নিজস্ব প্রতিবেদক: সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে আপোষহীন ভূমিকার কারণে ‘আয়রনম্যান গভর্নর’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ‘আমি ভয় পাই না। ভয় পাওয়ার লোক আমি নই। ভয় পেলে অর্থ সচিবের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গভর্নরের পদে আসতাম না। কারণ, আমার আরো এক বছর দুই মাস চাকরি বাকি ছিল। দেশের অর্থনীতির কল্যাণে যেটা প্রয়োজন সেটা আমি নির্ভয়ে করে যাবো।’
প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মালিকানাধীন ব্যংকগুলোর অনিয়মের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পান কি না- এমন এক প্রশ্নের জবাবে কঠোর এই জবাব আসে গভর্নরের কাছ থেকে। বুধবার চলতি অর্থবছরের শেষার্ধের মুদ্রানীতির ভঙ্গি ঘোষণাকালে গভর্নর রউফ তালুকদার এসব কথা বলেন।
এবারের মুদ্রানীতিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সচরাচর বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলেও এবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। গভর্নর স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই। আমার লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি কমানো। এটা করতে গিয়ে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমে গেলেও সমস্যা নেই।’
এদিকে সামনে কোন ব্যাংক বন্ধ হবেনা জানিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলো মার্জ বা একীভূত করার ইঙ্গিত দিয়ে গভর্নর বলেছেন, ‘একীভূত করা হলে ব্যাংকগুলো আরো শক্তিশালী হবে।’
বুধবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির একটি খসড়া পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন আকারে উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান।
সাহসী ভূমিকা নিচ্ছেন গভর্নর:
অর্থসচিবের চাকরি ছেড়ে গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক সাহসী ভূমিকা নিচ্ছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। প্রথমেই তিনি গভর্নরের কার্যালয়ে প্রভাবশালী ‘তদবিরবাজদের’ অবাধ যাতায়াতের পথ সংকুচিত করেন। পাশাপাশি তিনি উদ্ভাবনী উদ্যোগ নিয়ে ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগগুলোকে শক্তিশালী করেছেন।
শুরুর দিকেই তিনি ব্যাংক খাতের ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে এগুলোকে কঠোর তদারকিতে এনে সুশাসন নিশ্চিতের উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকও রয়েছে। মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে গভর্নর বলেন, ‘গত এক বছরে দুর্বল ব্যাংকগুলো আর দুর্বল হয়নি।’
ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রেও শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েছেন রউফ তালুকদার। তার কার্যকালে পরিচালনা পর্ষদের চাপে ৫টি ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করলেও ৩ জনকেই স্বপদে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন তিনি।
সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা নিয়েছেন তিনি ন্যাশনাল ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দিয়ে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকটির স্বেচ্ছাচারিতার ক্ষেত্রে এতদিন নিরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে নতুন বোর্ড গঠন করায় প্রসংশিত হয়েছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। তবে ন্যাশনাল ব্যাংকের বোর্ডে মানি লন্ডারিংয়ে দায়ে বিএফআইইউ-এর তদন্তে অভিযুক্ত সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি কামাল হোসেনের অন্তর্ভুক্তি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এদিকে ডলার কারসাজির ঘটনায় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের জরিমানা করার পাশাপাশি নিয়ম ভঙ্গের কারণে ব্যাংকগুলোকে জরিমানা করা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
অর্থনীতির ক্রান্তিকালে আইএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন গভর্নর। এছাড়া অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র সরকার প্রধানের কাছে উপস্থাপনের পাশাপাশি স্পষ্টভাবে তার মতামত তুলে ধরছেন, যা নীতিনির্ধারণী মহলে প্রসংশিত হচ্ছে।
বাজারে টাকার জোগান আরো কমবে:
মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দেওয়ার চলমান উদ্যোগের মধ্যে বাজারে অর্থের জোগান আরও কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; এর অংশ হিসেবে নীতি সুদহার আরও এক দফা বাড়ানো হয়েছে।
এ পরিবর্তনের ফলে এক দিন মেয়াদী রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদ হার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে।
এর আগে সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাত দশমিক ৭৫ শতাংশ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
গতবারের মুদ্রানীতিতে নেওয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায়নি মন্তব্য করে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, “সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটু সময়ের প্রয়োজন হয়। বেশ সময় লেগে যায়। আগের চেয়ে না বাড়লেও গত নভেম্বর থেকে ক্রমাগত কমছে মূল্যস্ফীতি।’’
এবারের মুদ্রানীতিতে বিশেষ রেপো সুদহারে (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি-এসএলএফ) নীতি সুদহার করিডোরের উর্ধ্বসীমা ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে, বর্তমানে তা ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা রিভার্স রোপো সুদহার (স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি-এসডিএফ) বিদ্যমান ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাড়ে ছয় শতাংশ করা হয়েছে।
নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্ন সীমার মধ্যে ব্যবধান ২০০ শতাংশ পয়েন্ট থেকে কমিয়ে ১৫০ শতাংশ পয়েন্টে নামিয়ে আনা হয়েছে।
অর্থাৎ নীতি সুদহার ৮ শতাংশের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১৫০ বেসিস পয়েন্ট যোগ করে এসএলএফ সুদহার ও নিচে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বিয়োগ করে এসডিএফ সুদহার নির্ধারণ করা হবে।
নগদ অর্থের প্রয়োজনে বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হারের চাপ নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রয়াজনীয় অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে মুদ্রানীতিতে।
তবে ৪ শতাংশের ব্যাংক রেটে পরিবর্তন আনা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, একেএম সাজেদুর রহমান খান, আবু ফরাহ মো. নাছের ও নুরুন নাহার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।