জুমবাংলা ডেস্ক : চাঁপাইনবাবগঞ্জে সমাজসেবা অধিদপ্তরে চাকরি দেওয়ার নামে অন্তত ১৫-২০ জনের কাছ থেকে ১ থেকে ৫ লাখ করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে টিকটকার গৃহবধূ ফুলেরা বেগমের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সরকারি ভাতা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার নামে অর্ধশত নারীর কাছ থেকে ২ থেকে ৭ হাজার করে টাকা নিয়েছেন। কিন্তু টাকা নিয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি পূরণ না করায় আজ শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ফুলেরা বেগমের বাড়ি ঘেরাও করেন কয়েকজন ভুক্তভোগী নারী।
টিকটকার গৃহবধূ ফুলেরা বেগম টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘কোনো সার্কুলার দেখার প্রয়োজন নেই। অফিসের সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পর্ক। পদ ভেদে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা অগ্রিম লাগবে। চাকরির নিয়োগপত্র পাওয়ার আগেই নেওয়া টাকার বিনিময়ে আমি দেব একটি ফাঁকা চেক।’
শুক্রবার ভুক্তভোগী নারীরা বাড়িতে গেলে দরজা লাগিয়ে দেন ফুলেরা বেগম। এতে ভুক্তভোগীরা উত্তেজিত হয়ে বাড়ি ঘেরাও দেন। তখন ফুলেরা বেগম উল্টো ভুক্তভোগীদের নানারকম ভয়ভীতি ও হুমকি দেন। সেখানে সংবাদ সংগ্রহে গেলে স্থানীয় সাংবাদিক জাহিদ হাসানের ওপর হামলা করে ফুলেরা বেগমের ছেলে-মেয়েরা। এ সময় গুরুতর আহত হন জাহিদ হাসান। পরে পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এ সময় দুটি দেশীয় অস্ত্র হাতুড়ি ও শাবল উদ্ধার করা হয়।
ফুলেরা বেগম চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বারোঘরিয়া বাগানপাড়া গ্রামের মো. বাবুর স্ত্রী। তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরে পিয়ন পদে চাকরি করেন বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তবে সমাজসেবা অধিদপ্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ফুলেরা নামের কেউ চাকরি করেন না। তবে তাঁকে নিয়মিত টিকটক ভিডিও করতে দেখা যায়। তাঁর স্বামী কি করেন তাও বলতে পারেন না কেউ। ফুলেরা বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, প্রতিবন্ধী, মাতৃত্বকালীন ভাতা, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর ও সমাজসেবায় বিভিন্ন সরকারি প্রশিক্ষণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কয়েকশ নারীর কাছ থেকে ২ হাজার থেকে ৭ হাজার করে টাকা নিয়েছেন।
কয়েকজন নারী-পুরুষকে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ভাতার কার্ডও করে দিয়েছেন তিনি। এমনকি ১৫-২০ জনকে কার্ড করে দিতে না পেরে টাকা ফেরত দিয়েছেন। তবে এখনো অনেকেই এ বাবদ টাকা পাবেন তাঁর কাছে। টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ফুলেরা বেগম।
সমাজসেবা অধিদপ্তরে চাকরি আশ্বাসে যাঁদের কাছ থেকে ফুলেরা বেগম টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তাঁরা হলেন—বারোঘরিয়া গ্রামের মাসুদ আলীর স্ত্রী মোসা. সায়েমা বেগম (৫ লাখ টাকা), নুরুন্নাহার (৩ লাখ টাকা), আব্দুল করিমের স্ত্রী খাতিজা খাতুন (২ লাখ টাকা), শফিকুল ইসলামের স্ত্রী শিরিন খাতুনসহ (১ লাখ টাকা) এলাকার আরও অনেকে। গ্রামের বিভিন্ন নারীদের সমাজসেবা অধিদপ্তরে চাকরি দেওয়ার কথা বলে অগ্রিম টাকা নেওয়ার পর দীর্ঘ দুই বছর পেরিয়ে গেলে টাকা ফেরত নেওয়ার দাবি জানান চাকরি প্রার্থীরা।
চাকরি প্রত্যাশী, স্থানীয় বাসিন্দা ও ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জানা গেছে, টাকা আদান-প্রদানের বিষয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে ইউনিয়ন পরিষদে সালিসে বসলেও সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন ফুলেরা বেগম। পরে থানায় অভিযোগ করলেও কোনো সমাধান পাননি ভুক্তভোগীরা। এ নিয়ে বারোঘরিয়া গ্রামের মাসুদ আলীর স্ত্রী মোসা. সায়েমা বেগম বাদী হয়ে আদালতে একটি চেক জালিয়াতির মামলা দায়ের করেছেন।
চাকরি প্রত্যাশী সায়েমা বেগম বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে গত বছরের নভেম্বর মাসে ৫ লাখ টাকা নেয় ফুলেরা বেগম। দুইবারে ২ ও ৩ লাখ মিলে মোট ৫ লাখ টাকা নেয়। বিনিময়ে অগ্রণী ব্যাংকের একটি ফাঁকা চেক দিয়েছে। টাকা নেওয়ার সময় ফুলেরা বেগম বলেছিলেন, ‘এর আগে কয়েকজনকে চাকরি নিয়ে দিয়েছি, আপনারটাও করে দেব।’
সায়েমা আরও বলেন, ‘সে (ফুলেরা বেগম) সমাজসেবা অধিদপ্তরে পিয়ন পদে চাকরি করে বলে পরিচয় দেয়। টাকা নেওয়ার পর দেব, দিচ্ছি করে করে দুই বছর পেরিয়ে গেলে সবাই মিলে তাঁকে টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য ধরি। কিন্তু কাকে টাকা দিয়েছে, কখন ফেরত দিবে, কিছুই বলছে না। আমি ঋণ করে টাকা দিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ ও থানায় অভিযোগ দিয়েও কোনো সুরাহা না পেয়ে আদালতে চেক জালিয়াতির মামলা দায়ের করেছি।’
২ লাখ টাকা দেওয়া আব্দুল করিমের স্ত্রী খাতিজা খাতুন বলেন, ‘পাড়ার মানুষ বলে বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছি। টাকা নেওয়ার পর রাজশাহী ও গোদাগাড়ীতে প্রশিক্ষণ করাব বলে দীর্ঘদিন ঘুরিয়েছে। কিন্তু শুধু আমাকেই না, অনেককেই এভাবে মিথ্যা বলেছে। চাকরি প্রত্যাশীরা সবাই মিলে চাপ দিলে পরে স্বীকার করে ও টাকা ফেরত দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। সবার কাছে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য সময় নিয়েছে, কিন্তু তাও দিচ্ছে না।’
একই এলাকার শিরিন খাতুন বলেন, ‘টাকা লেনদেনের বিষয়ে তাঁর স্বামী-শ্বশুরকে অভিযোগ দিতে গেলে তাঁরা বলে, টাকা দেওয়ার সময় আমাদের বলে দেননি। অতএব, এসব বিষয়ে আমাদের বলে লাভ নাই। আমার নিজের চাকরির টাকা ছাড়াও এলাকার আরও কয়েকজনের কাছ থেকে বয়স্ক, বিধবা ভাতার কার্ড বাবদ ১২ হাজার টাকা ফুলেরাকে দিয়েছি। কার্ড না হওয়ায় এসব টাকাও আমাকে শোধ করতে হয়েছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মালেক জানান, ‘এলাকার অনেকের কাছ থেকেই বিভিন্ন ভাতার কার্ড করে দেব বলে ফুলেরা টাকা নিয়েছে। কয়েকজনের ফেরত দিয়েছে, এখনো আরও অনেকেই টাকা পাবে। প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু মানুষজন তার বাসার সামনে এসে বসে থাকে টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য।’
অভিযুক্ত ফুলেরা বেগম সমাজসেবা অধিদপ্তরে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, ‘এর আগেও এলাকার অনেকের বিভিন্ন ভাতার কার্ড করে দিয়েছি। আরও করে দেওয়ার জন্য কাগজপত্র ও টাকা নিয়েছিলাম। কিন্তু যাদের হয়নি, তাঁদের টাকা ফেরত দিয়েছি।’
চাকরি দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক ম্যাডামের মাধ্যমে এসব টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু চাকরি হয়নি, টাকাগুলো ফেরত দেব। তবে একটু সময় লাগবে।’ ম্যাডামের পরিচয় জানতে চাইলে এ বিষয়ে কথা বলবেন না বলে জানান তিনি।
বারোঘরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আবুল খায়ের জানান, ফুলেরার বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সালিস আহ্বান করা হলেও তিনি উপস্থিত হননি। পরে এ নিয়ে আদালতে একটি মামলা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুব জানান, ‘উত্তেজনাকর পরিস্থিতির খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ভুক্তভোগীদের আগামীকাল শনিবার দুপুর ১২টায় থানায় উপস্থিত হয়ে লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে ভুক্তভোগীদের দাবি, গত কয়েক দিন আগেই ফুলেরা বেগমের নামে থানায় একটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে এ নিয়ে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এ ছাড়া আদালতে চেক জালিয়াতির একটি মামলা চলমান রয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক উম্মে কুলসুম মোবাইল ফোনে বলেন, ‘ফুলেরা নামের কোনো মহিলা সমাজসেবা অধিদপ্তরে চাকরি করে না। এমনকি এই নামের কোনো মহিলাকে চিনি না। এ ছাড়া ভাতার কার্ডে টাকা লেনদেনের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি চাকরি দেওয়ার নামে টাকা আদায়ের পর প্রতারণার বিষয়ে কিছু জানা নেই। আমাদের অফিসের কেউ জড়িত থাকলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব।’ সূত্র : আজকের পত্রিকা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।