অর্ণব সান্যাল : প্রচারে কিছুটা পিছিয়েই ছিল ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’। তবে ‘কিন্তু’ নিয়ে দেখতে বসলেও একপর্যায়ে আটকেই যেতে হলো স্ক্রিনের সামনে। তখন বোঝা গেল, কেন এই সিনেমাটিকে গুগল রিভিউয়ে একজন ব্যক্তি ‘মাস্টারপিস’ তকমা দিয়েছেন!
শুরুতেই পর্দায় আসে মরা হাতি। প্রবাদে যেমন আছে, মরা হাতির দামও লাখ টাকা; ঠিক তেমনি পর্দার মরা হাতির কাছ থেকেও কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিল মানুষ। এরপর সেই হাতিকে ফেলে রাখা হয়েছিল পঁচে সাবাড় হওয়ার জন্য। পুলিশ সেই পঁচতে থাকা হাতিকে ঘিরেই ছক কষতে থাকে, কাকে দায় দেওয়া যায়! শুরুটা শেষ পর্যন্ত রক্তস্নাতই হয়। মানুষ আর হাতির রক্ত অরণ্যের মাটিতেই গিয়ে মেশে অচ্ছুত হিসেবে।
বলছি ভারতের তামিল ভাষার নতুন চলচ্চিত্র ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’-এর কথা। বৈশ্বিক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে ছবিটি দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি এটি মুক্তি পেয়েছে। হ্যাঁ, তা ঠিক যে, এই ছবি নিয়ে তুমুল হট্টগোল নেই। বক্স অফিসে প্রথম দিনে রেকর্ড আয় করল কিনা, বা তিন দিনের ৩০০ কোটি রুপির ঘরে আয় কিনা—সেসব নিয়েও কোনো আলোচনা নেই। বরং ছবিটির নাম শুনেই অনেকে কপাল কুঁচকে তাকাতে পারেন। ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’ নাম যখন, তখন বৈশ্বিক দর্শকদের কিছুটা ভড়কে যাওয়া স্বাভাবিকই।
পুরুষকে পাশবিক হওয়ার শিক্ষাই কি দিল অ্যানিম্যাল?পুরুষকে পাশবিক হওয়ার শিক্ষাই কি দিল অ্যানিম্যাল?
তাই ছবিটির প্রচার হয়েছে অনেকটা মানুষের মুখে মুখে। সেই মানুষের বা ছবিটি দেখা দর্শকদের সংখ্যাও ‘পাঠান’, ‘জওয়ান’ বা ‘অ্যানিম্যাল’-এর বিশাল দর্শকসংখ্যার তুলনায় নগণ্য। অভিনয়শিল্পীদের তালিকাতেও নেই শাহরুখ খান, সালমান খান বা রণবীর কাপুরদের মতো বড় বড় নাম। ফলে প্রচারে কিছুটা পিছিয়েই ছিল ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’। তবে ‘কিন্তু’ নিয়ে দেখতে বসলেও একপর্যায়ে আটকেই যেতে হলো স্ক্রিনের সামনে। তখন বোঝা গেল, কেন এই সিনেমাটিকে গুগল রিভিউয়ে একজন ব্যক্তি ‘মাস্টারপিস’ তকমা দিয়েছেন!
দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক শ্রেণির মানুষের আরেক শ্রেণির (প্রশাসনিকভাবে শাসক) মানুষের কাছে খাদ্য হওয়ার বাস্তবতা দেখিয়েই ছবিটির গল্প চলে যায় একেবারে অন্য ঘরানায়। পর্দায় ভেসে ওঠে শহরকেন্দ্রিক সভ্যতার ক্ষমতার লড়াই। তাতে রাজনীতি আছে, পেশীশক্তির বড়াই আছে। আর রয়েছে সাধারণ মানুষের খুবই সাধারণ স্বপ্নের দু’ টুকরো হয়ে যাওয়ার গল্প। তাও আবার অন্যের অন্যায় স্বার্থের বলি হয়ে। এই সময়টায় ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’ দেখতে দেখতে মনে হবে, যেন পশ্চিমা দেশের একসময়কার বুনো নিয়মে চালিত হচ্ছে আমাদের চেনা কোনো অঞ্চল। সেই সঙ্গে হলিউডের ওয়েস্টার্ন ঘরানার সিনেমার অন্যতম অভিনেতা ক্লিন্ট ইস্টউডের নামের বহুল ব্যবহারে ওই ধারণা আরও পোক্ত হয়ে ওঠে।
রাষ্ট্র–সমাজকে কতটা কাঠগড়ায় তুলল ফারুকী-তিশার ‘অটোবায়োগ্রাফি’রাষ্ট্র–সমাজকে কতটা কাঠগড়ায় তুলল ফারুকী-তিশার ‘অটোবায়োগ্রাফি’
মারদাঙ্গা অ্যাকশন, প্রধান চরিত্রের এক ঘুঁষিতে বা হালকা লাথিতে বিপরীত পক্ষের লোকজনের উড়ে উড়ে পড়া এবং সেই সঙ্গে চটুল নাচ-গানের অতি পরিচিত ব্যবহারে এই পর্যায়ে ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’-কে পরিচিত মাসালা মুভির জঁনরা থেকে আলাদা ভাবা মুশকিল হয়ে পড়ে। তার সাথে সাথে আবার ছিল গুপ্তহত্যার সুপ্ত বাসনা নিয়ে সিনেমা বানানোর আপাত আজগুবি উপাদান। ফলে যেকোনো দর্শকের মনে হতেই পারে যে, দেখছি কী!
এমন মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার ঠিক কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা উধাও করে দিয়েছেন সিনেমার পরিচালক ও গল্পের স্রষ্টা কার্তিক সুব্বারাজ। সিনেমার গল্প এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন, যেখানে পৌঁছানোর পর প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার মতো করে আপনাকে বলতেই হবে—‘আরেহ্ বাহ্!’ কারণ গাড়ির মুখ হুট করে পুরোপুরি ঘুরিয়ে উল্টো লেনে সমানতালে চালানোটা চালকের মুনশিয়ানারই ফসল। এসব ক্ষেত্রে ঝড়ে বক মরে না, ফকিরও কেরামতি দেখানোর সুযোগ পায় না।
ইউটার্নের পর গল্প যে পথে চলেছে, তাতে পদে পদে বঞ্চনা আছে, শোষণ আছে। আছে সেই ব্রিটিশদের দিয়ে যাওয়া বিভক্তি আর উচ্ছেদের নিয়মের পুনরাবৃত্তি। আগাছা কাটার মতো করে প্রকৃতির অংশ হয়ে ওঠা মানুষদের কীভাবে আমরাই শিকড়সহ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করি, কীভাবে রাজনীতি শুধু রাজারই থেকে যায় প্রজাদের প্রবল উপেক্ষা করে—সেসব যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’। শেষটায় এই সবকিছুর শোধ নিতে শুরু করে ‘সিনেমা’ নিজেই। ক্লিন্ট ইস্টউডের দেওয়া হ্যান্ড ক্যামেরাই হয়ে ওঠে বুলেট-বোমার চেয়েও বড় অস্ত্র।
এক কথায়, ‘সুপার ডিলাক্স’ ও ‘কান্তারা’র পর আরেকটি নতুন ঘরানার স্টোরিটেলিং দেখা গেছে ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’-এ। গত শতকের সত্তরের দশকের প্রেক্ষাপটে বানানো ছবিটি দর্শকদের যেন এক চিরচেনা ও নিষ্ঠুর বাস্তবতার নব্য চিত্রায়ন দেখায়। এতে স্টোরিটেলিংয়ের বাঁধা-ধরা নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই সুনিপুণ দক্ষতায় বানানো হয়েছে নতুন ধারাপাত। শুধু ভারতীয় সিনেমা নয়, বরং পুরো উপমহাদেশের সিনেমা জগতেই একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’। এটি বলাই যায়। এমন অভিধাতে কারও কারও আপত্তি থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আজকের এই প্রবল কর্তৃত্বপূর্ণ পৃথিবীতে তিতকুটে সত্যকে এতটা সরলে-সোচ্চারে দেখিয়ে দেওয়া সহজ কম্মো নয়।
‘খুফিয়া’তে বাঁধনকে নেওয়ার দরকার কি ছিল?‘খুফিয়া’তে বাঁধনকে নেওয়ার দরকার কি ছিল?
আগেই বলা হয়েছে যে, এই সিনেমায় অভিনয়শিল্পীদের বহরে বিশাল বিশাল তারকা বা সুপারস্টারদের নাম নেই। মূল চরিত্রে আছেন রাঘব লরেন্স ও এস জে সুরিয়াহ। গ্যাংস্টারের ভূমিকায় রাঘব দুর্দান্ত। একই মূল্যায়ন করতে হয় এস জে সুরিয়াহর ক্ষেত্রেও। এই দুজনের চরিত্রে অন্য কাউকে কল্পনা করা সত্যিই দুরূহ। অন্যান্য চরিত্রে যোগ্য সংগত দিয়েছেন নিমিষা সাজায়ান ও টম চাকো। খল চরিত্রে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন নবীন চন্দ্র। সব মিলিয়ে ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’-এ শিল্পীদের অভিনয়ে কোনো ঘাটতি সেভাবে চোখে পড়েনি খুব একটা। একমাত্র খুবই দক্ষ হাতে লেখা চিত্রনাট্যেই এমনটা হওয়া সম্ভব।
চিত্রনাট্যের কথা যখন এলোই, তখন পরিচালক ও গল্পকার কার্তিক সুব্বারাজের প্রশংসা করতেই হয়। কার্তিকের এই ছবিটি তাঁর বানানো ২০১৪ সালের ছবি ‘জিগারঠান্ডা’র প্রিক্যুয়েল অনেকটা। সেই হিসাবে ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’ সত্যিই সব দিক থেকেই ডবল। কার্তিক বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, মাধ্যম হিসেবে সিনেমার ক্ষমতাকে তুলে ধরার পাশাপাশি কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায় ও হলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা-নির্মাতা ক্লিন্ট ইস্টউডের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি ‘জিগারঠান্ডা ডবলএক্স’ নামের ছবিটি দিয়ে। মজার বিষয় হলো, তুমুল জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেতা রজনীকান্তের উদ্ভবের ঘটনাও কিছুটা এসেছে এই ছবিতে।
ঠিক শেষ দৃশ্যে দর্শকদের একটি বার্তা দিয়েছেন পরিচালক। সেটি হলো ডবলের পর ট্রিপলএক্স আসার ঘোষণা। ডবলএক্সের মতো ট্রিপলও একইরকম সুখানুভূতি দর্শকদের উপহার দেয় কিনা, সেটিই দেখার বিষয়। তা হলে, হয়তো আসছে বছরের সেরা সিনেমার তকমাটিও ‘জিগারঠান্ডা’র ঘরেই যাবে!
রেটিং: ৪.৫/৫
পরিচালক: কার্তিক সুব্বারাজ
গল্প ও চিত্রনাট্য: কার্তিক সুব্বারাজ
অভিনয়শিল্পী: রাঘব লরেন্স, এস জে সুরিয়াহ, নবীন চন্দ্র, নিমিষা সাজায়ান, টম চাকো প্রমুখ
ভাষা: তামিল
ধরন: অ্যাকশন-কমেডি
মুক্তি: ৮ ডিসেম্বর ২০২৩/নেটফ্লিক্স
লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।