আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারত ও পাকিস্তান কেউই যেন কাউকে দেখতে পারে না। তাদের সম্পর্কটা এরকমই সাপে-নেউলে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা দু’দেশের চিরবৈরী মনোভাবকে আরও উসকে দিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে পাকিস্তানিদের জন্য সব ধরনের ভিসা স্থগিত, সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিতসহ একাধিক পদক্ষেপ দিয়েছে ভারত।
Table of Contents
এখন প্রশ্ন উঠেছে, ভারত কি সত্যিই পাকিস্তানে প্রবাহিত সিন্ধু ও এর দুটি শাখা নদ-নদীর পানি আটকে দিতে পারবে? বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন।
জানা গেছে, ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তান এই চুক্তি করে। এরপর পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুটি দুবার যুদ্ধে জড়ালেও চুক্তিটি স্থগিত হয়নি। তাই এতদিন আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনার এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে এই চুক্তি।
তবে সাম্প্রতিক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে ইসলামাবাদও পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, পানি প্রবাহ বন্ধ করা হলে সেটিকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ হিসেবে দেখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জবাবও দেওয়া হবে।
সিন্ধু চুক্তির শর্ত কী বলে?
চুক্তির আওতায় রয়েছে সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদী। এরমধ্যে ভারতের অংশে পূর্বাঞ্চলীয় রাভি (ইরাবতী নদী), বিয়াস ও সুতলেজ (শতদ্রু) নদী পড়েছে। আর পশ্চিম অববাহিকার সিন্ধু, ঝেলাম ও চেনাব নদীর ৮০ শতাংশ পড়েছে পাকিস্তানের ভাগে।
চুক্তি অনুসারে, ভারত সীমিত পরিসরে এই পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর পানি ব্যবহার করতে পারে, তবে বড় প্রকল্প নেওয়ার আগে পাকিস্তানের সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এখন ভারত বলছে, তারা আর এই তথ্য বিনিময়ের নিয়ম মানবে না।
ভারতের পক্ষে পানি আটকানো কতটা সম্ভব?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভরা মৌসুমে পাকিস্তানের অংশের পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর হাজার হাজার কোটি ঘনমিটার পানি ধরে রাখা ভারতের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এত বিশাল পরিমাণ পানি ধরে রাখার মতো অবকাঠামো কিংবা পানি সরিয়ে নেওয়ার মতো বিস্তৃত খালেরও অভাব রয়েছে ভারতের।
‘সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভার্স অ্যান্ড পিপল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক পানিসম্পদ–বিশেষজ্ঞ হিমাংশু ঠক্কর বলেন, ভারতের যে অবকাঠামো আছে, তার বেশির ভাগই বাঁধভিত্তিক পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প, যেখানে বড় ধরনের জলাধারের প্রয়োজন হয় না।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের পানিবিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রবাহিত পানির শক্তিকে ব্যবহার করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ জন্য বেশি পরিমাণে পানি আটকানোর প্রয়োজন হয় না।
এই পানিসম্পদ–বিশেষজ্ঞ বলেন, চুক্তি স্থগিতের কারণে অতীতের মতো এখন আর ভারতকে কোনো প্রকল্পের নথি পাকিস্তানকে দেখাতে হবে না। কিন্তু জটিল ভূপ্রকৃতি ও ভারতের কিছু প্রকল্পের বিরুদ্ধে দেশটিতে প্রতিবাদের মতো কিছু চ্যালেঞ্জের কারণে এসব নদীর পানি ব্যবহারে নতুন অবকাঠামো নির্মাণে তেমন গতি আসেনি।
নিজ দেশেই বিমান হামলা চালাল ভারত
ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকার কারণে চুক্তি অনুযায়ী ঝেলাম, চেনাব ও সিন্ধু নদ–নদীর ২০ শতাংশ পানিরও যথাযথ ব্যবহার করতে পারছে না ভারত। এই যুক্তি তুলে ধরেই ভারত পানি ধরে রাখার জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করতে চেয়েছিল। তবে পাকিস্তান চুক্তির শর্ত উল্লেখ করে এর বিরোধিতা করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত এখন বিদ্যমান অবকাঠামোর পরিবর্তন করে বা নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে পাকিস্তানকে না জানিয়েই বেশি পানি আটকাতে বা সরিয়ে নিতে পারবে।
এ অবস্থায় ভারত যদি তার বিদ্যমান ও সম্ভাব্য অবকাঠামো দিয়ে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তাহলে শুষ্ক মৌসুমে যখন নদীতে পানি একেবারে কমে যায়, পাকিস্তান তখন এর প্রভাবটা বুঝতে পারবে বলেও মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
টাফট্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নীতি ও পরিবেশ গবেষণা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাসান এফ খান পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডন–এ লিখেছেন, আরেকটি জরুরি উদ্বেগের বিষয় হলো, শুষ্ক মৌসুমে যখন অববাহিকাজুড়ে পানিপ্রবাহ কমে যায়, পানি ধরে রাখা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং সময়মতো প্রবাহ অধিকতর জরুরি হয়ে পড়ে, তখন কী ঘটবে? এ সময় চুক্তিতে থাকা বিধিনিষেধের অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি অনুভূত হবে।
পানি কি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারযোগ্য?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পানি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক কৌশল। ভারতের বাঁধগুলো সীমান্ত থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। হঠাৎ করে পানি ছাড়া হলে ভারতের নিজস্ব এলাকাই প্লাবনের ঝুঁকিতে পড়বে। যদিও পলি বা সিল্ট ছেড়ে দিলে পাকিস্তানের নিম্নভাগে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির প্রভাব
সিন্ধু নদের উৎপত্তি তিব্বতে, যা চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে ভারত যদি এই নদের পানি ব্যবস্থাপনায় কঠোর পদক্ষেপ নেয়, তাহলে চীনও ব্রহ্মপুত্র নদ (যা ভারতে যমুনা নামে প্রবাহিত) নিয়ে পাল্টা কৌশল নিতে পারে, যেমনটি ২০১৬ সালে ঘটেছিল।
পরিস্থিতি বলছে, ভারতের পক্ষে এখনই সরাসরি সিন্ধুর পানি বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে চুক্তির শর্তে ধীরে ধীরে পরিবর্তন এনে ও কৌশলগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভারতের পক্ষে কিছুটা চাপ প্রয়োগ সম্ভব। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া এবং এতে ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়া অবধারিত।
প্রসঙ্গত, গত ২২ এপ্রিল ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা পেহেলগামে ভয়াবহ এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ২৬ পর্যটক হারান। এরপর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।