মেহেদী হাসান : “আসন্ন কোরবানির ঈদে ভারত থেকে কোন পশু আমদানি হবে না। দেশে উৎপাদিত পশু দিয়ে কোরবানি সম্পন্ন হবে। যাতে দেশের খামারিরা লাভবান হতে পারে।” প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এ ঘোষণা দেওয়ার পর খুশি হয়েছিলেন দেশের খামারি ও কৃষকরা। তবে, ঘোষণাকে কাঁচকলা দেখিয়ে ভারতীয় গরু-মহিষে সয়লাব হয়ে গেছে রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পশু বিক্রির হাট “রাজশাহী সিটি হাট”।
কোরবানির মাসখানেক আগে থেকেই পশু আসতে শুরু করে এই হাটে। গত সপ্তাহ থেকে প্রতিদিনই হাটে বাড়ছে গরু মহিষের সংখ্যা তবে, দেশী নয় ভারতীয়! গতকাল রোববার (১২ জুন ২০২২) বেলা ১২ টার দিকে রাজশাহীর সিটি পশু হাটে গিয়ে দেখা যায়; হাটে দেশীয় গরুর সাথে সাথে ভারতীয় সাদা গরুর দখলে পুরো হাট। হাটের উত্তর-পশ্চিম অংশের পুরোটা জুড়ে ভারতীয় গরু-মহিষ। কিন্তু পশু আমদানির তুলনায় ক্রেতা তেমন নজরে আসেনি। দাম তুলনামূলক গতবারের চেয়ে পাঁচ-দশ হাজার টাকা বেশি বলে জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর থেকে দুটো গরু নিয়ে হাটে এসেছেন আইনাল হক। গরুর দাম জিজ্ঞাসা করতেই চটে গেলেন রীতিমতো। ক্ষোভের কারণ জানতে চাইলে বলেন, “আমার দুটো গরুর দাম বলছে ১ লাখ ৪০ হাজার। ৭০ হাজার করে ৩ মণ ওজনের গরু বিক্রি করলে কোন লাভ থাকবেনা। হাটে ক্রেতা নাই। তারপরে হাটের ওদিকে তাকিয়ে দেখেন কতো ভারতীয় গরু। হয়ত ভালো দামেই বিক্রি করতে পারতাম গরুদুটো কিন্তু হয়ত আর হবেনা।”
নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার মালশিরা থেকে একটা গরু নিয়ে বিক্রি উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে আছেন মকবুল হোসেন। বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার এ গরুর ওজন হবে ৩ মণ ১০ সের। দাম বলছে ৭২ হাজার। ৮০ হাজারের কম বিক্রি করলে লাভ হবে না। ভারতীয় গরু যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ঈদের আগে গরুর দাম বাড়বে। কিন্তু মাসখানেক আগে থেকেই হাট ভরে গেছে সাদা গরুতে।”
ভারতীয় গরুর লটে (১০ টি-১৫ টি করে গরু বিক্রির অস্থায়ী স্থান) গিয়ে দেখা যায় সিলেট থেকে এসেছেন গোলাপ মিঞা। হাটে ভারতীয় গরু কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা কিনে নিয়ে হাটে এসেছি। এগুলো দেশের গরু। বাইরের গরু হতে যাবে কেন?”। কিন্ত এই বিক্রেতার সবগুলো গরুতে ক্রস চিহ্ন দেওয়া। জাত ও আকার দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায় ভারতীয় গরু।
আমদানি করা বাইরের গরুর তুলনায় বাজারে দেশি গরুর একটু বেশিই দাম। চাহিদা তেমন নেই। কোরবানির জন্য সাধারণ ক্রেতারা গরু কিনতে শুরু করেননি। আড়াই থেকে ৩ মণ ওজনের গরুর কাটতি ভালো। বিক্রি হচ্ছে এই ধরণের মাঝারি গরু। ৩ মণ ওজনের একটা হৃষ্টপুষ্ট গরু বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকায়।
ভারতীয় ৮ থেকে ৯ মণ ওজনের গরুর দাম জানা যায় ১ লাখ ৭০ হাজার। বিক্রেতারা বলছেন, ৮ মণ ওজনের একটা গরু দুই লাখের কাছাকাছি ছাড়া বিক্রি করবেন না।
অন্যদিকে স্থানীয় বিক্রেতা ও খামারিরা বলছেন, গরুর খাবারের দাম অনেক বেড়ে গেছে। বড় অংকের টাকা খাবার ও চিকিৎসায় খরচ হয়েছে। তাই ভালো দাম না পেলে গরু বিক্রি করলে লোকসান হবে। প্রতিবছর ভারতীয় গরু-মহিষ আমদানি হয় গোপনে। বর্ডার দিয়ে যদি না আসে তাহলে গরু উড়ে আসেনা। সরকারের উচিত এসব বিষয়ে নজর দেওয়া। খামারিদের স্বপ্ন ভঙ্গ করে ব্যবসায়ীদের লাভবান হতে দেওয়া যাবে না।
বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিভাগে কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে ২০ লাখ ১০ হাজার ৫৬৮টি। রাজশাহীর আট জেলায় এক লাখ ৬৪ হাজার ৬১৯ জন খামারির ২৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৬০টি কোরবানির পশু রয়েছে। ফলে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত রয়েছে প্রায় ৭ লাখ কোরবানির পশু। রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার ১৩ লাখ ৫৩ হাজার টি ছাগল রয়েছে। ভেড়া রয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৪৯টি। এছাড়া গরু-মহিষ রয়েছে ১১ লাখ ৪৮ হাজার ৯০৩টি।
রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য বলছে- জেলায় মোট চাহিদা রয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১৮টি পশু। চাহিদার বিপরীতে কোরবানির জন্য মোট পশু প্রস্তুত হয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৮৫২টি। অর্থাৎ প্রায় ১০ হাজার ৭৩৪টি গরু বেশি রয়েছে। রাজশাহী জেলার নয় উপজেলায় ১৬ হাজার ৭৯ জন খামারি রয়েছেন। তাদের কাছে কোরবানির জন্য ১ লাখ ২১ হাজার ৩৭২টি গরু, ২ লাখ ৩৩ হাজার ২৩৫টি ছাগল, ৩৮ হাজার ২৪৫টি ভেড়া আছে। এছাড়া মহিষ রয়েছে ৩ হাজার ২১১টি।
রাজশাহী সিটি হাটের মালিক মো: কালু বলেন, “ হাটে ভারতীয় গরু নেই। বর্ডারে কঠোর নিরাপত্তা রয়েছে। সুঁচ পার হতে দিচ্ছে না, আর তো গরু। গতবারের তুলনায় গরুর দাম বেশি। খামারিরা লাভবান হতে পারবেন বলে আশা করছি।”
ভারত থেকে গরু আসার ফলে দেশের বাজারে কি প্রভাব পড়তে পারে জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, “প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বাইরের কোন গরু-মহিষ আমদানি হবেনা। যাতে দেশের খামারিরা তাদের উৎপাদিত পশুর দাম পান। ভারতীয় গরু আসলে তো দাম কমে যাবে। আমদানি বন্ধে সরকারিভাবে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কে সচেষ্ট দায়িত্ব পালন করতে বলেছে সরকার। এরপরও যদি ভারতীয় গরু দেশের ভেতরে আমদানি হয় তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রাণিসম্পদ দপ্তর সবসময় দেশের খামারিদের পাশে আছে।”
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ জুলফিকার আখতার হোসেন বলেন, ভারতীয় গরু রাজশাহীর সিটি হাটে আসার খবর পাইনি। যদি কোনভাবে ভারতীয় গরু রাজশাহীর বর্ডার দিয়ে আমদানির চেষ্টা করা হয় তাহলে বিজিবি বিষয়টি দেখবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, “কোরবানির জন্য পর্যাপ্ত পশু মজুত আছে, তাই এ বছরও কোরবানিতে বাইরের দেশ থেকে একটি পশুও আসবে না। আমাদের যে পরিমাণ পশু উৎপাদন হচ্ছে সেটি চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থাকবে।”
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহাজাদা বলেন, চলতি বছর কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে ১ কোটি ২১ লাখের বেশি, যা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত। ধারণা করছি গতবারের তুলনায় এবার কোরবানি বেশি হবে। চলতি বছর ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ২ লাখ ৭ হাজার বেশি। দেশীয় পশুতে চাহিদা পূরণ হওয়ায় দেশের বাইরে থেকে গরু আনা বন্ধে কঠোর অবস্থানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সূত্র : এগ্রিকেয়ার২৪.কম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।