জুমবাংলা ডেস্ক : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মহান সৃষ্টিকর্তা অত্যন্ত দক্ষ হাতে, সুনিপুনভাবে, অতি যত্নে পরম মমতা দিয়ে তাঁর সবচেয়ে উত্তম সৃষ্টি মানুষকে নিজের প্রতিমূর্তিতে ও সাদৃশ্যে গড়ে তুলেছেন।
পরিবারে মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর অসহায়তাবোধ চিরাচরিত নিয়মেই ঘটে এসেছে। একটি পরিবারে শিশু জন্ম হবার পর সে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। সন্তানকে লালন-পালন, ভরণ-পোষণ এবং পূর্ণাঙ্গ মানুষ রূপে গড়ে তোলার পিছনে যে অবদান বা ভূমিকা তা মা-বাবা পরিবারের আত্মীয়-স্বজনদের উপর বর্ষিত। সন্তানদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চাল-চলন সবই পরিবার থেকে আসে। পরিবারই হলো শিশুর মানবীয় গঠনের কেন্দ্র।
“এমন জীবন করিবে গঠন,
মরিলে হাসিবে তুমি,
কাঁদিবে ভবন।”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই দু’টি বাক্যে লুকিয়ে আছে মানব জীবনের চরম সত্য। শিশু পরিবার থেকে স্নেহ, ভালবাসা, শ্রদ্ধাভক্তি, সহভাগিতা, অন্যকে ক্ষমা করা, ধর্মীয় রীতি-নীতি ও মূল্যবোধ শিখে। মানবীয় গঠনের প্রধান ভিত্তি স্থাপিত হয় পরিবারে। পরিবারের শিক্ষাই সারা জীবন লালন-পালন করে। পিতা-মাতার মধ্য দিয়েই সন্তান শিক্ষা লাভ করে এবং সে মনোভাব নিয়ে বড় হয়ে ওঠে।
বর্তমানে পরিবার অনেক দিক দিয়েই হুমকির সম্মুখীন। সত্যিকারের পারিবারিক মূল্যবোধের ঘাটতি লক্ষ্য করা যায় এবং সে কারণে অনেক পরিবারের যে বাস্তব চিত্র তা আমাদের শঙ্কিত করে। সঠিক ও যথাযথ পারিবারিক মূল্যবোধে একটি পরিবার আদর্শ পরিবার হতে পারে।
পিতা-মাতা ছেলে মেয়েদের শিখাবেন সত্য কথা বলা, ভাল-মন্দ বিচার করে সত্যতা যাচাই, সহমর্মিতা, দয়া, ক্ষমা করা ও শান্তির মনোভাব। কিন্তু বর্তমান যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একদিকে মানুষকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সত্য, কিন্তু সেখানে যারা সচেতন নয় তারা সমস্যা, সংকট ও অশান্তির মধ্যে বসবাস করছে। সেজন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে এবং চর্চা করাতে হবে।
আজকাল ছেলে-মেয়েরা বেশির ভাগ সময়ই নিজেদের মতো চলতে চায়। অনেক সময় দেখা যায় শিক্ষকদের কথাও শুনতে বা মানতে চায় না। সেজন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে হবে। শুধু পুঁথিগত শিক্ষা নয়, তার পাশাপাশি পাঠ্যবই বা সিলেবাস-এর উর্ধ্বে গিয়ে Faith Formation, Value Foemation -এর উপর জোর দেয়া এবং সেই আদর্শে জীবন-যাপন করতে বিশেষ সহায়তা দেয়া ও শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকদের।
যে পরিবারে সঠিক মূল্যবোধের চর্চা ও পরিচর্যা হয় সে পবিরার দিনে দিনে একটি আদর্শ পরিবার হয়ে উঠে। বর্তমানে অনেক পরিবারেই পারিবারিক মূল্যবোধের ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। সে কারণে শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুল-কলেজগুলো বর্তমানে শঙ্কিত। যে পরিবারের সন্তানেরা মূল্যবোধগুলো যেমন ঃ শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালবাসা, সততা, বিশ^স্ততা, ধৈর্যশীলতা, ক্ষমা, সমর্থন, দায়িত্বশীলতা, পরিশ্রম, দয়া, করুণা, প্রশংসা, মার্জিতবোধ ইত্যাদি গুণাবলী অনুশীলন করে তারা জীবনে সফলতা লাভ করে।
পরিবারই হলো মূল্যবোধ চর্চার প্রথম জায়গা। প্রত্যেক শিশুই তার শৈশবকাল পেরিয়ে বৃহত্তর পরিসরে অবর্তীন হয়। একজন পরিপক্ক মানুষের পরিচয় তুলে ধরার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিস্তারের পাশপাশি তা পালন করা হয়। শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকদের।
উন্নত বিশে^র দেশগুলোতে শিক্ষা ব্যবস্থা ও ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে এক ধরনের সুন্দর সমন্বয় করে শিক্ষাদান করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সে অবস্থা নেই। দেশে বিদ্যমান পুরাতন শিক্ষা ব্যবস্থা এই মহৎ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা দিন দিন মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ একান্ত দারকার। তবে বর্তমান সরকার ২০২১ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণমূলক দলগত কাজের মাধ্যমে হাতে কলমে শিক্ষা অর্জন করছে। তাতে আমরা আশা করতে পারি শিক্ষার্থীরা সঠিক মূল্যবোধ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরিবার, সমাজ তথা দেশের জন্য সুনাগরিক হয়ে উঠবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক তার শিক্ষকতার দায়িত্ব ভালোভাবে পালন ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ উন্নয়নে ও প্রতিটি শিক্ষার্থীকে জানা বুঝা ও গুরুত্ব দেয়া অত্যন্ত দরকার। আমাদের সমাজে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তারা জীবন যাপন করছে ভিন্ন ভাবে। তাই শিক্ষককে মূল্যবোধের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধ বিকাশের জন্য সর্বাত্নক ভূমিকা রাখতে হবে।
সমাজের ঘুণে ধরা মূল্যবোধকে আবার শিক্ষকরাই পারে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগিয়ে তুলে সঠিক গঠন দিতে। স্কুল-কলেজে যখন কোন শিক্ষার্থী আসে প্রথমেই তারা চিন্তা করে গণিত, বিজ্ঞান, সমাজ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই বা অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা মূল্যবোধের বিষয়টি দেখি না। তাহলে কিভাবে শিক্ষার্থীরা ভাল-মন্দ বুঝতে পারবে কেন মূল্যবোধ প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের জন্য মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা কী ঃ-
* শিক্ষার্থীরা সুনাগরিক হয়ে পরিবার, সমাজ তথা দেশের জন্য ভাল আদর্শ উপহার দিবে।
* সমাজে দেখা যায় অন্যায্যতা, অসততা, দূর্নীতি, বিবাদ লেগেই রয়েছে যা শিক্ষার্থীদের মনেও প্রভাব ফেলে। সেক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি সঠিক ‘মূল্যবোধ’ শিক্ষা দেওয়া হয় তবে শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান করতে পারবে।
* মূল্যবোধ জীবনকে সুন্দর করে এবং সেই ব্যক্তি যেখানেই যায় সেখানে শ্রদ্ধা-সম্মান লাভ করে।
শিক্ষা, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক – এই তিনটির মধ্যেই রয়েছে। নিবিড় সম্পর্ক। শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একজন শিক্ষকউ হলেন মূল্যবোধ গঠনের আদর্শ কারিগর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ চর্চা করার উত্তম স্থান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাল-মন্দ, বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ, সততা, সমাজসেবা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, দায়িত্বশীলতা প্রভৃতি শিক্ষা দিয়ে থাকে। একটি সুস্থ সুন্দর ও উপযোগী সমাজ তথা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মূল্যবোধের কোনো বিকল্প নেই। পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র পরিচালনায় মূল্যবোধের অনুপস্থিতি আশা করা যায় না।
আজ শিক্ষার্থীরা যা কিছু পরিবারে করে তাই করার চেষ্টা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের সঠিকভাবে শিখাতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধ যা ভবিষ্যতে যেখানেই থাকুক না কেন সে হবে নীতিবান, আদর্শবান এবং সেখান থেকেই সে অন্যকেও মূল্যবোধ গঠনে অনুপ্রাণিত করবে। শিক্ষার্থীরা মা-বাবার কথা না শুনলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কথা শুনে। মা-বাবার পর ছেলে-মেয়েরা শিক্ষকদেরই তাদের জীবনপথের কান্ডারী হিসেবে বিবেচনা করে। মূল্যবোধের প্রতি শিক্ষার্থীদের যত্নবান হতে হবে এবং শ্রেণিকক্ষসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল্যবোধ বিকাশের জন্য ভূমিকা রাখতে হবে। তবেই আমরা পাব উন্নত সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি।
পরিশেষে বলতে চাই, I can make different. নিজে শুরু করি। তাহলেই আমরা পিতা-মাতা ও শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে গড়ে তুলব একটি নতুন পৃথিবী। আমাদের সন্তানেরা হয়ে উঠবে একজন মূল্যবোধ সম্পন্ন, দূর্নীতিমুক্ত, আদর্শবান, আলোকিত সুনাগরিক।।
লেখিকা: সিঃ মেবেল কস্তা আর.এন.ডি.এম, অধ্যক্ষ
সেন্ট ইউফ্রেজীস্ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।