জুমবাংলা ডেস্ক : বছরের শেষ দিকে এসে জাপান থেকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির হিড়িক পড়েছে। দেশে বিরাজিত ডলার সংকটে এলসি খোলা নিয়ে ব্যাংকগুলো কড়াকড়ি করলেও কয়েক কোটি ডলারের গাড়ি আমদানি নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। এলসি না করেও গত বছরের মতো এবারও গাড়ির বিশাল চালান চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। গাড়ির ওভার ইনভয়েসিং করেও কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হচ্ছে, যা গাড়ির শুল্ক ফাঁকিসহ নানাভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। একই ব্যক্তি রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারকের ভূমিকা থাকার মতো তথ্যও পাওয়া গেছে। বেশ কিছুদিন ধরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। ইউক্রেন–রাশিয়া ও ফিলিস্তিন–ইসরায়েল যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ডলার সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। রিজার্ভের পরিমাণও ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। সংকটের শুরু থেকে আমদানি নিরুৎসাহিত করার প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন ব্যাংক শুধুমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলে। বিলাসদ্রব্যের এলসি খোলা প্রায় বন্ধ রাখে।
গাড়ি বিলাস সামগ্রী না হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় নয় বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, এই কারণে সংকটের শুরু থেকে গাড়ি আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হয়। গাড়ি আমদানির জন্য এলসি খোলার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করে ব্যাংক। শতভাগ মার্জিন দিয়েও এলসি খুলতে সমর্থ হননি অনেক আমদানিকারক। গাড়ি আমদানি কমানোর জন্য সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। ২০২২ সালে দেশে প্রায় ১৯ হাজার রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করা হয়েছিল। চলতি বছর আমদানি কমাতে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সফল হয়নি। এ বছর রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির পরিমাণ ১৮ হাজার ইউনিট ছাড়িয়ে যাবে।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৫ বছরের বেশি পুরনো রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করা যায় না। ৫ দিন পর বন্ধ হয়ে যাবে ২০১৮ মডেলের গাড়ি আমদানি। কিন্তু বছরের শেষ পর্যায়ে এসে ২০১৮ মডেলের প্রায় তিন হাজার গাড়ি নিয়ে দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম ও মোংলার পথ ধরার প্রস্তুতি নিয়েছে। ৩১ ডিসেম্বরের আগে জাহাজ দুটি জাপানের বন্দর ত্যাগ না করলে এগুলো আর বাংলাদেশের কোনো বন্দরে প্রবেশ করতে পারবে না।
ডলার নিয়ে কড়াকড়ি হলেও দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে এসব গাড়ির জন্য অন্তত সাড়ে ৩ কোটি ডলারের যোগানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব গাড়ির প্রতিটির মূল্য গড়ে ১২ হাজার ডলার করে ধরলেও দুই জাহাজ গাড়ির দাম পড়ছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ডলার, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বিদ্যমান রিজার্ভের জন্য বড় অংক বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম ও মোংলার জন্য জাহাজিকরণ করা গাড়িগুলোর অনেকগুলোর এলসি করা হয়নি। ইতোমধ্যে ৪৫৮টি গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রামে আসা অপর একটি জাহাজের অধিকাংশ গাড়ি এলসিবিহীন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে আমদানিকারকদের দাবি, শতভাগ মার্জিন দিয়ে এলসি করে গাড়ি আমদানি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সতর্ক আছে। তারা বলেছে, গাড়ি খালাস করতে এলে এগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাবে। তবে এলসিবিহীন কোনো গাড়ি বন্দর থেকে খালাসের সুযোগ নেই। গত বছরের নভেম্বরেও এক জাহাজ এলসিবিহীন গাড়ি আনা হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। যা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আটকে দিলে পরে ৪ ও ৬ শতাংশ হারে জরিমানা প্রদান করে খালাস করেন আমদানিকারকরা। গত বছরের মতো এবারও আমদানিকারকদের একটি সিন্ডিকেট একই পথ অবলম্বন করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শুধু এলসিবিহীন নয়, যেসব গাড়ি এলসি করে আনা হচ্ছে সেগুলোর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা জাপানে পাচার করা হচ্ছে জানিয়ে সূত্র বলেছে, জাপান থেকে রপ্তানিকারক এবং দেশের আমদানিকারক একই ব্যক্তি হওয়ায় মুদ্রা পাচারের সুবিধা নেওয়া হচ্ছে। একটি হাইব্রিড ফিল্ডার ও এঙিও গাড়ির এলসি খোলা হচ্ছে ১২ হাজার ডলার দর দেখিয়ে। অথচ চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যে গাড়িগুলো জাহাজিকরণ করা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে জাপানে ফিল্ডার রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বর্তমান দাম চার–পাঁচ হাজার ডলার। জাপানে একটি এঙিও গাড়ির দাম ছয় হাজার ডলার। প্রতিটি গাড়ির মাধ্যমে ৫ থেকে ৬ হাজার ডলার পাচার করার এই পন্থা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সূত্র বলেছে, গাড়ির শুল্কায়ন হয় ইয়েলো বুকের মাধ্যমে। ইয়েলো বুক কিংবা ইনভয়েজ ভ্যালুর মধ্যে যেটি বেশি সেটির ওপরই ট্যাঙ নেওয়া হয়। ইয়েলো বুক অনুসরণে ফিল্ডার এবং এঙিও গাড়ি ১২ হাজার ডলারের কম দর দেখিয়ে শুল্কায়নের সুযোগ নেই। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে শত কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচারকৃত টাকা বড় গাড়ির শুল্ক ফাঁকিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি প্রাডো জিপের বাজারমূল্য ৪০ থেকে ৪৫ হাজার ডলার। অথচ তারা ইনভয়েস তৈরি করে ২৫ হাজার ডলারে। অর্থাৎ প্রাডো জিপ ২৫ হাজার ডলারে ইনভয়েস করে বাকি ডলার ফিল্ডার কিংবা এঙিওতে ওভার ইনভয়েস বানানো ডলার থেকে পরিশোধ করা হচ্ছে। যার কোনো শুল্ক দিতে হচ্ছে না। এই গোঁজামিলের কারণে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
ট্রেনিং করতে জাপানে গিয়ে গা ঢাকা দেওয়া বিআরটিএর সাবেক এক কর্মচারী এবং বহদ্দারহাট এইট মার্ডারের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জাপানে থেকে গাড়ি রপ্তানির বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, তারা ওদেশ থেকে রপ্তানি করে আবার এদেশে আমদানিকারক হিসেবে কাজ করে। রপ্তানি ও আমদানি একই হাতে হওয়ায় শুল্ক ফাঁকি দেওয়া সহজ হবে। দুই ব্যবসায়ীর নেতৃত্বাধীন একটি চক্র চট্টগ্রামে সক্রিয় বলে জানা গেছে।
এলসিবিহীন গাড়ির ব্যাপারে চট্টগ্রাম কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গাড়ি শুল্কায়ন করতে না আসা পর্যন্ত এলসির ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়া যাবে না। তবে এলসিবিহীন কোনো গাড়ি শুল্কায়নের সুযোগ নেই। গত বছর এলসিবিহীন গাড়ি আসার কথা স্বীকার করে কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেন, ওগুলো থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছিল।
শুল্ক ফাঁকির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট একজন কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা সবসময় করা হয়। আমরা সতর্ক থাকি। এরপরও ফাঁকি দিচ্ছে না সেটি বলা যাবে না। গেটকিপার হিসেবে ফাঁকি ঠেকানোর জন্য কাস্টমস নিরন্তর চেষ্টা করছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।