জুমবাংলা ডেস্ক : ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গার দুই যুবককে গুলি করে হত্যার পর ছবি পাঠানো হয় পরিবারের কাছে। মানব পাচার সিন্ডিকেটের আঞ্চলিক চক্রের ফাঁদে পা রেখে এভাবেই দিনের পর দিন কেও হচ্ছেন জিম্মি, কেওবা অমানবিক নির্যাতনের শিকার, কারও ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ।
শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) নিহত হৃদয় হাওলাদারের বাবা মিন্টু হাওলাদের মোবাইলে হোয়াটস অ্যাপে হৃদয়ের নৃশংস মৃত্যুর পর লাশের ছবি পাঠায় ওই মাফিয়া চক্র। এরপর থেকেই পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে শোকের ছায়া। তবে সে ছায়া না কাটতেই বিষয়টি মিটমাটের জন্য শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই পাচারকারীদের স্থানীয় দালাল চক্রের পক্ষে সক্রিয় হয়ে উঠেন গ্রাম্য কয়েকজন মাতব্বর। তারা বিভিন্নভাবে নিহতের পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করছেন মীমাংসার জন্য। এতে সজন হারানোরা মানসিক চাপে হচ্ছেন বিভ্রান্ত। ওই চক্রের নেটওয়ার্ক ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাদারীপুরের রাজৈর ও শিবচর এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানাসহ আশপাশের কয়েকটি থানায় সক্রিয়।
ভাঙ্গার ঘারুয়া ইউনিয়নের কুমারখালি গ্রামে শনিবার গেলে এসব তথ্য জানান নিহতের স্বজনরা। তবে পাচার চক্রের অন্যতম হোতা স্থানীয় বাসিন্দা আনোয়ার মাতুব্বর পলাতক বয়েছেন, বন্ধ রয়েছে তার মোবাইল ফোন। আনোয়ারের মাধ্যমেই লিবিয়া যান হতভাগ্য ওই দুই যুবক।
হৃদয়ের বাবা মিন্টু হাওলাদার জানান, একদিকে ছেলে হারানোর শোক, অন্যদিকে বিষয়টি সালিশে সমাধানের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন দালালদের পক্ষে একটি প্রভাবশালী চক্র। এ চক্রের রয়েছেন স্থানীয় মক্রমপুট্টি গ্রামের দবির মাতব্বর, জলিল মেম্বার, মিরাজ মেম্বার ও বাবু আকন। দালাল চক্রের পক্ষে সক্রিয় হয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন তারা।
মিন্টু হাওলাদার জানান, দু’মাস আগে স্থানীয় তারা মাতব্বর, আলমাছ মিয়া ও মো. আনোয়ারের মাধ্যমে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বিদেশ পাঠান ছেলেকে। প্রথমে দুবাই, সেখান থেকে সৌদি আরব তারপর লিবিয়ায় নিয়ে যায় দালাল চক্র। গত ২৪ তারিখে শেষ কথা হয় ছেলের সঙ্গে তার। তখন হৃদয় তাকে জানায়, দালাল আনোয়ারসহ কাউকেই যেন ছাড় দেয়া না হয়। এরপর আর কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি। ছেলেকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার এবং খুনের জন্য স্থানীয় মানব পাচার চক্রের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ বিচারের দাবি জানান তিনি।
কুমারখালি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, কুয়াশা উপেক্ষা করে ভোর থেকেই শুরু হয় শোকাহত বাড়ি দুটি ঘিরে মানুষের ভিড়। গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে পুরো গ্রামেই যেন নেমেছে শোঁকের ছায়া। বিভিন্ন অটো-ভ্যানযোগে আশ-পাশের ৭-৮ গ্রামের হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে নিহত হৃদয় ও রাসেলের বাড়িতে। এ সময় স্থানীয় কয়েকটি সক্রিয় দালাল চক্রের ইতালিতে নেয়ার গল্পও শোনা যায় তাদের মুখে।
স্থানীয়রা জানান, তাদের গ্রামের নিহত দুই যুবক ও নিখোঁজ আরেক যুবকের কাছ থেকে ইতালি পাঠানোর চুক্তিতে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা নিয়েছে স্থানীয় দালাল চক্রটি। এদের মধ্যে ভাঙ্গার ঘারুয়ার কুমারখালির আনোয়ার মাতব্বর, পাশের মাদারীপুরের রাজৈর থানার শহিদ মিয়া নামের দুইজনই মুল হোতা। এছাড়াও মাদারীপুর ও শিবচরসহ কয়েকটি থানায় এ দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ওই মানব পাচার চক্র গ্রামের সাধারণ মানুষকে অল্প দিনে বেশি টাকার মালিক হওয়ার লোভ দেখিয়ে ইতালি পাঠানোর চুক্তি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। আর মাফিয়াদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলেই খুন করা হয় লিবিয়ায় নিয়ে।
স্থানীয় রেজাউল মিয়া ও কালাম শেখ জানান, কুমারখালি গ্রামের দালাল আনোয়ার মাতব্বর গত দুই বছর আগে বিদেশ থেকে গ্রামে আসেন। এরপর থেকেই গ্রামের সাধারণ মানুষকে ইতালিতে নেয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর মধ্যেই দুইজন খুন হলো। আরেক জন নিখোঁজ রয়েছে। আনোয়ারের সঙ্গে মানব পাচারের বড় একটি সিন্ডিকেট জড়িত যার নেটওয়ার্ক ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাদারীপুরের রাজৈর ও শিবচর এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানাসহ আশপাশের কয়েকটি থানায় সক্রিয়। মাস দেড়েক আগে ভাঙ্গার মিয়া পাড়ার শহীদুল ইসলাম ও সাওথার গ্রামের রিংকু খালাসী মারা গেছেন। তারা দু’জন পাতরাইল দিঘিরপাড়ের দালাল বাদশা ফকিরের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার চুক্তিতে লিবিয়ায় যাওয়ার পর খুন হন। এসব মানব পাচারকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানান স্থানীয়রা।
গুলিতে নিহত আরেক যুবক রাসেল হাওলাদারের বাবা মজিবর হাওলাদার জানান, ‘আদম যদি টাকা ঠিকমত দিতো, তাহলে রাসেলকে গুলি করে মারত না। আমরা টাকা চাই না, আদমের বিচার চাই।’ নিহতরা দুইজনসহ গ্রামের তারা মাতব্বরের ছেলে সোহেল মাতব্বর নিখোঁজ রয়েছে বলেও অভিযোগ জানান পরিবারের সদস্যরা।
তারা মাতব্বর জানান, গত ২৭ তারিখে দালালের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন, তার ছেলে ট্রলার ডুবে মারা গেছে। তার কোনো সন্ধান পাচ্ছেন না তারা। তিনি তার ছেলেকে পাশের রাজৈর থানার মোল্লাদী গ্রামের শহীদ মিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাঠান। তিনি তার ছেলেকে জীবিত অথবা মৃত হোক দেশে ফিরে পেতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
উল্লেখ্য: ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়ার কুমারখালি গ্রামের বাসিন্দা দুই যুবককে ইতালিতে নেয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে গুলি করে খুন করা হয়। তাদের সঙ্গে গ্রামের সোহেল মাতব্বর নামের আরও এক যুবক নিখোঁজ হয়। শুক্রবার এ নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। কুমারখালি গ্রামের নিহতরা হলেন- মিন্টু হাওলাদের ছেলে হৃদয় হাওলাদার (২৪) ও মজিবর হাওলাদারের ছেলে রাসেল হাওলাদার (২৬)। তাদের সঙ্গে নিখোঁজ রয়েছেন- একই গ্রামের আবু তারা মাতব্বরের ছেলে সোহেল মাতব্বর।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।