একটি প্রক্রিয়ার অনেক অনিশ্চয়তাকে নিশ্চয়তা দেয়। প্রস্তুতির বিভিন্ন পর্যায় এবং পদক্ষেপ আছে। যেমন:
১. কোথায় বসে ফিডব্যাকের আলোচনা দেয়া হবে, তা ঠিক করা। অনেক সময় অফিসের বাইরেও এক সাথে লাঞ্চ বা ডিনার করতে গিয়ে অনেক গভীর আলোচনা করা যায়। দুই পক্ষই যেখানে কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত থাকবে এবং আলোচনা গুরুতর রূপ ধারণ করবে না। অফিসের ভিতরে করলে অবশ্যই এমন জায়গায় করা উচিত যেখানে যে কেউ আলোচনাতে ঢুকে যেতে পারবে না।
২. আলোচনায় বসার আগে নিজের জন্যে কিছু বিষয় নোট করে রাখা প্রয়োজন। যেমন: কর্মীদের কোন গুণাবলি ডিপার্টেমেন্টের জন্য অসম্ভব জরুরি, সবচেয়ে জরুরি কোনো বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে হবে—তাও ঠিক করে রাখা প্রয়োজন।
৩. জানতে হবে কী ধরনের কথা বলা যাবে না। এও জানতে হবে কী ধরনের কথা বললে অনুপ্রেরণা আসবে। যে কোনো অসম্মানজনক উক্তি, তা যতই ছোট মনে হোক না কেন, যে কোনো মূল্যে তা পরিহার করতে হবে।
৪. আলোচনা তখনই ফলপ্রসূ বলে গণ্য করা হবে যখন দুইজন দুইজনের বক্তব্য বুঝতে পারেন। গ্রহণযোগ্যতা না আসলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়েও আলাপ করতে হবে। অথবা কিছু সময় পরের পরবর্তী আলোচনার সময় ঠিক করে নিতে হবে।
৫. ডিপার্টমেন্টের কর্মীদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া যায় যে, কী ধরনের সাহায্য তারা তাদের ডিপার্টমেন্ট প্রধানের কাছ থেকে আশা করেন। আলোচনা দুইপাক্ষিক হওয়া আবশ্যক। ডিপার্টমেন্টের কর্মী যেন এই আলোচনাকে বিচার কার্যক্রম মনে না করেন, তা খেয়াল রাখতে হবে ডিপার্টমেন্ট-প্রধানকেই।
৬. সারা বছর একবার বা দুইবার যদি বসা হয় আলোচনাতে, তখন অনেক গভীর সমস্যা সময়ের স্রোতে হারায় যায়। আবার, কোন একটা সমস্যা হওয়া মাত্রই বসতে হবে এমন না। সমস্যা যখন হয়, তার অল্প সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে তারপর বসতে হবে। বছরে একবার বাৎসরিক মূল্যায়নের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত না।
৭. ভালো হয় যদি আলোচনার মূল বিষয়বস্তু এবং আলোচনার দুইপক্ষের সমঝোতায় আসা সিদ্ধান্তগুলো সারমর্ম হিসেবে একটা ই-মেইল এর মাধ্যমে ডিপার্টমেন্ট-প্রধান জানান ডিপার্টমেন্টের সেই কর্মীকে। এতে ভবিষ্যতের আলোচনাগুলোও গঠনমূলক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে মনে রাখা যে, একজন ডিপার্টমেন্ট প্রধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে ডিপার্টমেন্টের কর্মীদের কার্যদক্ষতার গুণ ও মান বাড়ানো, কাউকে নিরুৎসাহিত না করা। তাই যথাযথ প্রস্তুতির সঙ্গে কাজ, দক্ষতা, সততা, ইত্যাদি নিয়ে ফিডব্যাক দেওয়ার আগে ডিপার্টমেন্ট প্রধানের দায়িত্ব সঠিক প্রস্তুতি নেওয়া। ডিপার্টমেন্ট প্রধানদের অথবা সম্ভাব্য প্রধানদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে ফিডব্যাকের পুরো প্রস্তুতির উপর। এই প্রশিক্ষণ ডিপার্টমেন্ট প্রধানদের আত্মবিশ্বাসী ও আন্তরিক করে তুলবে।
লেখক: প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট এক্সপার্ট, স্পিড প্রাইভেট লিমিটেড
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।