জুমবাংলা ডেস্ক : মানুষ চাইলে সব কিছুই সম্ভব! ‘বিশ্বজগত দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’। কবির কল্পনা বাস্তবে রূপ দিয়ে মানুষ গড়েছে নানা কীর্তি। ঐতিহ্য আর কীর্তিতে সমৃদ্ধ পাবনা জেলা। এমন এক অনন্য কীর্তি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে সংযোগকারী দীর্ঘতম রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ঐতিহাসিক এই ব্রিজটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সেতুবন্ধন। এ ব্রিজ শত বছর পরেও পৃথিবীর প্রকৌশলীদের কাছে আজও বিস্ময়।
কবিগুরু বলেছিলেন,‘ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন/ আগে ওকে বারবার দেখেছি লালরঙের শাড়িতে/ দালিমের ফুলের মত রাঙা।’ রুপক অর্থে তিনি কি, শৈল্পিক কারুকার্যখচিত বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক লালরঙা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কথা বলেছেন?
পদ্মার বুকে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে স্ব-কীর্তিতে দাঁড়িয়ে আছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। পদ্মার ছিল ভরা যৌবন। খরস্রোতা জলরাশিতে ছিল উত্তাল ঢেউ। এখন যৌবন হারিয়ে বাংলার অমর কীর্তি হার্ডিঞ্জ ব্রিজকে বুকে ধারণ করে আজও শির উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যখন রেল সেতু ছিল না কবির কল্পনা ছন্দময় “ট্রেন তুমি তাড়াতাড়ি চলোনা/ ঘরে নববধূ আছে/ মনে মায়ামধু আছে/ পথ পানে চেয়ে আছে ললনা/ জানো, বড় অভিমানীও নারী/ হাত মুখ ধোবেনা/ জল তাও ছোবেনা/ কথা মতো যেতে যদি না পারি।”
তৎকালে বিবিধ সমস্যার কারণে, কলকাতার সঙ্গে অসম, ত্রিপুরাসহ উত্তরাঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ১৮৮৯ সালে সেতু তৈরির প্রস্তাব পেশ করে। ১৯০২-১৯০৫ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে প্রকল্প প্রণয়নের পরিকল্পনা। স্যার ফন্ডিস স্পিং প্রকল্প প্রণয়ন করেন। ১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণে মঞ্জুরি প্রদান করা হয়। ১৯০৯ সালে পদ্মা নদীর ওপর সার্ভে শুরু হয়। সেতু নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন প্রকৌশলী রবার্ট উইলিয়াম গেইলস। তিনি পুরো প্রকল্পটির নকশা প্রণয়ন করেন। আর ব্রিজের নকশা প্রণয়ন করেন প্রকৌশলী আলেকজান্ডার মেয়াডোস রেন্ডেল ।
এ ব্রিজ তৈরিতে সমস্যা ছিল নদী শাসন। প্রমত্তা পদ্মার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে সেতুর নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া। ১৯১০-১৯১১ সালের পুরোটা সময়জুড়ে শুধু বাঁধ নির্মাণ করা হয়। গেইলস বৃহদাকৃতির পাথর আর মাটি একত্রে নদীর পাড়ে ফেলতে থাকেন। দু-পাড়ের প্রায় পনেরো কিলোমিটারজুড়ে এভাবে বাঁধ দেন। সে বাঁধ এখনো অক্ষত আছে। একটা পাথরও খসে পড়েনি। সে সময় পাকশীতে ব্রিটিশ নাগরিকের জন্য গড়ে তোলা হয় বাংলো। রবার্ট উইলিয়াম গেইলসের ছিল একটি বড় বাংলো, যা এখনো টিকে আছে। সেখান থেকে তিনি দূরবীনের সাহায্যে নির্মাণকাজের গতিবিধি লক্ষ্য করতেন। এই ব্রিজ নির্মাণে ২৪ হাজার চারশ’ শ্রমিক-কর্মচারী অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। এদের অধিকাংশই ছিলেন বাঙালি।
ব্রিজ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল বেইন্্স ওয়ালটি অ্যান্ড ক্রিক। ১৯১২ সালে সেতু রক্ষাবাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। দুপাশে সেতু রক্ষাবাঁধের জন্য প্রয়োজনীয় মাটির পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি ঘনফুট। নদী নিয়ন্ত্রণে দরকার হয় তিন কোটি ৮৬ লাখ ঘনফুট। পাথরের প্রয়োজন হয় তিন কোটি ৮৮ লাখ ঘনফুট। ইটের গাঁথুনির কাজ হয় দুই লাখ ৯৯ হাজার টন। ইস্পাত ব্যবহার করা হয় এক লাখ ৭০ হাজার ড্রাম।
ব্রিজে রয়েছে ১৫টি মূল স্প্যান। প্রতিটি স্প্যানের ওজন এক হাজার দুশ’ ৫০ টন এবং দৈর্ঘ্য একশ’ ২০ মিটার। ১৫টি স্প্যান ছাড়াও দুই পাশে রয়েছে তিনটি করে মোট ছয়টি অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দৈর্ঘ্য ১.৮ কিলোমিটার। এর ওপরে রয়েছে দুইটি ব্রডগেজ রেল লাইন। পাশে পায়ে চলার সরু পথ আছে। তৎকালীন হিসাব অনুযায়ী ব্রিজ নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছিল তিন কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার একশ’ ৬৪ ভারতীয় রুপি।
সেই সময়ের হিসাব অনুযায়ী মূল স্প্যানের জন্য ব্যয় হয় এক কোটি ৮০ লাখ ৫৪ হাজার সাতশ’ ৯৬ রুপি। স্থাপনের জন্য পাঁচ লাখ ১৩ হাজার আটশ’ ৪৯ রুপি, নদী শাসনের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩৪৬ রুপি এবং দুই পাশের রেল লাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার একশ’ ৭৩ রুপি ব্যয় হয়।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক এ ব্রিজটি ১৯১৫ সালের ৪ মার্চে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তার নাম অনুসারে ব্রিজটির নামকরণ করা হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এই ব্রিজের ওপর দিয়ে যুদ্ধসরঞ্জামসহ সৈন্য পারাপার করত। ফলে ১৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ বিমান এই ব্রিজের ওপর বোমা ফেলে। এতে ব্রিজের ১২ নং স্প্যান ভেঙে পানিতে পড়ে যায়। ৯ ও ১৫ নং স্প্যান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকারের সাহায্যে মেরামত করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে পুনরায় ব্রিজটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ২০১৫ সালে ঐতিহ্যবাহী এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজের শতবর্ষ পূরণ হয়।
ঐতিহ্যের ধারক শৈল্পিক কারুকার্যখচিত এ ব্রিজ দর্শনার্থীদের এখনও মুগ্ধতায় আকৃষ্ট করে। ২০০৪ সালে পদ্মায় বিখ্যাত সুফি সাধক ফকির লালন শাহের নামানুসারে লালন শাহ সড়ক সেতু নির্মাণ করা হয়। পাশাপাশি পদ্মার বুকে ঐতিহ্যবাহী দুটি ব্রিজ এক অপরূপ সৌন্দর্য্যে মিলেমিশে রয়েছে। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অবলোকনের কৌতূহলে প্রতিদিন দেশী-বিদেশী পর্যটকরা ভিড় জমায় এখানে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।