জুমবাংলা ডেস্ক : মসজিদে ইমামতি করার সময় তার ফ্রিল্যান্সিংয়ের শুরু। পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে আয় করছেন দেড় লাখ টাকা। সফল এই ফ্রিল্যান্সারের নাম এইচ এম রেদওয়ান আহমেদ। তার সফলতার গল্প তুলে ধরেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
যাত্রা শুরুর গল্প : মোবাইলে ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে একদিন ফ্রিল্যান্সিংয়ের একটি ভিডিওতে চোখ আটকে যায় রেদওয়ানের। ভিডিওটি দেখার পর ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কৌতূহল শুধু বাড়েই না, বরং তিনি এ নিয়ে গুগুল ও ইউটিউব থেকে আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেন। এ কাজের মাধ্যমে ঘরে বসে ডলার আয় করা যায়, বিষয়টি তার খুব পছন্দ হয়। মনে মনে এমন কোনো কাজই করতে চাচ্ছিলেন তিনি।
পড়াশোনা : রেদওয়ান সিলেটের বিয়ানীবাজারের কসবা ইমামবাড়ী হাফিজিয়া মাদ্রাসায় হিফজ শেষ করেছেন। সিলেট বিয়ানীবাজারের মাথিউরা সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা থেকে আলিম পাসের পর এখন দাওয়াহ বিষয়ে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন। তিন বোন, এক ভাই, মা-বাবাসহ সবার দেখভালের দায়িত্ব তার কাঁধে। সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার মাছিমপুরে তাদের বাড়ি।
প্রথম আয় : তার প্রথম অর্ডার ছিল মাত্র পাঁচ ডলার। ইংরেজি ভালো না জানার কারণে প্রথম কাজটি হাতছাড়া হয়ে যায়। মন ভেঙে গেলেও এরপর রেদওয়ান যেন নিজের সঙ্গে নিজেই যুদ্ধ চালিয়ে যান। সফল হওয়ার তীব্র ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসে। কিন্তু রেটিং ভালো না থাকায় ক্লায়েন্টরা তাকে কাজই দিচ্ছিলেন না। এক কানাডিয়ান মুসলিম ক্লায়েন্টকে কোনোভাবেই তিনি বোঝাতে পারছিলেন না যে, তিনি ওয়েবসাইট ডেভেলপ করতে পারেন। পরে শেষমেশ বলেই বসেন, আমি আপনাকে ফ্রিতে কাজ করে দেব, তবু আমাকে কাজটা দিন। ক্লায়েন্টের জবাব ছিল, আপনি ফ্রিতে ওয়েবসাইট করে দিন। যদি আমার ভালো লাগে, তাহলে আমি আপানকে ১৫০ ডলার দেব। পরবর্তী সময় কাজটি এত ভালো হয়েছিল যে, ১৫০ ডলারের বদলে ৩৫০ ডলার পেমেন্ট করেন ক্লায়েন্ট। এটিই ফ্রিল্যান্সিয়ে প্রথম আয় রেদওয়ানের। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। রেদওয়ান এখন ফাইবারে টপ রেটেড সেলার। ফ্রিল্যান্সিংয়ে মাসে তার আয় দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। মূলত কাজ কমবেশির ওপর আয় নির্ভর করে বলে তিনি জানান।
কাজের ফিরিস্তি : ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজের পরিধি ব্যাপক। এর মধ্যে রেদওয়ান বেছে নিয়েছেন ওয়েবসাইট ডিজাইন এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্ট। কোনো কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও তিনি ফাইবার, আপওয়ার্কসহ বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে কাজ করছেন। লার্ন উইথ রেদওয়ান নামে একটি এজেন্সি দিয়েছেন তিনি। ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট নামক কোর্সের এক প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন বেশ কিছুদিন আগে। রেদওয়ানের কাছ থেকে ফ্রিল্যান্সিং শিখে অনেকেই এখন ভালো আয় করছেন বলে জানান তিনি।
ভয়কে জয় করুন : রেদওয়ান মনে করেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও ইমাম-মুয়াজ্জিনদের পড়াশোনা ও কাজের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করার সুযোগ আছে। এ জন্য মনোবল, আত্মবিশ্বাস ও গভীর ধৈর্য থাকতে হবে। পরিশ্রম ও রাত জাগার মানসিকতা না থাকলে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। ভয়কে জয় করতে হবে। দেখা যায়, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও ইমাম-মুয়াজ্জিনরা ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতেই ভয় পান। বিশেষ করে ইংরেজি ভালো না জানার কারণে। এসব মানুষের জন্য রেদওয়ানের পরামর্শ হলো, একদমই দেরি করবেন না। এখন থেকেই শুরু করুন। গুগল ও ইউটিউবকে আপনার পার্টনার হিসেবে গ্রহণ করুন। কিছুদিন চর্চা করলে ইংরেজিতে কথা বলতে পারবেন।
শত বাধা পেরিয়ে : বাবা দিনমজুর। পরিবারের অর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। বড় ছেলে হওয়ায় পুরো পরিবার তাকে দেখভাল করতে হতো। ফ্রিল্যান্সিং কোর্স করবেন। সে অর্থ জোগার করতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। মোবাইল দিয়ে সেভাবে তখন ফ্রিল্যান্সিং করা প্রায় অসম্ভব ছিল। ইমামতির আয়ে দশ হাজার টাকায় একটি পুরনো ল্যাপটপ ক্রয় করেন। তাও পরিবারকে না জানিয়ে। এরপর ওয়েব ডিজাইন ও ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট প্রিমিয়াম কোর্সে ভর্তি হন। নেটওয়ার্ক না থাকায় মসজিদ থেকে বের হয়ে পুকুরপাড়ে বসে ল্যাপটপে ক্লাস করতেন। ব্যাপারটা অনেকেই তখন সহজভাবে মেনে নেয়নি। প্রশ্ন উঠে, একজন ইমাম কেন পুকুরপাড়ে বসে ল্যাপটপ ব্যবহার করবেন? গ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে রেদওয়ান বোঝাতে পারেননি যে, তিনি ফ্রিল্যান্সিং করছেন। একপর্যায়ে ওই মসজিদের ইমামতি ছেড়ে তাকে বেকার থাকতে হয় বেশ কিছুদিন। এরপর অন্য এক মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব নিলে ফ্রিল্যান্সিংয়ে সেখানে আর কেউ তার বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। রেদওয়ান বলেন, প্রায় ছয় মাস আমি রাতে ঘুমাইনি। সারা রাত ফ্রিল্যান্সিং শিখতাম। সকালে ফজরের নামাজ পড়িয়ে মসজিদের বাচ্চাদের পড়াতাম। এভাবেই শেষ হয় আমার ফ্রিল্যান্সিং শেখা। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সিলেটের বালাগঞ্জের তিলকচাপুর গ্রামের বিভিন্ন মসজিদে ইমামতি করেছেন রেদওয়ান।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয়ে বাড়ি : ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয়ের টাকায় ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছেন রেদওয়ান। ছোট ভাইকে পাঠিয়েছেন বিদেশে। সময় পেলেই নানা জায়গায় ঘুরতে বের হন। তাও ওই ফ্রিল্যান্সিয়ের আয়েই।
পাঁচটি টিপস : ফ্রিল্যান্সিংয়ে যারা ভালো করতে চান তাদের জন্য রেদওয়ান পাচটি টিপস দিয়েছেন। এক. দক্ষতা উন্নয়ন। নতুন ট্রেন্ড ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুন। প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে অনলাইন কোর্স, ভিডিও টিউটোরিয়াল বা বই পড়ুন। দুই. পোর্টফোলিও তৈরি। আপনার কাজের নমুনা নিয়ে একটি পোর্টফোলিও তৈরি করুন। এটি ক্লায়েন্টদের কাছে আপনার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রদর্শন করবে। তিন. নেটওয়ার্কিং। ফ্রিল্যান্সিং কমিউনিটিতে যুক্ত হন। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সদস্য হন। যেমন লিংকডইন, ফেসবুক গ্রুপ ইত্যাদি।
নেটওয়ার্কিং আপনাকে নতুন সুযোগ ও ক্লায়েন্টের সঙ্গে যুক্ত করতে সাহায্য করবে। চার. ক্লায়েন্টের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। তাদের প্রয়োজন বুঝুন এবং সময়মতো কাজ সম্পন্ন করুন। এটা তাদের বিশ্বাস অর্জনে সাহায্য করবে। পাঁচ. সময় ব্যবস্থাপনা। একটি সঠিক সময়সূচি তৈরি করুন এবং সেটি অনুসরণ করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।