অমিতাভ ভট্টশালী, বিবিসি : হিন্দু বিধবা বললেই হয়তো সাদা কাপড় পরা গয়নাগাঁটিহীন, কিছুটা রুগ্ন চেহারার নারীদের কথা মনে পড়ে। কিন্তু তার বদল ঘটতে চলেছে ভারতের মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলার একটি গ্রামে। জেলার হেরওয়ার গ্রামে স্থানীয় বিধবাদের এখন থেকে প্রচলিত কঠোর রীতি-নীতি মানতে হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিধবারা দ্বিতীয় বিয়ে যেমন করতে পারবেন, তেমনই রঙ্গিন পোষাক পরা বা সাজগোজ করায় আর কোনও বাধা থাকবে না।
বিধবাদের নিয়ে কী কী সিদ্ধান্ত নিল মহারাষ্ট্রের এই গ্রাম?
হেরওয়ার গ্রাম পঞ্চায়েত ঠিক করেছে যে এখন থেকে গ্রামের কোনও বিধবা নারীর দ্বিতীয়বার বিয়েতে কোনও বাধা থাকবে না। বিধবারা গলায় হার বা কপালে টিপ বা হাতে চুড়ি যেমন পরতে পারবেন, তেমনই রঙিন পোশাক পরবেন, আর তাদেরকে কোনও শুভ অনুষ্ঠান থেকে দূরে রাখা হবে না।
গ্রামের বাসিন্দা এক নারী বৈশালী পাটিল নবছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, “স্বামী মারা যাওয়ার পরে বিশেষ করে যখন কোনও কাজে বাইরে বেরতে হয়, সেটাই সবথেকে কষ্টের সময়। পোশাক পরিচ্ছদ বেছে নেওয়া থেকে শুরু করে পুরুষমানুষদের কটু চোখের দৃষ্টি এড়ানো – সবই সহ্য করতে হয় আমার মতো নারীদের।”
“কোনও শুভ কাজে হয়তো আমাকে ডাকা হয়েছে, সেখানে গিয়ে কথা শুনতে হয় যে বিধবারা ওরকম অনুষ্ঠানে গেলে ওই পরিবারটির কোনও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে অনেকবার পড়তে হয়েছে আমাকে,” বলছিলেন মিজ পাটিল। তার কথায়, গ্রাম পঞ্চায়েত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে তার মতো বিধবারা ওই সব পরিস্থিতি থেকে এবার মুক্তি পাবে। এইসব নিয়ম আর আচার দীর্ঘকাল ধরে হিন্দু সমাজের সিংহভাগ পরিবারে কঠোরভাবে মানা হয়ে আসছে।
‘স্বামীই বলে গিয়েছিলেন যেন বৈধব্যের বেশ না নিই’
হেরওয়ার গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মানিক কালাপ্পা নাগাভেও বিধবা হয়েছেন বছর পনেরো আগে। কিন্তু তার স্বামী মৃত্যুর আগেই বলে গিয়েছিলেন যে মিজ নাগাড়ে যেন কোনও মতেই বিধবার বেশ না নেন।
তার কথায়, “কপালে টিপ পরা, সাজগোজ করা, গলায় হার পরা, ভাল ভাল শাড়ি পরা – এসবই তো নিষিদ্ধ ছিল সমাজে। তবে আমি নিজে এগুলো সবই করতাম, কারণ আমার স্বামী মৃত্যুর আগেই এরকম বলে গিয়েছিলেন।”
“আরও কেউ কেউ হয়তো নিজেরা এরকম ভেবেছেন, কিন্তু একটা গোটা গ্রামের মানুষ এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে – এটা খুবই ভাল হয়েছে,” জানাচ্ছিলেন প্রধান শিক্ষিকা মিজ নাগাভে।
কীভাবে সম্ভব হল এরকম একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া?
গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান সুরগোন্ডা পাটিল জানালেন, “করোনার প্রথম আর দ্বিতীয় ঢেউতে অনেক তরুণ-যুবক মারা গেছেন গ্রামে। তাদের বিধবাদের বয়স সব ২৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে। প্রায় সবারই ছোট বাচ্চা আছে।”
তিনি জানান, “সমাজে বিধবাদের যেসব সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়,তা আমাকে এসে জানাতো ওরা। তখনই মাথায় একটা চিন্তা আসে যে এদের কীভাবে এইসব আচার, রীতিনীতি থেকে মুক্তি দেওয়া যায়।”
সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্য গ্রামের মানুষদের সঙ্গে, বিশেষত নারীদের সঙ্গে নানা ভাবে আলোচনা চালিয়েছেন তারা। মতামত নেওয়া হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও।
মি. পাটিলের কথায়, “তারপরে পয়লা মে গ্রামের সব মানুষকে ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেউই তো বিরোধিতা করেনি সিদ্ধান্তের।” সিদ্ধান্তটা গ্রামের মানুষ নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল একটি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ওই সংস্থার প্রধান প্রমোদ ঝিঞ্ঝাডের মাথাতেও বিধবাদের এই রীতি-নীতি থেকে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা আসে এক সহকর্মীর মৃত্যুর পরে তার বিধবা স্ত্রীর অবস্থা দেখে।
তিনি বলছিলেন, “সহকর্মীর করোনায় মৃত্যুর পরে তার পরিবারের পাশে খুব বেশি মানুষ গিয়ে দাঁড়াতে পারেননি। তবে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তখন তার সদ্য বিধবা স্ত্রীর গা থেকে এক এক করে গয়না গাটি খুলে নেওয়া হচ্ছে, মঙ্গলসূত্র খুলে নেওয়া হল, সিঁদুর মুছিয়ে দেওয়া হল আর সেসব আগুনে ফেলে দেওয়া হল। এসবই আবার করাচ্ছিলেন কয়েকজন বিধবা নারী।”
রামমোহন রায়ের আড়াইশোতম জন্মবছরেও বিধবাদের এই অবস্থা!
ওই দৃশ্যটাই মি. ঝিঞ্ঝাডের মনে দাগ কেটে যায় – তিনি ভাবেন যে রাজা রামমোহন রায় প্রায় দুশো বছর আগে হিন্দু বিধবাদের স্বার্থের কথা ভেবেছিলেন, অথচ এই প্রথা এখনও চলছে।
সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে আর হিন্দু বিধবাদের স্বার্থ রক্ষায় যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়, তার জন্মের এখন আড়াইশো বছর পালন করা হচ্ছে। কলকাতার নারী আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ হেরওয়ার গ্রামের সিদ্ধান্তের খবর পত্রিকায় দেখেছেন।
তার আক্ষেপ, “আমরা রামমোহন রায়ের আড়াইশো বছর পালন করছি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিন পালন করি, অথচ তাদের যে আকাঙ্খাগুলো ছিল বিধবাদের নিয়ে, সেগুলো পূরণ করতে সচেষ্ট হই না!”
ঘটনাচক্রে হেরওয়ার গ্রামেই প্রায় একশো বছর আগে ভারতের সংবিধানের রূপকার ও সমাজ সংস্কারক ভীমরাও আম্বেদকার আর শাহুজি মহারাজ প্রথম যৌথ সভা করেছিলেন। ওই গ্রামের সিদ্ধান্ত দেখে এখন মহারাষ্ট্র সরকারও চিন্তাভাবনা শুরু করেছে যে গোটা রাজ্যেই এই নিয়ম চালু করা যায় কী না – তা নিয়ে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।