জুমবাংলা ডেস্ক : কোভিড মহামারি পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব সারা বিশ্বে পড়েছে। তীব্র জ্বালানি সংকট, খাদ্য সরবরাহ কমে যাওয়া, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিসহ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে বিশ্বের অনেক ধনী রাষ্ট্রেও। এ যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনীতিও হিমশিম খাচ্ছে। সব সংকটকে ছাপিয়ে বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে মুদ্রাস্ফীতি, যার বাইরে নয় বাংলাদেশও।
বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন খোদ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয় বলেও আশ্বস্ত করেছেন তিনি। জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ সালের জন্য দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঙ্কের মোট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত এ বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রীর জন্য নতুন অর্থবছরের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা, যা এখন ৯ শতাংশের বেশি। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগে আছেন সাধারণ মানুষও। ফলে এ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার দিকে তাকিয়ে তারা। বিষয়টি সরকার যে বিবেচনায় নিয়েছে, তার প্রমাণ রয়েছে অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যেই।
অর্থনীতির পরিভাষায় যা মূল্যস্ফীতি, তা-ই সাধারণ মানুষের জীবনে হাজির হয় উচ্চ দ্রব্যমূল্যের রূপ নিয়ে। আয়ের সাথে ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই বিচলিত করে সবাইকে। বিশেষত সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষেরা পড়েন সবচেয়ে বড় বিপাকে।
অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি শব্দটিও সমভাবে এবং বেশ গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। এ দুটি বিষয়কে অনেক সময়ই অনেকে গুলিয়ে ফেলেন। এ দুটির মধ্যে যোগ থাকলেও কিছু ফারাকও রয়েছে। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে তাই এ দুটি বিষয় একটু পরিষ্কার হয়ে নেওয়া যাক।
মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি
মূল্যস্ফীতি হচ্ছে কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া। মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে অর্থনীতিতে মুদ্রার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও বড় ধরনের মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির জন্য অভিঘাত হিসেবে দেখা হয়, যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে। এ কারণ মুদ্রাস্ফীতি হলে বাজারে তারল্য বেড়ে যায়। এর সরাসরি প্রভাবে মুদ্রার মানের অবনমন হয়। ফলে এটি মূল্যস্ফীতির সংকটের পালে হাওয়া দেয়।
সহজ ভাষায় বললে, একটি দেশের বাজারে পণ্যের মজুত এবং মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। যদি পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেড়ে যায়; অর্থাৎ, দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা ছাপায় তখনই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
এর ফলে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে আপনাকে আগের চাইতে বেশি মুদ্রা খরচ করতে হবে। এর মানে জিনিষপত্রের দাম বেড়ে যাবে। সব মিলিয়ে ওই মুদ্রার মান বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।
মুদ্রাস্ফীতির উদ্বেগে সারা বিশ্ব
সহিংসতা, দুর্নীতি, লিঙ্গ বৈষম্য, সামাজিক নিরাপত্তা, বেকারত্ব এমনকি করোনা ভাইরাসের চেয়ে বিশ্ব এখন বেশি উদ্বিগ্ন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইপসস-এর এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপভিত্তিক গবেষণার জন্য সমাদৃত ইপসস গত ২৫ মে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘বিশ্ব কী নিয়ে উদ্বিগ্ন’ বিষয়টিই ছিল এ গবেষণার মূলে। সেখানে সারা বিশ্বেই সবচেয়ে বড় শঙ্কা হিসেবে মুদ্রাস্ফীতির কথা উঠে এসেছে। এতে মে মাসসহ টানা ১৪ মাসের তথ্য সন্নিবেশ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি টানা ৩ বছর ধরেই এই গবেষণাটি করছে, যা প্রতিবেদন আকারে তারা নিয়মিত বিরতিতে প্রকাশ করছে।
গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় ২৯টি দেশে প্রতি ১০ জনে ৪ জন মানুষ দাম বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন, যা জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৪১ শতাংশ।
জরিপের আওতায় থাকা সব দেশেই মূল্যস্ফীতির পর মানুষ দারিদ্র্য এবং সামাজিক বৈষম্য (৩০%), অপরাধ ও সহিংসতা (২৯%), আর্থিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি (২৭%) এবং বেকারত্ব (২৭%) নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন এখনও বিশ্বব্যাপী সপ্তম বৃহত্তম উদ্বেগ বলে উঠে এসেছে ওই গবেষণায়। এমনকি করোনা ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ।
ইপসসের জরিপের আওতায় থাকা ২৯টি দেশের মধ্যে আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, ভারত, পোল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কে দাম বৃদ্ধি পাওয়াকে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হিসেবে দেখছে সে দেশের মানুষ৷
তবে আশার বিষয় হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে ওই দেশগুলোর ৩৮ শতাংশ নাগরিক মনে করে, তাদের দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে। এটি চলতি বছরের এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে বেড়েছে।
সামগ্রিকভাবে আশাবাদের এই সামান্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও আর্জেন্টিনা আরও হতাশাবাদী হয়ে উঠেছে। তবে আর্জেন্টিনার ৯২ শতাংশ মানুষই মনে করে, তাদের দেশ ভুল পথে এগোচ্ছে। সে দেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ নাগরিক দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কিত। আলোচ্য দেশগুলোর মধ্যে এ নিয়ে আর্জেন্টিনাতেই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ দেখা গেছে। এদিকে তুরস্কে জীনযাত্রার ব্যয় কিছুটা কমায় এ উদ্বেগ কিছুটা কমলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কা এখনো শীর্ষেই রয়েছে।
তবে বিশ্বব্যাপী এই টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যেও নিজ দেশের অর্থনীতি নিয়ে স্বস্তি প্রকাশও করেছেন অনেকে। গড়ে বিশ্বব্যাপী ৩৫ শতাংশ লোক তাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ভালো বলে বর্ণনা করেছেন।
গত মাস থেকে, ‘ভালো অর্থনীতি’ স্কোর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রে। বিপরীতে, ইতিবাচক অর্থনৈতিক অনুভূতি সবচেয়ে বেশি কমেছে জার্মানিতে।
বাংলাদেশ কোথায়?
অর্থনীতিবিদদের মতে, মুদ্রাস্ফীতি যদি ওই দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে কম থাকে, তাহলে তেমন নেতিবাচক প্রভাব থাকে না।
সাধারণত ২ থেকে ৫ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি থাকলে সেটাকে সহনীয় ধরা হয়। ৭ থেকে ১০ শতাংশ হলে মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। এবং এর চেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতি পুরো দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে এটা নির্ভর করে সেই দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর।
তবে হাতে গোনা কয়েকটি পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়লেই সেটাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা যাবে না। যদি সামগ্রিকভাবে পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ে, তাহলেই বুঝতে হবে মুদ্রাস্ফীতির কারণে এমন হয়েছে।
এবার তাকানো যাক সদ্যঘোষিত বাজেটের দিকে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক কর অথবা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। ফলে বেশ কিছু নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়তে পারে। বাজেটে যেসব পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে:
• স্বর্ণ আমদানিতে কর বাড়িয়ে ভরিতে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে। ফলে বাড়তে পারে স্বর্ণের দাম। সেই সাথে লাগেজে স্বর্ণ আমদানির সুবিধা কমানো হয়েছে।
• সব ধরনের সিগারেটের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একটি স্তরে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে সিগারেটের দাম বাড়তে পারে। তবে বিড়ির দাম না–ও বাড়তে পারে।
• কলম উৎপাদনে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতি আছে। তবে এবারের বাজেটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে কলমের দাম বাড়তে পারে। এর প্রভাব পড়বে শিক্ষা খাতে।
• টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু, কিচেন টাওয়াল ও পেপার টাওয়াল উৎপাদনে বিদ্যমান ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে টিস্যু পেপারের দাম বাড়তে পারে।
• উৎপাদন পর্যায়ে এলপিজি সিলিন্ডারের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে সিলিন্ডার বানানোর কাজে ব্যবহৃত স্টিল ও ওয়েল্ডিং ওয়্যার আমদানিতে শুল্ক আরোপ হয়েছে। এ কারণে এলপি গ্যাসের দাম বাড়তে পারে।
• বাসা-বাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের থালাবাসনের উৎপাদনে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে থালাবাসনের দাম বাড়তে পারে।
• সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে বর্তমানে টনপ্রতি ৫০০ টাকা সুনির্দিষ্ট শুল্ক আছে। এটি বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। ফলে সিমেন্টের দাম বাড়তে পারে।
• এ ছাড়া খেজুর, বিদেশি বাদাম, চশমা-রোদচশমা, বাসমতি চাল, আঠা বিদেশি লিফট ও মোবাইল ফোন এবং বাইসাইকেলের দাম বাড়তে পারে।
ফলে নিত্য ব্যবহার্য অনেক পণ্যের দামই বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এর সাথে রয়েছে কমে আসা রিজার্ভ, ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমনের মতো বিষয়গুলো। এই সবগুলো বিষয় একসঙ্গে বিবেচনায় নিলে ঘোষিত বাজেটে মূল্যস্ফীতিকে সাড়ে ৬ শতাংশে আটকে রাখা সত্যিই বড় চ্যালেঞ্জ।
সমাজে কেমন প্রভাব
মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি আরেক শ্রেণি লাভের মুখ দেখেন। মুদ্রাস্ফীতির সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি লাঘবে তৎপর হলে পরিস্থিতি খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সাধারণত কয়েকটি খাত এই মুদ্রাস্ফীতির কারণে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হয়।
মুদ্রাস্ফীতির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনযাত্রার মানে। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের ব্যাপক টানাপড়েনে পড়তে হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় অনেকেই তাদের খরচের লাগাম টেনে ধরতে বাধ্য হন। তবে ব্যবসায়ী ও উৎপাদকগোষ্ঠী এর প্রভাবে লাভবান হন। সবচেয়ে বড় প্রভাবটি পড়ে আয় বৈষম্যের ক্ষেত্রে। অতি ধনী ও অতি দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বাড়ায় তা সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার বিষয়টি সাধারণ মানুষ সবার আগে শনাক্ত করে। এ কারণেই এ নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে সমাজের নানা স্তরে। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বেই এখন এ ঘটনাটিই ঘটছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।